আমার অবস্থা অনেকটা এই ছেলের মতো, সব সময়েই সব জায়গায় আমি আশার আনন্দ খুঁজে পাই। আমার ধারণা, শুধু আমি নই, আমার মতো যারা ১৯৭১-এর সেই ভয়াবহ সময় পার করে এসেছে তাদের সবাই এই দেশ নিয়ে আশাবাদী।
আমি স্বীকার করছি, খবরের কাগজ দেখলে যে কেউ এক ধরনের হতাশা অনুভব করবেন। কিছু দিন আগেও সেখানে ছিল ধর্ষণ, গণধর্ষণ আর শিশু ধর্ষণের খবর। মনে হচ্ছিল মাদ্রাসার শিক্ষকেরা বুঝি একজনের সঙ্গে আরেকজন এ ব্যাপারে প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। এখন হচ্ছে ডেঙ্গু খবর। সারাজীবন দেখে এসেছি বেঁচে থাকতে হলে মানুষের রোগ শোক হয়, কিছু দিন ভুগে আবার ভালো হয়ে যায়। এখন কথা নেই বার্তা নেই, দুধের শিশুটি থেকে বড় মানুষ ডেঙ্গুতে হঠাৎ করে মারা যাচ্ছে। কী ভয়ঙ্কর একটা পরিবেশ। ঈদের আগে আর পরে গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টের খবর, এত অল্প সময়ে সড়ক দুর্ঘটনায় এত মানুষ মারা যেতে পারে, নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস হয় না। ঈদের সময় হঠাৎ দেখি চামড়া কেলেঙ্কারির খবর, রাতারাতি বিচিত্র সিন্ডিকেট গড়ে উঠে চামড়া ব্যবসায়ীদের পথে বসিয়ে দিচ্ছে। তার আগে ছিল বন্যার খবর। মাঝখানে দুধ নিয়ে বিশাল হইচই– গবেষকরা দুধে অ্যান্টিবায়োটিক পেয়েছেন, মুখ ফুটে সেই কথাটি বলা মাত্র মনে হলো সরকারি কর্মকর্তারা গবেষকদের টুঁটি চেপে ধরবেন। একটা সমস্যাকে অস্বীকার করলেই কী সমস্যাটা চলে যায়? এমনিতে সারাবছরই রোহিঙ্গাদের নিয়ে খবর থাকে, ইয়াবার বড় বড় চালান নিয়ে খবর থাকে, ক্রসফায়ারে বিনা বিচারে মানুষ মেরে ফেলার খবর থাকে, বাংলাদেশ বিমানে করে যাত্রী আনা নেওয়ার খবরের বদলে সোনা আনা নেওয়ার খবর অনেক বেশি থাকে। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার ছিল ছেলেধরা সন্দেহে একেবারে নিরীহ নারী-পুরুষকে নির্মমভাবে পিটিয়ে মেরে ফেলা। হঠাৎ মনে হতে থাকে আমরা বুঝি সভ্য মানুষ নই, আমরা বুঝি মধ্যযুগের বর্বর মানুষ।
কাজেই খবরে কাগজ পড়ে কারও যদি মন খারাপ হয়, কেউ যদি হতাশা অনুভব করেন, আমরা তো তাকে দোষ দিতে পারি না। আমি এর মধ্যেও নিজের আশাবাদকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করি। দাঁতে দাঁত চেপে খবরগুলো পড়ি, তারপর নিজেকে বোঝাই পৃথিবীর সব জাতি কোনো না কোনো সময় এই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে গিয়েছে, আমরাও যাচ্ছি। একসময় আমরা শক্ত অর্থনীতির ভিত্তির ওপরে দাঁড়াবো। এখনই আমাদের ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরা সমানতালে লেখাপড়া করছে, সেই লেখাপড়ার মান আরও ভালো হবে। দেশের ছেলেমেয়েরা আধুনিক মানুষ হিসেবে বড় হবে। সরকার ঠিকভাবে চলবে, আইনের শাসন দৃঢ় হবে, দুর্নীতি কমে আসবে, বায়ুদূষণ বন্ধ হবে, খাবারে ভেজাল থাকবে না। নদীগুলো মুক্ত হবে, সবুজ দেশটি আরও সবুজ হয়ে উঠবে। আমি এসব নিয়ে আশা করতে একটুও ভয় পাই না। আশাবাদী হয়ে বেঁচে থাকার একটা অনেক বড় সুবিধা আছে, ভয়ঙ্কর দুঃসময়টিও সাহস নিয়ে পার করে দেওয়া যায়! বিষয়টি জানি, কারণ আমি নিজেও এমন সময় পার করেছি!
