কয়েকটি প্রশ্নের উত্তরের আলোকেই আমি এই বিতর্কের বিস্তারিত জবাবটা দিতে চাই। আমাদের জাতীয় সংগীত হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা’ কেন পরিবর্তন হবে না বা থাকা কতটুকু যৌক্তিক? এ প্রশ্নের আলোকে তারা যে যুক্তিগুলো উপস্থাপন করেন তা হলো—
১. আমাদের জাতীয় সংগীত গগন হরকরার ‘আমি কোথায় পাব তারে’ গানের সুর থেকে নকল করে নেওয়া।
এ বক্তব্যগুলোর বিপরীতে ইতিহাস কী বলছে?
১। প্রথমেই আসি গগন হরকরার ‘আমি কোথায় পাব তারে’ গানের প্রসঙ্গে এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিরুদ্ধে গগন হরকরার সুর নকলের অভিযোগে। গগন হরকরার বিষয়টি অনেক আগে থেকেই ব্যাপকভাবে জ্ঞাত ও মীমাংসিত। মূলত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাউল পত্রিকায় এই গানটি (জাতীয় সংগীত) ছাপিয়েছিলেন। এবং তিনি স্পষ্ট করেই উচ্চারণ করেছিলেন, এই গানের সুর বাউলগান থেকে নেওয়া। কেননা গগন হরকরার সুর মৌলিক কোনো সুর ছিল না। এর পুরোটাই ছিল বাউল টিউন। আরেকটি তথ্য দিয়ে রাখি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই প্রথম ব্যক্তি, যিনি সাময়িক পত্রিকায় গগন হরকরার সেই গানের বাণী প্রকাশ করেছিলেন, যে সুর নকল করে আপনি অন্য গান রচনা করবেন, নিশ্চয়ই সেই সুরকে ফলাও করে প্রচার করবেন না। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যদি নকল করার ন্যূনতম উদ্দেশ্য থাকত, তবে সাময়িকীতে নিশ্চয়ই গগন হরকরার গানের লাইন আনতেন না, গগন হরকরাকে প্রকাশ্যে এনে সবার সামনে পরিচয় করিয়ে দিতেন না।
প্রসঙ্গত একটি বিষয় বলি, গগন হরকরার ‘আমার মনের মানুষ যে রে, আমি কোথায় পাব তারে’ অবলম্বনে যে আমাদের জাতীয় সংগীত রচিত, এ তথ্য আমি ক্লাস সেভেনের রচনা বইয়ে প্রথম পাই। এটি তো মীমাংসিত বিষয়। কিন্তু এই গানকে কেন্দ্র করে যারা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ‘লেখা-চোর’ বা ‘সুর-চোর’ বানানোর মতো সাহিত্যের জগতে ‘আপেক্ষিক তত্ত্ব’ আবিষ্কার করছেন তাদের জন্য করুণা হয়।
২। এবার আসি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা প্রসঙ্গে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর—এ ধরনের একটি অভিযোগ প্রায়ই অনেকে করে থাকেন। তারা উল্লেখ করেন, ‘১৯১২ সালের ২৮ মার্চ কলকাতা গড়ের মাঠে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিবাদে এক বিশাল জনসভার আয়োজন করা হয়। ’ অনেকেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই জনসভার রেফারেন্স হিসেবে দিয়েছেন নীরদচন্দ্র চৌধুরীর লেখা বই, আবার অনেকেই আবুল আসাদের ‘একশো বছরের রাজনীতি’ বইয়ের রেফারেন্সও দিয়েছেন। যদিও নীরদচন্দ্র চৌধুরীর বইয়ে এমন কিছু উল্লেখ নেই, আবার আবুল আসাদ কোনো তথ্য-উপাত্ত ছাড়াই এ অভিযোগটি করেছেন। তারই ধারাবাহিকতায় ২০০০ সালে আহমদ পাবলিশিং হাউস থেকে ‘আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ধারাবাহিকতা এবং প্রাসঙ্গিক কিছু কথা’ নামে একটি বইয়ে মেজর জেনারেল (অব.) এম এ মতিন, কপি পেস্টের মাধ্যমে একই কথা উল্লেখ করেন কোনো তথ্য-উপাত্ত ছাড়াই। এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কালি ও কলম পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর অন্যতম সদস্য এ জেড এম আবদুল আলী একটি পত্রিকায় অভিযোগটির বিরোধিতা করেন। তিনি বলেন, যারা রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে