ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিং উন্নয়নে প্রস্তাব

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫০৩ ঘণ্টা, আগস্ট ২৩, ২০১৯
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিং উন্নয়নে প্রস্তাব

বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার রয়েছে এক সুদীর্ঘ ইতিহাস পরিক্রমা। বলা যায়, আধুনিক চিন্তা-চেতনা ও ধ্যান- ধারণার ভিত্তিতে ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে এই অঞ্চলে উচ্চশিক্ষার যাত্রা শুরু হয়। 

তবে ১৪০০-২০০০ বছর পূর্বের এ অঞ্চলের পুন্ড্রনগর (বর্তমান মহাস্থানগড়), পাহাড়পুর ও ময়নামতির বৌদ্ধ মঠগুলোতে আন্তর্জাতিকমানের উচ্চশিক্ষার নিদর্শন পাওয়া যায়। প্রখ্যাত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান বাংলাদেশ থেকে বেশি দূরে নয় এবং সপ্তম শতাব্দীতে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য ছিলেন শীলাভদ্র নামক একজন বাঙালি।

 

বর্তমানে বাংলাদেশে আমরা উচ্চশিক্ষা বা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহান ঐতিহ্যের গর্বিত উত্তরাধিকারী। তবে, এ ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা রক্ষা হয়নি। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ব্রিটিশ আমলে বাংলাদেশে (পূর্ববাংলা) শিক্ষার উন্নয়নের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। ব্রিটিশ শাসনামলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল বাংলাদেশ নামক এ ভূ-খণ্ডে একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়।  

তবে ১৯৫৩-১৯৭০ সময়কালে পাকিস্তান আমলে আরও পাঁচটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় এবং এর শিক্ষার্থী সংখ্যা উল্লেখযোগ্যহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ দেশকে একটি মেধাসম্পন্ন ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ উন্নত জাতি গড়ার লক্ষ্যে স্বাধীনতা লাভের পরপরই ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর (প্রথম বিজয় দিবস) বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন প্রতিষ্ঠা করেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি উচ্চশিক্ষার প্রতি তার সর্বোচ্চ প্রাধান্য ও প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি জাতির সামনে তুলে ধরেন। উচ্চশিক্ষার প্রসার ও মানসম্মত উন্নয়নই প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ঘোষিত ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত বিশ্বের কাতারে আসীন করার পথকে সুগম করবে।  

বিশ্বব্যাপী যখন অর্থনৈতিক মন্দা অব্যাহত রয়েছে, বাংলাদেশ তখন সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ৭ থেকে ৮ শতাংশ স্থিতিশীল জিডিপি অর্জন করেছে। উচ্চ সম্ভাবনা এবং ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি বাংলাদেশকে পরবর্তী এগারোটি সম্ভাবনাময় দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম দেশ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বিশ্বে ৭ম জনবহুল (১৬০ মিলিয়ন) দেশ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ সামাজিক ক্ষেত্রে ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এমডিজি) অধিকাংশই অর্জন করেছে। এ দেশের ১৫ থেকে ৩৫ বছরের ৮০ মিলিয়ন (আট কোটি) যুবশক্তিকে আধুনিক জ্ঞান ও দক্ষতা এবং উচ্চশিক্ষার মাধ্যমে গড়ে তোলা সম্ভব হলে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অর্জিত হবে।  

এজন্য সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশে স্বাক্ষরতার হার ৬৩.০৮ শতাংশ এবং উচ্চশিক্ষায় অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১২ শতাংশের অধিক। উচ্চশিক্ষা স্তরে এ বৃদ্ধি বিস্ময়কর। উচ্চশিক্ষা স্তরে ২০০৯ সালের ১.৬ মিলিয়ন শিক্ষার্থী বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৯ সালে ৩.৮ মিলিয়ন শিক্ষার্থীতে উন্নীত হয়েছে, যা একটি কোয়ান্টাম জাম্প।

তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উচ্চশিক্ষার এ ব্যাপক বিস্তার ও সম্প্রসারণ শিক্ষা ও গবেষণার মান নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। এটি স্পষ্ট যে, উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে এ দেশের উদীয়মান বৈশ্বিক অর্থনীতি ও সমৃদ্ধি পূর্ব এশিয়া এবং নর্ডিক অঞ্চলের দেশসমূহে দৃশ্যমান। এ দেশের শিক্ষা বিশেষ করে উচ্চশিক্ষায় গুণগতমান বাড়ানোর জন্য একটি পদ্ধতিগত বিশ্ববিদ্যালয় র‌্যাংকিং ব্যবস্থার গুরুত্ব অপরিসীম।

বিশ্ববিদ্যালয় র‌্যাংকিং-এর গুরুত্ব:
বিগত কয়েক দশকে বিশ্বব্যাপী উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এসব প্রতিষ্ঠানসমূহের পদ্ধতিগত র‌্যাংকিং শিক্ষার গুণগতমান উন্নয়নের জন্য অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছে। এজন্য বিভিন্ন র‌্যাংকিং যেমন- অ্যাকাডেমিক র‌্যাংকিং অব ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটিজ (এআরডব্লিউইউ), টাইমস ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র‌্যাংকিংস, ওয়েবোমেট্রিকস র‌্যাংকিং, কিউএস ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র‌্যাংকিং ইত্যাদি বিশ্বব্যাপী চালু হয়েছে।  

উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উচ্চশিক্ষার বিস্তার ও সম্প্রসারণ ঘটেছে যা অতীতে কখনই ঘটেনি।  

ইউনেস্কোর মতে, উচ্চশিক্ষা স্তরের গবেষণায় জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় সব ধরনের শিক্ষা, প্রশিক্ষণ অন্তর্ভুক্ত হবে; যা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং সংশ্লিষ্ট শিক্ষকবৃন্দ প্রদান করবেন। সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য অধিভুক্ত কলেজসমূহ প্রতিবছর গ্র্যাজুয়েট তৈরি করে যারা দেশের অর্থনৈতিক গতিকে ত্বরান্বিত করতে ভূমিকা রাখেন।

নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, সম্প্রসারণ, উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার মানোন্নয়ন, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার চাহিদা নিরূপণ, উচ্চশিক্ষার উন্নয়ন ও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রণয়নের লক্ষ্যেই প্রথম বিজয় দিবসে ১৯৭৩ সালের রাষ্ট্রপতির ১০ নং আদেশে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন প্রতিষ্ঠা করা হয়।  

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে তিনভাগে ভাগ করা যেতে পারে- (১) সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়: এটি সরকারি অর্থায়নে ও সহায়তায় পরিচালিত হয় (২) বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়: এটি বেসরকারি খাতে উচ্চশিক্ষা প্রদানকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যা বোর্ড অব ট্রাস্টিজ কর্তৃক পরিচালিত এবং (৩) আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়: এটি ওআইসির মতো বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা কর্তৃক আর্থিক অনুদান পেয়ে থাকে। দেশে বর্তমানে মোট ১৫৫টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে ৪৯টি সরকারি, ১০৪টি বেসরকারি ও ০২টি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়।  

