ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুরাও সমাজের সম্পদ হতে পারে

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৪৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ২, ২০২০
অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুরাও সমাজের সম্পদ হতে পারে

অটিজম বা অটিস্টিক; বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে একটি বহুল আলোচিত শব্দ। শহর থেকে গ্রাম-সব জায়গাতেই এখন কম-বেশি মানুষ এই শব্দের সঙ্গে পরিচিত। অটিজম সাধারণত বংশগত বা মানসিক রোগ নয়, এটা স্নায়ুগত বা মনোবিকাশজনিত সমস্যা। এ সমস্যাকে ইংরেজিতে ‘নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার’ বলা হয়ে থাকে।

আমাদের সমাজে অনেক ব্যক্তি বা পরিবার রয়েছেন যাদের অটিজমে আক্রান্ত শিশু রয়েছে। এই শিশুরা আমাদের সমাজেরই অংশ।

প্রয়োজনীয় পরিচর্যা ও সুযোগ পেলে তারাই পরিণত হবে সম্পদে।

তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে অটিজমকে অনেকেই রোগ বলে অভিহিত করেন। অনেকেই এখনও অটিস্টিক শিশু দেখলে তাদের ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে থাকেন, তাদের বাবা-মাকে নিয়ে নানাভাবে কুসংস্কারের বলি করা হয়। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে এটা প্রকট! কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে এসে এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়।  

বর্তমানে অটিজম নিয়ে বাংলাদেশ তথা বিশ্বজুড়েই নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। সবার মধ্যে বেড়েছে সচেতনতা। বাংলাদেশেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায়, অটিজম আক্রান্তরা নানাভাবে ভূমিকা রেখে চলেছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকৃতপক্ষে অটিজম কোনো রোগ নয়। এটি একটি শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশজনিত সমস্যা। শিশুর জন্মের প্রথম দুই-তিন বছরের মধ্যেই এর লক্ষণ প্রকাশ পায়। অটিজম এমন একটি বিকাশজনিত সমস্যা, যা হলে আক্রান্ত ব্যক্তির অন্য মানুষ বা বিষয়ের প্রতি কোনো আগ্রহ থাকে না। এছাড়া সামাজিক মিথস্ক্রিয়া, ভাষা, আবেগীয় বিষয়গুলোও পরিলক্ষিত হয় না।

এর মানে এই নয় যে, অটিস্টিক শিশু বোকা কিংবা অমেধাবী। মোটামুটি বেশিরভাগ অটিস্টিক শিশু অত্যন্ত সম্ভাবনাময় হয়। প্রতি ১০ জন অটিস্টিক শিশুর মধ্যে একজনের ছবি আঁকায়, গানে, গণিতে বা কম্পিউটারে খুবই দক্ষতা থাকে। অটিস্টিক শিশুকে ঠিকমতো পরিচর্যা করতে পারলে পরবর্তীতে সে অনেক গুণী কেউ একজন হয়ে উঠতে পারে। এখন তারাও সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখেন।

তাই বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, কোনো শিশুর অটিজম নির্ণয় হলে অতিদ্রুত ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে। পাশাপাশি পরিবারের সবার সচেতনতাও বৃদ্ধি করতে হবে। শিশুটির সঙ্গে কথা বলার মাঝে, পড়ানোর সময়, সামাজিক বন্ধনে, খেলা-ধুলার মাঝেও বিভিন্ন বিষয় শেখাতে হবে। হাসি-খুশিতে রাখতে হবে সব সময়।

অটিস্টিক শিশুরা স্কুল-কলেজ এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়াশোনা করে সফলতা পেয়েছেন। কেউ কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়েও ভালো করছেন, অনেকেই পটু হন গণিতে। এছাড়া তারা বিভিন্ন সফটওয়্যার ব্যবহার করে কম্পিউটার, ইন্টারনেটেও অন্য সবার মতোই সমান পারদর্শিতার সঙ্গে কাজ করতে সক্ষম।

বিখ্যাত সংগীতশিল্পী লেডি হাক এবং ডারিল হান্না, কার্টুন ছবির আবিষ্কারক সাতসি তাহেরিসহ অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিও অটিজমে আক্রান্ত ছিলেন।

এক্ষেত্রে প্রতিবন্ধীবান্ধব সফটওয়্যার, অডিও-ভিডিও শিক্ষা উপকরণ, অবকাঠামো, প্রযুক্তি উদ্ভাবনসহ তথ্যকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।

