এডিস মশা ও ডেঙ্গি রোগের মোকাবিলা অনেকটা চ্যালেঞ্জিং হয়ে যাচ্ছে। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে ব্যক্তিগত সচেতনতা ও প্রোটেকশন যেমন গুরুত্বপূর্ণ তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো একটি সফল ও টেকসই নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা।
মশা নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ বলতে আমরা সিটি করপোরেশনকেই বুঝি। তবে মশা দমনের বিষয়টা এই একক কর্তৃপক্ষ যেভাবে দেখছে বা সার্বিকভাবে যেভাবে দেখা হচ্ছে তাতে সফল ও টেকসই মশা নিয়ন্ত্রণ সম্ভবপর হবে বলে মনে হয় না। এ নিয়ে নতুনকরে চিন্তা করা দরকার।
মশার উৎপাত বা ডেঙ্গু/চিকুনগুনিয়া রোগীর সংখ্যা বাড়লে অন্যত্র এক্সর্পাট না খুঁজে নিজেদের স্বাবলম্বী হওয়া প্রয়োজন। মশা দমন খাতে আমরা অনেক টাকা খরচ করছি কিন্তু সুফল পাচ্ছি না। তাই মশা দমনের বিষয়টাকে আলাদা নজর দিয়ে দক্ষ লোকবলের সমন্বয়ে যুগোপযোগী, গবেষণাভিত্তিক ও প্রযুক্তি নির্ভর ইউনিট হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চিন্তা করা দরকার।
এ ব্যাপারে মশার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দেশে-বিদেশে যারা কাজ করেছে তাদের অভিজ্ঞতা নিতে হবে। যে করেই হোক আমাদের প্রয়োজন একটি সফল ও টেকসই মশা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা।
মশা দমনে কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতা লক্ষণীয়। তাদের জনসচেতনতা বৃদ্ধির প্রচেষ্টাও চোখে পড়ার মতো। তবে এ কথাও সত্য যে, আমাদের দমন কার্যক্রম প্রধানত কীটনাশক স্প্রেইং/ফগিং এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে দেখা যায়।
উল্লেখ্য, মশার কার্যকর দমনের জন্যে বেশ কিছু বিষয় আগাম জানার জন্যে গবেষণা অতীব জরুরি। যেমন- এলাকাভিত্তিক মশার উপস্থিতি/আধিক্য, মশার রেজিসটেন্স লেভেল, কীটনাশকের কার্যকারিতা ইত্যাদি। আর সেই জায়গাটাতেই আমরা কম গুরুত্ব দিচ্ছি। নির্ভর করছি অন্যন্য প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর, আইসিডিডিআর’বি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ইত্যাদি) ওপর।
আমাদের মশকনিধন কার্যক্রম মোটেও গবেষণা নির্ভর নয়। আবার দেশে মশা নিয়ে যতটুকু গবেষণা হচ্ছে তার বেশিরভাগই ব্যক্তিগত আগ্রহ ও উদ্যোগে এবং তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। ফলে গবেষণালব্ধ তথ্য বাস্তবে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। তাই আমরা কীটনাশক প্রয়োগ করছি কিন্তু মশা কিছুতেই আমাদের নিয়ন্ত্রণে আসছে না।
মনে রাখতে হবে, মশা নিয়ে নিয়মিত/রুটিন মাফিক গবেষণা, সঠিক দমন পদ্ধতি (কীটনাশক বা জৈবনাশক) বাছাই ইত্যাদি ছাড়া মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যকর ও টেকসই হবে না। তাই মশার সফল নিয়ন্ত্রণে কয়েকটা বিষয়ে জোর দেওয়া জরুরি।
১. মশা নিয়ন্ত্রণ (অপারেশন) ইউনিট আধুনিকায়ন
মশা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে আরো শক্তিশালী তথা আধুনিক করতে হবে। মশার বায়োলজি ও কীটনাশক সর্ম্পকে যথাযথ জ্ঞান সম্পন্ন ও দক্ষ লোকের দ্বারা পরিচালিত করতে হবে। অপারেশন টিমকে/টেকনেশিয়ানেকে কীটনাশক প্রয়োগে যথাযথ ট্রেইনিং দিতে হবে। কীটনাশকের (এডাল্টিসাইড ও লার্ভিসাইড) সঠিক ব্যবহার বিধি জানতে হবে। ফগার মেশিন ছাড়াও নতুন নতুন মেশিন (ইউএলবি স্প্রেয়ার) যোগ করতে হবে। কীটনাশক বাছাইয়ে আরো সর্তক হতে হবে। একই ধরনের কীটনাশক ব্যাবহার পরিহার করতে হবে।