জাতির ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে উচ্চশিক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যদি শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে, তাহলে সমগ্র জাতির জীবনে দুর্ভোগ নেমে আসে। কাজেই দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় যথার্থ র‌্যাংকিং পদ্ধতি অত্যাবশ্যক। সর্বমহলে গৃহীত র‌্যাংকিং পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন, সঠিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন, আর্থিক সুবিধা অর্জন, নতুন গবেষকদের গবেষণা কর্মকাণ্ড পরিচালনায় সহায়তা এবং প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে গঠনমূলক প্রতিযোগিতা গড়ে তুলতে সহায়তা করে। বিশ্বে একাধিক র‌্যাংকিং পদ্ধতি চালু রয়েছে। যেমন : দি টাইমস হায়ার এডুকেশন সাপ্লিমেন্ট, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র‌্যাংকিংস (দি র‌্যাংকিং), কোয়াককোয়ারেলি সিমন্ডস (কিউএস), ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র‌্যাংকিংস, দি সাংহাই জিয়াও টং ইউনিভার্সিটি, একাডেমিক র‌্যাংকিং অব ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটিজ (এআরডব্লিউইউ), ওয়েবোমেট্রিকস র‌্যাংকিং অব ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটিজ, ওয়েবোমেট্রিকস র‌্যাংকিং (স্প্যানিস ন্যাশনাল রিসার্চ কাউন্সিল কর্তৃক প্রকাশিত), দ্য গার্ডিয়ান হায়ার এডুকেশন নেটওয়ার্ক, ইউনেস্কো র‌্যাংকিংস অ্যান্ড অ্যাকাউন্টেবিলিটি ইন হায়ার এডুকেশন, ইউএস নিউজ এডুকেশন, ইউনিভার্সিটাস ২১ এবং এনটিইউ র‌্যাংকিং।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাংলাদশের মতো একটি উদীয়মান দেশে মানসম্পন্ন উচ্চশিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-Sustainable Development Goal (SDG) এ ১৭টি সূচকে অভীষ্ট নির্ধারণ করা হয়েছে। এই অভিষ্ট সমূহের চতুর্থ ও অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সূচক হলো শিক্ষা।  

বর্তমান সরকার শিক্ষা ও গবেষণার মাধ্যমে একবিংশ শতাব্দীর উপযোগী প্রযুক্তিনির্ভর জ্ঞান অর্জন, বৈশ্বিক চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে উদ্ভাবনমূলক গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা, শিক্ষা সহায়ক বিভিন্ন পর্যায়ে নীতিনির্ধারণে বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহকে আধুনিকভাবে গড়ে তুলতে কাজ করে যাচ্ছে। সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণেও কাজ করে চলেছে। তবে বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে র‌্যাংকিং পদ্ধতি চালু হয়নি।  

কাজেই বাংলাদেশে একটি যথোপযুক্ত র‌্যাংকিং পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না। গুণগত মানসম্পন্ন পাঠদান নিশ্চিতসহ শিক্ষার অন্যান্য ক্ষেত্রে মান বজায় রাখতে র‌্যাংকিং পদ্ধতি জরুরি। এই র‌্যাকিং পদ্ধতি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের মধ্যে সুষম প্রতিযোগিতা গড়ে তুলতে সহায়তা করবে। একটি দেশে যথার্থ র‌্যাংকিং পদ্ধতি না থাকলে উচ্চশিক্ষাকে এগিয়ে নেওয়া যায় না।  

এক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এবং সদ্য প্রতিষ্ঠিত অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল যৌথভাবে র‌্যাংকিং পদ্ধতি চালু করতে পারে। অনেকগুলো মানদণ্ডের ভিত্তিতে র‌্যাংকিং পদ্ধতি হওয়া উচিৎ।  

সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য এবং সংশ্লিষ্ট সবার জন্য উপকারী হবে এমন একটি র‌্যাংকিং পদ্ধতি চালু করাই আমাদের লক্ষ্য। প্রস্তাবিত মেথোডোলজিতে গবেষণা, ফ্যাকাল্টি, প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধা ও অবকাঠামো, বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম, অ্যালামনাই, চাকরির বাজারে প্রবেশে শিক্ষার্থীদের কর্মদক্ষতা এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত ইত্যাদি সূচক ব্যবহৃত হবে।

বিশ্ববিদ্যালয় র‌্যাংকিং উন্নয়নের জন্য প্রস্তাব:
১। আন্তর্জাতিক র‌্যাংকিং পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী, তথ্য ও ডকুমেন্টেশন ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রশিক্ষণের জন্য নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে এবং তা সময়মত আন্তর্জাতিক র‌্যাংকিং কর্তৃপক্ষ, ইউজিসির কাছে পেশ করতে হবে। একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট হালনাগাদ করতে হবে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইকিইউএসি (ইনস্টিটিউশনাল কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স সেল) এ লক্ষ্যে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করবে।