চিকিৎসাবিজ্ঞানের তথ্য অনুযায়ী, মায়ের গর্ভাবস্থায় নিয়মিত চিকিৎসা ও ওষুধ সেবন করা না হলে কিংবা প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাবার না খেলে গর্ভের শিশুদের পূর্ণাঙ্গ বিকাশ না হলে অটিস্টিক শিশুর জন্ম হতে পারে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ জানান, অটিজম কোনো রোগ-ব্যাধি নয়। এটি জন্মগত স্নায়ুবিক দুর্বলতা। শিশুর জন্মের ২-৩ বছর বয়সের মধ্যে এটির প্রকাশ ঘটে। হাঁটাচলা, আচার-আচরণে অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করা যায়।

‘আগে অনেকে অটিজম আক্রান্ত শিশুর অস্বাভাবিক আচরণ দেখে পাগল বলে মনে করতেন। কিন্তু এখন চিকিৎসক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ এ বিষয়ে ওয়াকিবহাল। তাই অটিজম আক্রান্ত শিশুদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা যায়। ’

একটা বিষয় আবার বলে নেওয়া ভালো, এই শিশুরা পরিবার ও সমাজের বোঝা নয়। প্রতিবন্ধীরা যেমন বিশেষভাবে সক্ষম। অটিজমেরা শিশুদেরও সঠিক প্রশিক্ষণ দিলে তারা সমাজের কর্মক্ষম ব্যক্তি হিসেবে সম্পদ হয়ে ওঠে।

অটিস্টিক শিশুর মধ্যে কোনো না কোনো প্রতিভা বা বিশেষ গুণ লুকিয়ে আছে। নিবিড় পরিচর্যা করলে তারা সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে। একই সঙ্গে তাদের সুপ্ত গুণাবলীও প্রকাশ পায়। তাই অটিজম শিশুদের প্রতি সর্বদা মমতা ও স্নেহের পরশ বুলিয়ে দিতে হবে।

তথ্যমতে, দেশে অটিস্টিক শিশুর সংখ্যা আনুমানিক দেড় লাখ (সূত্র: সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়)। দেশের সর্বশেষ আদমশুমারি অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৯ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ প্রতিবন্ধী। আন্তর্জাতিকভাবে কোনো দেশের মোট প্রতিবন্ধীর ১ শতাংশকে অটিজমের শিকার বলে ধরে নেওয়া হয়।

সূত্রমতে, ২০১৩-২০১৬ সালে দেশে অটিস্টিক শিশুর সংখ্যা ৪১ হাজার ৩২৯ (সূত্র: প্রতিবন্ধী শনাক্তকরণ জরিপ, সমাজসেবা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইট)। চলতি বছরে তা আরও বেড়েছে। এদিকে বেশ কিছুদিন আগে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক জরিপে বলা হয়েছে, ঢাকা শহরে অটিস্টিক শিশুর হার ৩ শতাংশ আর ঢাকার বাইরে দশমিক ৭ শতাংশ।

বাংলাদেশে দিন দিন অটিজম আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা বাড়ছে। তবে যে হারে বাড়ছে, সেই অনুপাতে তাদের জন্য স্কুলের সংখ্যা অপর্যাপ্ত। ঢাকার বাইরের জেলা শহরগুলোতে শিশুদের শিক্ষার কোনো সুযোগ নেই বললেই চলে। গুটিকয়েক স্কুলের শিক্ষাব্যবস্থা অত্যন্ত ব্যয়বহুল।

সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও সমাজকল্যাণ অধিদপ্তর বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে, অটিজম  শিশুদের কল্যাণে। অটিজম শিশুদের উন্নয়নে বাংলাদেশে অগ্রদূত হিসেবে কাজ করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মেয়ে সায়মা ওযাজেদ হোসেন পুতুল।  

ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি নিয়ে বিদেশে উচ্চশিক্ষাগ্রহণ করেছেন তিনি। উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে অটিজম বিষয়ে আন্তর্জাতিকভাবে তিনি কাজ করে চলেছেন।

অটিজম ও নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার সম্পর্কিত জাতীয় উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারপারসন সায়মা ওয়াজেদ বিশ্বজুড়ে তার কাজের স্বীকৃতিও পেয়েছেন।  

২০১৯ সালে বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সৃষ্টিশীল নারী নেতৃত্বের ১০০ জনের তালিকায় স্থান করে নেন সায়মা ওয়াজেদ। দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মানসিক স্বাস্থ্যসম্পর্কিত ২৫ সদস্যবিশিষ্ট বিশেষজ্ঞ উপদেষ্টা প্যানেলের একজন সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।