মানুষ খুবই বিচিত্র একটি প্রাণী। একজন মানুষ হয়তো নিজের জীবন নিয়েই হিমশিম খাচ্ছেন, তারপরও তিনি পুরো দেশ নিয়ে চিন্তাভাবনা করেন। শুধু দেশ নয়, পৃথিবী নিয়ে চিন্তাভাবনা করেন। কেউ কেউ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড নিয়ে মাথা ঘামান। যে কোনো মানুষের সঙ্গে কথা বললে দেখা যাবে তার দেশ নিয়ে কিছু একটা পরিকল্পনা আছে। দেশটাকে কীভাবে ঠিক করা যাবে সেটা নিয়ে তার নিজের চিন্তাভাবনা আছে। আমিও চিন্তা করি। তবে আমার ধারণা, অন্যরা যেরকম অল্পতে কাতর হয়ে যান আমি তত সহজে কাতর হই না। আশাবাদী হওয়ার কারণে যেটুকু পেয়েছি তাতেই মহাখুশি হয়ে যাই, যেটুকু পাইনি তার জন্যে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করি। ভবিষ্যতে পেয়ে যাবো সেটা আশা করে বসে থাকি।
আমি কী পেয়েছি? যাদের জন্মই হয়েছে বাংলাদেশে তারা বুঝবে না কিংবা অনুভব করবে না। কিন্তু আমাদের প্রজন্ম জানে যে আমরা বাংলাদেশটি পেয়েছি। যদি না পেতাম তাহলে আমাদের কী অবস্থা হতো আমি কল্পনাও করতে পারি না। যদিও বামপন্থি অধ্যাপকরা ক্রমাগত আমাদের যুক্তি প্রমাণ দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছেন, এই দেশের উন্নয়নের পুরো ব্যাপারটিই একটা ভাঁওতাবাজি। কিন্তু আমি তো দেখতে পাচ্ছি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান একটা ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে দেশে-বিদেশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন আর আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমানে সমান হয়ে একটা মর্যাদার আসনে বসে নানা দেশের প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলছেন। আমি আমার ইউনিভার্সিটিতে ২৫ বছর অধ্যাপনা করে অবসরে গিয়েছি। পুরো সময়টুকু কীভাবে কম খরচে একটা ডিপার্টমেন্ট চালানো যায় তার কলাকৌশল আবিষ্কার করে দিন কাটিয়েছি। পুরো বিশ্ববিদ্যালয় বছরে মাত্র কয়েক কোটি টাকা পেয়েছে, সেটা দিয়ে কোনোমতে একটা বিল্ডিং তোলা হয়েছে, কয়েকটা ক্লাসরুম বানানো হয়েছে। অথচ এখন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজার কোটি টাকার কাজ শুরু হতে যাচ্ছে। বামপন্থি অধ্যাপকরা নিশ্চয়ই আমাকে বোঝাতে পারবেন এই হাজার কোটি টাকার মাঝে রয়েছে বিশাল শুভঙ্করের ফাঁক। কিন্তু যতক্ষণ বোঝাতে না পারছেন ততক্ষণ এই বিশাল অঙ্কের টাকা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নের স্বপ্ন দেখে আনন্দ পেতে চাই। আমি অল্পতেই খুশি হই, বেশি হলে আমি কী পাগলামো করে ফেলবো কে জানে!