ক. আন্তর্জাতিক র‌্যাংকিং নির্ধারণে যে সূচক ব্যবহৃত হয় তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে শিক্ষা ও গবেষণা সংক্রান্ত অভিন্ন তথ্যাদি সংবলিত ডাটাবেজ তৈরি করতে হবে।
খ. প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় গবেষণা ব্যবস্থাপনা এবং বাণিজ্যিক কেন্দ্র চালু করতে পারে।
গ. সমন্বিতভাবে গবেষণা কার্যক্রম এগিয়ে নিতে জাতীয় গবেষণা কাউন্সিল গঠন করা যেতে পারে।
ঘ. আন্তর্জাতিক র‌্যাংকিং পদ্ধতির চ্যালেঞ্জসমূহ শনাক্তকরণ।
ঙ. শীর্ষ স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের র‌্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে সুনাম একটি র‌্যাংকিং সূচক হতে পারে, কারণ একই ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোকে এর মাধ্যমে পৃথক করা খুবই সহজ।  
চ. শিল্প প্রতিষ্ঠানের চাহিদা পূরণে উচ্চমান সম্পন্ন গ্র্যাজুয়েট তৈরিতে বিশ্ববিদ্যালয়কে কাজ করতে হবে।
ছ. প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পারফরমেন্সের ভিত্তিতে র‌্যাংকিং নির্ধারিত হবে। কাজেই প্রতিষ্ঠানসমূহকে তাদের স্ব স্ব অবস্থান থেকে সর্বোচ্চ সেবা প্রদান করতে হবে।
জ. বর্তমানে বিশ্ব প্রযুক্তিনির্ভর হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে আরও দক্ষতার সঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়কে উচ্চমানসম্পন্ন তথ্য প্রযুক্তি সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।
২. প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষদভিত্তিক ও বিষয়ভিত্তিক মূল্যায়নের জন্য অভ্যন্তরীণ র‌্যাংকিং পদ্ধতি প্রবর্তন করতে হবে। এ ধরনের র‌্যাংকিং পদ্ধতি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ সৃষ্টি এবং স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানকে তাদের কর্মকাণ্ডের উৎসাহ যোগাতে ভূমিকা রাখবে।                
ক. প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় অভ্যন্তরীণ র‌্যাংকিং পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করবে যার মাধ্যমে তারা প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব গড়ে তুলবে।                 
খ. বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে র‌্যাংকিং পদ্ধতি চালুর লক্ষ্যে কোয়ালিটি ম্যাট্রিক্স অ্যান্ড মেথডস ক্রাইটেরিয়া শনাক্ত করতে হবে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় এই পদ্ধতিতে অবশ্যই মূল্যায়িত হবে।
গ. বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক অবস্থা নিশ্চিতকল্পে বিভিন্ন মানদ- এবং কৌশল শনাক্ত করতে হবে।  
ঘ. দেশের বাইরে যেসব শিক্ষাবিদেরা কাজ করছেন তাদের শিক্ষাসংক্রান্ত কাজে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তাদের প্রকাশনা ও উপস্থাপনা এদেশের শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে।
ঙ. প্রবাসী বাংলাদেশিদের গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য শ্রেণীভুক্ত করা যেতে পারে।
চ. সাইটেশন বা উদ্ধৃতিকরণ র‌্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। শিক্ষকদের আন্তর্জাতিকমানের মৌলিক গবেষণা বিভিন্ন দেশি-বিদেশি জার্নালে প্রকাশিত হলেও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত জর্নাল  সিস্টেম, যেমন: স্কোপাস, ওয়েব অব সাইন্স, আইএসাই, গুগল স্কলার বা রিসার্চগেটে অন্তর্ভুক্ত না করায় মৌলিক গবেষণাকর্ম হওয়া সত্ত্বেও এর সাইটেশনের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে অনেক কম। ফলে র‌্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে এ সূচকে গবেষক/বিশ্ববিদ্যালয় পর্যাপ্ত ক্রেডিট থেকে বঞ্চিত হয়। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষকদের আরও সচেষ্ট হতে হবে।  