প্রয়োগ তালিকায় নতুন ও কার্যকর এডাল্টিসাইড ও লার্ভিসাইড যোগ করতে হবে। কীটনাশক যাতে কোনো ভেজাল না থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে। কীটনাশকের ভুল প্রয়োগ/অতিপ্রয়োগ চলবে না। এ ব্যাপারে আরো সচেতন হতে হবে। এডিসসহ অন্যান্য মশা (কিউলেক্স, এনোফিলিস ইত্যাদি) শনাক্তকরণ পাশাপাশি, টার্গেট ও নন- টার্গেটস প্রজাতির রক্ষারও ব্যবস্থা নিতে হবে।
২. মশা নিধনে গবেষণা পরিচালনা
সফল ও টেকসই মশা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা অনেকটা গবেষণা নির্ভর হয়। ভেক্টর ম্যাপিং অর্থাৎ মশার স্থায়ী ও অস্থায়ী প্রজনন কেন্দ্র, পরিণত মশার উপস্থিতি/আধিক্য চিহ্নিত করতে হবে। কিছু বেসিক বিষয়ে গবেষণা। যেমন- মশারা সত্যিই কীটনাশক প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে কিনা? কোন প্রজাতির মশা কোথায় কী পরিমাণ প্রতিরোধী হয়েছে? কীটনাশকের রিকমেন্ডেড ডোজ পরীক্ষাকরণ ইত্যাদি সব সময় পরিচালনা করতে হবে।
মশা দমনে গুরুত্বপূর্ণ একটা গবেষণার বিষয় হচ্ছে- মশার সারভিলেন্স। এডিসসহ অন্যান্য মশার (এডাল্ট এবং লার্ভা) সারভিলেন্স কার্যক্রম নিয়মিত (সারা বছর) পরিচালনা করতে হবে এবং তা মনিটরিং করতে হবে। অভি ট্র্যাপ (ডিম সংগ্রহের জন্য) ব্যবহার করে বিভিন্ন প্রজাতির মশার উপস্থিতি জানা যেতে পারে। বিভিন্ন এলাকায় জমানো পানিতে লার্ভার উপস্থিতি নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে। হোস্ট-সিকিং মশা (মানুষ বা প্রাণীদের কামড়ায়) ও এগ-লেইং মশা (ডিম পারা মশা) ধরার জন্য বিভিন্ন ট্র্যাপ (মশা ধরার ফাঁদ) যেমন- লাইট ট্র্যাপ, বিজি ট্র্যাপ, গ্র্যাভিড ট্র্যাপ ব্যাবহার করা যেতে পারে। এতে কোন এরিয়ায় কি কি প্রজাতির মশা রয়েছে, এদের আধিক্য কেমন, এমনকি কোথাও জিবানুবাহী মশা আছে কিনা (ভাইরাস সারভিলেন্স) তাও জানা যাবে।
জীবাণুবাহী মশা শনাক্তে আরবোভাইরাল টেস্ট করতে হবে। নিয়মিত সারভিলেন্স করে কোথায় কোন প্রজাতির মশা আছে তা জেনে নির্দিষ্ট কীটনাশক (ডোজসহ) প্রয়োগে সুপারিশ করতে হবে। কীটনাশক (এডাল্টিসাইড ও লার্ভিসাইড) নির্বাচন করার আগে তা প্রথমে ল্যাব টেস্ট (টক্সিসিটি বায়োঅ্যাসে) করতে হবে।
৩. মশা দমনে নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার
মশা নিয়ন্ত্রণে বর্তমানে কীটনাশকের (এডাল্টিসাইড ও লার্ভিসাইড) পাশাপশি জৈবপ্রযুক্তি নির্ভর ওলবাকিয়া ব্যাকটেরিয়ার (স্ত্রী মশার উর্বর ডিম উৎপাদন ব্যহত করে) ব্যবহার কার্যকর হয়ে উঠছে। চীন, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা, ম্যালেশিয়াসহ অনেক দেশে এর সফল কার্যক্রম চলছে। তাছাড়া বর্তমানে মেল স্টেরাইল টেকনিক (মশাদের মেটিং হবে কিন্তু ডিম উৎপাদন হবে না) পদ্ধতির সফল ব্যবহার দেখা যাচ্ছে।
৪. জনসচেতনতা বৃদ্ধির জোড়ালো পদক্ষেপ
এডিস একটি ঘরোয়া মশা, এরা বসতবাড়িতে বা এর আশেপাশে বংশবিস্তার ও উড়তেই অভ্যস্ত। তাই ব্যক্তিগত প্রোটেকশন ও সচেতনতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যেককে এডিস মশা সর্ম্পকে যথাযথ জ্ঞান রাখতে হবে। তবে জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে কর্তৃপক্ষের চেষ্টা জোড়ালো আছে বলা যায়। তাছাড়া বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভিজিট করে মশার প্রজাতি, মশার জীবন-চক্র, জীবাণু-রোগ সম্পর্কে অবিহিত করা যেতে পারে। সচেতনতা বৃদ্ধিতে সচেতনতা সপ্তাহ, ওপেন ডে ইত্যাদি পালন করা যেতে পারে।
লেখক: সায়েন্টিস্ট, এনাসটাসিয়া মসকিটো কন্ট্রোল, সেন্ট অগাস্টিন, ফ্লোরিডা, আমেরিকা।
ভিজিটিং শিক্ষক, ইউনিভার্সিটি সায়েন্স মালেশিয়া, পেনাং, মালেয়শিয়া
ও সহযোগী অধ্যাপক (ডেপুটেশন), কীটতত্ত্ব বিভাগ, পবিপ্রবি, বাংলাদেশ
ই-মেইল: mamiah81@yahoo.com
বাংলাদেশ সময়: ১৮০৮ ঘণ্টা, আগস্ট ২৯, ২০১৯
এমএ/