এ অভিযোগটি করছেন, তারা তাদের রচনায় কোনো সূত্রের উল্লেখ করেননি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করেছেন প্রফেসর রফিকুল ইসলাম। তিনি ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশি বছর’ নামে বই লিখেছেন। সেই বইয়ের কোথাও রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ পাওয়া যায় না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গীতিআরা নাসরীন জানাচ্ছেন, রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে এই অপপ্রচারের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট বার্ষিক অধিবেশনের (২৮-২৯ জুন, ২০১১) আলোচনায় আসে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে দেওয়া এই তথ্য যে সম্পূর্ণ মিথ্যা, সে ব্যাপারে বিস্তারিত উল্লেখ আছে কার্যবিবরণীর ১৭৮ নং পৃষ্ঠায়।
এবার আসুন ১৯১২ সালের ২৮ মার্চের সমাবেশের দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক। মূলত ওই তারিখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সমাবেশে উপস্থিত তো দূরের কথা, তিনি কলকাতায়ই ছিলেন না। ১৯১২ সালের ২৮ মার্চ রবীন্দ্রনাথ ছিলেন শিলাইদহে। ১৯ মার্চ ১৯১২ (৬ চৈত্র, ১৩১৮ বঙ্গাব্দ) ভোরে কলকাতা থেকে সিটি অব প্যারিস জাহাজে রবীন্দ্রনাথের ইংল্যান্ড যাত্রার জন্য কেবিন ভাড়া করা হয়েছিল। তার মালপত্রও জাহাজে উঠেছিল। সেদিন সকালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অসুস্থ হয়ে পড়েন। ফলে তার ইংল্যান্ড যাত্রা স্থগিত হয়ে যায়। রবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘পিতৃস্মৃতি’ গ্রন্থেও এই অসুস্থতার বিশদ বিবরণ দিয়েছেন। আকস্মিকভাবে যাত্রা পণ্ড হয়ে যাওয়ায় খুব বেদনা পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ২৪ মার্চ ১৯১২ তারিখে (১১ চৈত্র ১৩১৮ বঙ্গাব্দ) বিশ্রামের উদ্দেশ্যে রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে রওয়ানা হন। তার প্রমাণ পাওয়া যায় ঠাকুরবাড়ির ক্যাশবহিতে। সেখানে লেখা আছে, শ্রীযুক্ত রবীন্দ্র বাবু মহাশয় ও শ্রীযুক্ত রথীন্দ্র বাবু মহাশয় এবং শ্রীমতী বধুমাতা ঠাকুরাণী সিলাইদহ গমনের ব্যয় ৩৭৯ নং ভাউচার ১১ চৈত্র ১৫। । ৩।
১৯১২ সালের ২৮ মার্চ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পুত্রকন্যাদের গৃহশিক্ষক ও শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মচর্যাশ্রমের শিক্ষক জগদানন্দ রায়কে এক চিঠি লেখেন। রবীন্দ্রনাথ চিঠিটি লিখেছেন শিলাইদহ থেকে, যার প্রমাণ পাওয়া যায় পত্রের নিচেও।
কবিগুরু যে ২৮ মার্চ কলকাতায় ছিলেন না, তার বড় প্রমাণ হলো প্রশান্তকুমার পাল রচিত ‘রবিজীবনী’ গ্রন্থ। গ্রন্থের ষষ্ঠ খণ্ডে উল্লেখ আছে, ‘এরপর বাকী ১৫ দিনে শিলাইদহে থেকে রবীন্দ্রনাথ আরও ১৭টি কবিতা বা গান লেখেন এবং ১২ এপ্রিল তিনি শিলাইদহ থেকে কোলকাতায় রওনা হন। এর মধ্যে একটি গান আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ। ১৪ চৈত্র, ১৩১৮ বঙ্গাব্দ। রচনার স্থান শিলাইদহ। ২৬শে চৈত্র ১৩১৮ (এপ্রিল ৮, ১৯১২) বঙ্গাব্দেও তিনি শিলাইদহে। ’