উচ্চশিক্ষার গুণগতমান বৃদ্ধি
শিক্ষাই জাতীর মেরুদণ্ড। আর উচ্চশিক্ষা একটি জাতির অর্থনীতির চালিকাশক্তি। বৈশ্বিক অর্থনীতিতে উচ্চ গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষা ছাড়া একটি জাতির পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব নয়। উদীয়মান অর্থনীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশে গুণগত মানসম্পন্ন গ্র্যাজুয়েট বড়ই প্রয়োজন। গুণগত মানসম্পন্ন উচ্চশিক্ষা শিক্ষার্থীদের মানসম্পন্ন কর্মসংস্থান ও উন্নত জীবনব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে সহায়তা করে।

বাংলাদেশে অধিকাংশ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকার কর্তৃক পরিচালিত হয়ে আসছে। উচ্চশিক্ষায় ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের চাহিদা পূরণে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা অপ্রতুল হওয়ায় পরবর্তীতে দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। বিগত দশকগুলোতে এই ধারা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে।  

ইউজিসি’র পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক মিলিয়ে মোট ১৫৫ টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা শুধুমাত্র এর সংখ্যাগত দিক বৃদ্ধি করলেও সে অনুযায়ী মান বৃদ্ধি করেনি।  

আমাদের প্রচলিত ধারণা, এদেশে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থা উন্নতমানের। র‌্যাংকিং পদ্ধতি শিক্ষার্থী এবং গবেষকদের বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে দিকনির্দেশনা প্রদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।  

দেশের উচ্চশিক্ষা উন্নয়নের জন্য প্রস্তাবিত উদ্যোগ 
ক. গবেষণা ও উন্নয়নের সংস্কৃতি অভিযোজনের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে নতুন নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করতে হবে।
খ. ইউজিসি মানসম্পন্ন পাঠদান, গবেষণা ও শিল্প প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় দক্ষ গ্র্যাজুয়েট তৈরির ক্ষেত্রে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে লক্ষ্যভিত্তিক অ্যাপ্রোচ চালু করবে। এই লক্ষ্যভিত্তিক অ্যাপ্রোচকে প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মদক্ষতা ও তহবিল বরাদ্দের সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে।
গ. গবেষণার ফলাফল নির্দিষ্ট ক্রাইটেরিয়ার (প্রকাশিত জার্নাল, কনফারেন্স, হাই ইমপ্যাক্ট জার্নালস এবং কমার্শিয়ালাইজেশন ইত্যাদি) ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা যেতে পারে।  
ঘ. গ্র্যাজুয়েটদের চাকরির বাজারে প্রবেশের জন্য কোর্স-কারিকুলাম, জ্ঞান, দক্ষতার উন্নয়নের লক্ষ্যে কাঠামোবদ্ধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সহযোগিতা স্থাপন করতে হবে। ৪-৬ মাস এর বাধ্যতামূলক ও কার্যকরি ইন্টার্নশিপ চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে গ্র্যাজুয়েটদের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে পারে।  
ঙ. শিক্ষার মানোন্নয়নে শিক্ষকদের জন্য ধারাবাহিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, নতুন পাঠদান পদ্ধতি, বিষয়ভিত্তিক দক্ষতা এবং প্রশিক্ষণের ফলাফল নিয়মিত মূল্যায়ন ও তদারকি করতে হবে।
চ. কাঙ্ক্ষিত উচ্চশিক্ষা ও শিক্ষার্থীদের ক্যারিয়ার গঠনের জন্য যোগ্যতা অনুযায়ী তাদের পরিচালনার লক্ষ্যে বুদ্ধিবৃত্তিক পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে।
ছ. ফলাফলভিত্তিক শিক্ষা (আউটকাম বেজড এডুকেশন) এর আলোকে বিভিন্ন ডিগ্রির যোগ্যতা শনাক্তকরণের জন্য পদ্ধতি চালু করতে হবে।
জ. প্রয়োজনীয় শর্তারোপ করে স্থায়ী সনদপ্রাপ্ত প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি প্রোগাম চালু করা যেতে পারে। যে বিষয়ে পিএইচডি প্রদান করা হবে সে বিষয়ে কমপক্ষে ০৫ জন পিএইচডি ডিগ্রিধারী পূর্ণকালীন অধ্যাপক থাকতে হবে এবং প্রত্যেক অধ্যাপকের ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর জার্নালে অন্তত ১০টি প্রকাশনা থাকতে হবে (এটি প্রতি বছর প্রযোজ্য হবে)।  
ঝ. গবেষণা, উন্নয়ন ও এর বাজারজাতকরণের জন্য আই কিউএসি (IQAC) এর মতো প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইউনিভার্সিটি ইনোভেশন অ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টার (ইউআইআইসি) চালু করা যেতে পারে।
ঞ. পুরস্কার, স্বীকৃতি ও আর্থিক প্রণোদনার মাধ্যমে গবেষণা ও এর বাজারজাতকরণ সংস্কৃতি ত্বরান্বিত করতে হবে।
ট. শিক্ষকদের গবেষণালব্ধ ফলাফল আন্তর্জাতিকমানের জার্নালে (হাই ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর জার্নাল/ইনডেক্স জার্নালে) প্রকাশিত হলে গবেষক এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগকে আর্থিক প্রণোদনা প্রদান করা যেতে পারে।
ঠ. শিল্প-প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ২-৫ বছরের কাজের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ প্রদান করা যেতে পারে।
ড. একাডেমিক এক্সিলেন্সের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বজনবিদিত সুনাম বৃদ্ধি করতে হবে।
ঢ. যোগ্য প্রার্থীদের নিয়োগ প্রদানের মাধ্যমে গবেষণা ও শিক্ষার মান বৃদ্ধি করতে হবে।
ণ. জাপানের আদলে বাংলাদেশের শিল্পনীতিতে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনতে হবে; যাতে শিল্প-প্রতিষ্ঠানসমূহ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণায় একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ ব্যয় করবে।  
    