তার উদ্যোগেই ২০১১ সালের জুলাইয়ে ঢাকায় অটিজম নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ওই সম্মেলনের পর গড়ে ওঠে সাউথ এশিয়ান অটিজম নেটওয়ার্ক। সংগঠনটি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে অটিস্টিক শিশুদের স্বাস্থ্য, সামাজিক ও শিক্ষা সহায়তা দেওয়ার জন্য অবকাঠামো গড়তে কাজ করে চলেছে।

তার উদ্যোগেই অটিজম সচেতনতায় বাংলাদেশের একটি প্রস্তাব বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার নির্বাহী পরিষদে সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়।

আজ ০২ এপ্রিল। বিশ্বজুড়ে দিনটি পালিত হয় বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস হিসেবে। অটিজম বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ২০০৮ সাল থেকে বেশ ঘটা করে দিনটি পালিত হয়ে আসছে।  

রাজধানী ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় নানা অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়। তবে বৈশ্বিক মহামারি নভেল করোনা ভাইরাসের (কোভিড-১৯) প্রাদুর্ভাবের কারণে জনসমাগম হয় এমন সব অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়েছে।

এদিকে দুনিয়া কাঁপানো করোনা ভাইরাস অটিজম আক্রান্ত শিশুদের জন্যও নতুন একটা সঙ্কট। কেননা অটিজম শিশুদের এখন ঘরেই থাকতে হচ্ছে। এ অবস্থায় কোথায়ও বের হওয়া সম্ভব নয়। তাদের স্কুলেও যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

এ অবস্থায় শিশুদের নানা বিষয়ে শেখানোর পাশাপাশি মানসিক বিকাশেও ভূমিকা রাখতে পারেন অভিভাবকেরা। আমাদের সবাইকে অটিজম শিশুদের ভালোবাসতে হবে। কোনো অন্যায় আচরণ না করে স্বাভাবিক শিশুর পাশাপাশি তাদের সব ক্ষেত্রে অধিকার দেওয়া বাঞ্ছনীয়। তাদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে সমাজ ও পরিবার গঠনে সচেষ্ট হতে হবে।

যেহেতু অটিজম চিকিৎসায় এখনও বিশেষ কোনো ওষুধ আবিষ্কার হয়নি। অটিস্টিক শিশুদের সুস্থ বিকাশে প্রয়োজন প্রশিক্ষণ, সহযোগিতা ও সহমর্মিতা। বাংলাদেশেও এখন সরকারিভাবে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

অটিজম চিকিৎসা ও পরিচর্যা বিষয়ে ডা. আব্দুল্লাহ বলেন, অটিজম ডায়াগনস্টিক চেকলিস্ট (এডিসিএল), এমচার্ট ও এডোস প্রধানত এ তিনটি পরীক্ষার মাধ্যমে অটিজম আক্রান্ত শিশুদের শনাক্ত করা হয়।

মৃদু, মাঝারি ও গুরুতর সমস্যাকে বিবেচনায় নিয়ে শিশুর মনস্তত্ত্ব বিকাশে কাজ করা হয়। স্পিস থেরাপি. সাইকোলজিক্যাল ম্যানেজমেন্ট থেরাপিসহ বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মাধ্যমে শিশুদের চিকিৎসা করা হয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে 'সেন্টার ফর নিউরো ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড অটিজম ইন সেন্টার' নামে আলাদা একটি ইউনিটে অটিস্টিকদের চিকিৎসা দেওয়া হয়। এ ছাড়া সরকারি হাসপাতালের বিভিন্ন ইউনিট ও বেসরকারি পর্যায়ে অটিজমের চিকিৎসা ও কাউন্সিলিং ব্যবস্থা চালু আছে।

বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশেও যাতে এই শিশুরা নিজেদের সম্ভাবনা পুরোপুরি মেলে ধরতে পারে সেজন্য তাদের সহযোগিতা করা; যা টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ২০৩০ এর মূল প্রতিশ্রুতি।

আমরাও ‘কাউকেই পেছনে ফেলে না রেখে’ হাতে হাত রেখে এগিয়ে যেতে চাই। এ অবস্থায়, আমরা অটিজমে আক্রান্ত ব্যক্তিদের পূর্ণ অংশগ্রহণের এবং তাদের অধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতাসমূহের অনুশীলনের প্রয়োজনীয় উপকরণগুলোর নিশ্চয়তার লক্ষ্যে এগিয়ে যাই। তবেই গড়ে উঠবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা।

অধ্যাপক ড. সৈয়দ সামসুদ্দিন আহমেদ
লেখক: উপাচার্য, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ওপ্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জামালপুর; নির্বাহী সদস্য, তরী ফাউন্ডেশন।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।