যারা এই প্রপাগান্ডাটা করছেন, তারা কি একবারও ভাবেন না যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করলে নিশ্চয়ই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে প্রতিষ্ঠার পাঁচ বছরের মধ্যেই ভাষণ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ করা হতো না। ১৯৩৬ সালে তাকে ডি.লিট উপাধি প্রদানের বিষয়েও বিরোধিতা হতো; বরং তাকে দুবারই মুসলমান-হিন্দু সব শ্রেণির ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান আন্তরিকভাবে সম্মাননা প্রদান করেছে।
৩। এবার আসি বঙ্গভঙ্গ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিন্তা-চেতনার জায়গায়। বঙ্গভঙ্গের ঘটনার সঙ্গে বাংলাদেশ চেতনার কোনো সম্পর্কই নেই। ইংরেজরা যখন ডিভাইড অ্যান্ড রুল-এর নীতিতে বঙ্গভঙ্গ করল, তখন দুই বঙ্গের অনেক মুক্তমনা এই বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করেছিল এই কারণে যে প্রথমত ইংরেজরা প্রথমবারের মতো সাফল্যের সঙ্গে হিন্দু-মুসলিমে বিভেদ টানতে সক্ষম হয়, যা স্পষ্ট হয় পরবর্তী দাঙ্গায়, নজরুলসহ অনেকের লেখনীতে এই দাঙ্গাবিরোধী বক্তব্য পাবেন। তাই যারা ধর্মকেন্দ্রিক সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিপক্ষে ছিল, তারা বঙ্গভঙ্গকে সমর্থন জানায়নি। ১৯০৫ সালের প্রেক্ষাপটকে যদি একবিংশ শতাব্দীতে এনে স্থান-কাল-পাত্র না বুঝে সমালোচনা করা হয়, তবে তা নিতান্তই হাস্যকর।
৪। এবার আসি বাংলা ও বাঙালির আবেগ নিয়ে। জাতীয় সংগীতের আবেগ-অনুভূতি নিয়ে প্রশ্ন তোলার আগে আমাদের জানা উচিত মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে। জানা উচিত মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধে দেশের সূর্যসন্তানদের কী অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে এই গান। মাথায় রাখতে হবে, বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দীন, সৈয়দ নজরুলদের হাত ধরে এই দেশ ও জাতীয় সংগীত। তাই জাতীয় সংগীতকে নিয়ে প্রশ্ন তোলার মানে হলো তাদের বুদ্ধি, প্রজ্ঞা আর সাহসের দিকে আঙুল তোলা, তাদের আবেগ, ভালোবাসা আর দেশপ্রেমকে প্রশ্নবিদ্ধ করা।
সবশেষে বলবো, নতুন এই বিতর্কের মাধ্যমে বাংলাদেশের ধর্মান্ধ ও মৌলবাদী গোষ্ঠী, যারা মুক্তমন ও ধ্যান-ধারণা থেকে হাজার বছর পিছিয়ে, তারা জাতীয় সংগীত ও রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার মতো নতুন রসদ পেয়েছে মাত্র, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। মূলত এটা জাতীয় সংগীত বিরোধিতা নয়, রবীন্দ্র বিরোধিতা। ধর্মের মোড়কে সমাজকে বাঁধতে চাওয়া মানুষের সৃষ্টি করা বিতর্ক, যা শুরু হয়েছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বহু আগেই। একদিকে মৌলবাদী গোষ্ঠী প্রগতির আলো বন্ধ করতে চাইছে, অন্যদিকে আরও বেশি আলো নিয়ে সমহিমায় ভাস্বর হচ্ছে আমার প্রাণের জাতীয় সংগীত। বিবিসির শ্রোতা জরিপে সর্বকালের সেরা বাংলা গান হয়েছে ‘আমার সোনার বাংলা’। শুধু আমরা নই, বিশ্ববাসীও এর স্বীকৃতি দিয়েছে। অলিম্পিকে বাজানো সব দেশের জাতীয় সংগীতের একটা র্যাংকিং করা হয়েছিল, যেখানে ‘আমার সোনার বাংলা’ পৃথিবীর তাবত জাতীয সংগীতকে পেছনে ফেলে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে। জাতীয় সংগীতের এক লাইন দিয়েই শেষ করছি আজকের লেখা, কবিগুরু বলেছিলেন, তোমার বদনখানি মলিন হলে আমি নয়ন জলে ভাসি। এসব কূপমণ্ডূকদের জাতীয় সংগীত অপমানে নয়ন জলে ভাসা আমাদের একটাই প্রশ্ন, কী হবে এই বিভ্রান্ত প্রজন্মের?
লেখক: চেয়ারম্যান, সুচিন্তা ফাউন্ডেশন
বাংলাদেশ সময়: ২২১৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ০২, ২০১৯
এইচএ/