এদিকে বাংলাদেশ সম্প্রতি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অন্যতম কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠেছে। এদেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন প্রতিযোগিতা এবং প্রযুক্তি প্রদর্শনীতে ক্রমাগত সাফল্য বজায় রাখছে। দেশের তরুণ প্রজন্মকে দক্ষ মানবসম্পদ এবং উদ্যেক্তা হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সরকার ইতোমধ্যেই কয়েকটি বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনির্ভাসিটি ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি দক্ষিণ এশিয়ার তৃতীয় এবং বিশ্বে ১২তম মেরিটাইম ইউনির্ভাসিটি। এছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনির্ভাসিটি ২০১৬ সালে যাত্রা শুরু করেছে। বঙ্গবন্ধু এভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস ইউনির্ভাসিটি প্রতিষ্ঠা বিল ২০১৯ সালের ২  ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে পাস হয়। বর্তমানে বাংলাদেশ তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে এক বিকাশমান দেশ। অদূর ভবিষ্যতে এর র‌্যাংকিং আরও উচ্চমানে উন্নীত করা এবং তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবস্থাকে আরও বেশি গতিশীল করার পর্যাপ্ত সুযোগ রয়েছে।

তবে আন্তর্জাতিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিংয়ের বিষয়ে বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কোনো অবস্থান সৃষ্টি করতে পারেনি। এমনকি র‌্যাংকিং আপগ্রেড করার জন্য যথোপযুক্ত মেথোডলজি তৈরি করা সম্ভব হয়নি। এই প্রস্তাবটি প্রথমবারের মতো একটি প্রাথমিক কাঠামোর অবতারণা করেছে, যা যেকোনো র‌্যাংকিং পদ্ধতির জন্য ব্যবহারোপযোগী হতে পারে এবং উচ্চশিক্ষার গুণগত পরিবর্তন আনতে পারে।  

লেখক
সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন

বাংলাদেশ সময়: ০১০১ ঘণ্টা, আগস্ট ২৩, ২০১৯
এমএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।