যাই হোক, দেশের উন্নয়নের ব্যাপারটা আমার পাওয়ার মূল বিষয় নয়। আমার মূল পাওয়া হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীর বিচার। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও দীর্ঘদিন একটা গ্লানি নিয়ে বেঁচেছিলাম। বিশেষ করে যখন যুদ্ধাপরাধীরা এই দেশের মন্ত্রী হয়ে গাড়িতে পতাকা লাগিয়ে ঘুরে বেড়াতো সেই জ্বালা সহ্য করা খুব সহজ ছিল না। যখন ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা জানতে চাইতো যারা এই দেশটাকে চায়নি তারা কেমন করে এই দেশের মন্ত্রী হয়, আমি তাদের এই অতি সহজ-সরল প্রশ্নের উত্তর দিতে পারতাম না। আমাকে এখন আর সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে হয় না, উল্টো সুযোগ পেলে (কিংবা না পেলেও) তাদের মনে করিয়ে দিই, ৪০ বছর পরে হলেও আমরা যুদ্ধাপরাধীর বিচার করেছি।
দেশ নিয়ে আমার কি আরও কিছু চাওয়ার আছে? যখন এটা নিয়ে চিন্তা করি তখন মনে হয় আমি দেশ থেকে আর মাত্র দু’টি জিনিস চাই, তারপরে আর কিছু চাওয়ার থাকবে না। আমি যে দু’টি বিষয় চাই তার একটি হচ্ছে রাজনৈতিক দল সংক্রান্ত। আমি চাই এই দেশে যেন মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বিরুদ্ধে কোনো রাজনৈতিক দল না থাকে। আরও সহজ করে বলা যায়, সংসদে সরকারি দল যেরকম হবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের একটি রাজনৈতিক দল, ঠিক সেরকম বিরোধী দলও হবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের। রাজনৈতিক কলাকৌশল নিয়ে দুই দলের মাঝে দ্বন্দ্ব থাকবে, কিন্তু দেশের মূল আদর্শ নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব থাকবে না। আরও সোজাসুজি বলা যায়, জামায়াতে ইসলামীকে সঙ্গী করে আর কোনো দল কোনো দিন রাজনীতি করবে না, নির্বাচন করবে না।
আমার অন্য চাওয়াটি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে। ১৫ই আগস্ট bdnews 24-এ সৈয়দ বদরুল আহসানের একটি লেখা বের হয়েছে (All those men….on 15 August 1975 and after) এই দেশের সবার সেই লেখাটিতে একটিবার হলেও চোখ বোলানো উচিত, তাহলে আমাদের এক ধরনের বোধোদয় হবে। এখন সবাই উঠতে-বসতে বঙ্গবন্ধুর নাম জপ করছে কিন্তু ১৯৭৫ সালে কারা কী করেছিল? কেন করেছিল?
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার বিষয়টি অবিশ্বাস্য রকম হৃদয়বিদারক। আমার মাঝে মাঝেই মনে হয়, একুশটি বছর বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশের বুক থেকে মুছে ফেলার চেষ্টাটুকু কোনো অংশে কম হৃদয়বিদারক নয়। এই দেশে প্রজন্মের পর প্রজন্ম বড় হয়েছে, যাদের কাছে বঙ্গবন্ধুর নামটি পর্যন্ত উচ্চারণ করা হয়নি অথচ বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধু সমার্থক। কেউ যদি মাত্র একটি লাইন ব্যবহার করে বাংলাদেশের ইতিহাস বলতে চায় সেখানেও বঙ্গবন্ধুর নামটি উচ্চারণ করতে হবে। অথচ সেই বঙ্গবন্ধুর নামটি মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিল। কী ভয়ঙ্কর!
কাজেই দেশ নিয়ে আমার দ্বিতীয় চাওয়াটি হচ্ছে, এই দেশের সকল রাজনৈতিক দল বঙ্গবন্ধুকে তার প্রাপ্য সম্মানটুকু দিয়ে রাজনীতি করবে। আরও সহজ করে বলা যায়, বঙ্গবন্ধু সবসময় থাকবেন এই দেশের সব ধরনের রাজনীতির ঊর্ধ্বে। তিনি কোনো দলের মানুষ হবেন না, তিনি হবেন এই দেশের সবার হৃদয়ের মানুষ।
আমার এই দু’টি মোটেও বেশি চাওয়া নয়—দু’টি খুবই ‘একটুখানি’ মাত্র চাওয়া। আমি এটা আইন করিয়ে করাতে চাই না, জোর করে করাতে চাই না। আমি চাই এটা এই দেশের মানুষের হৃদয় থেকে আসুক, দেশের জন্য ভালোবাসা থেকে আসুক।
আসবে। নিশ্চয়ই আসবে। আমি আশাবাদী মানুষ।
বাংলাদেশ সময়: ০০৪৩ ঘণ্টা, আগস্ট ২৩, ২০১৯
এইচএ/