ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় পুলিশের ভূমিকা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৫৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ৩, ২০২০
করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় পুলিশের ভূমিকা মো. সাখাওয়াত হোসেন

আপনি ঘরে থাকুন, দোকানই যাবে আপনার ঘরে- এ স্লোগানকে সামনে রেখে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ করোনা ভাইরাসের ভয়াবহতায় বাসায় অবস্থান করা মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে এবং পুলিশের সেবা পেয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে নগরের বাসিন্দারা।

একটি উদাহরণের মাধ্যমেই পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, সীমাবদ্ধতা থাকা স্বত্ত্বেও সারা বাংলাদেশে করোনা প্রতিরোধের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পুলিশের কাজ করার বিভিন্ন ধরনের সুযোগ রয়েছে। পরিস্থিতি এবং পারিপার্শ্বিকতা বিবেচনায় হয়তো সব জায়গায় পুলিশের পক্ষে সর্বোচ্চ সেবা প্রদান করা সম্ভব নয়।

তবে ইচ্ছা এবং সামর্থের কমতি রাখা যাবে না কোনভাবেই। কেননা কোয়ারেন্টাইন এবং আইসোলেশনে অনভ্যস্ত বাঙালি জাতিকে করোনা প্রতিরোধে সার্বক্ষণিক ঘরে রাখা চারটিখানি কথা নয়।

কাজেই, বাংলাদেশ পুলিশকে যেমনিভাবে জনগণকে ঘরে রাখার কাজটি সুচারুরূপে সম্পন্ন করতে হবে ঠিক তেমনিভাবে ঘরে থেকেই যেন জনগণ প্রয়োজনীয় সব ধরনের সাহায্য সহযোগিতা পায় সে বিষয়টিও পুলিশকে নিশ্চিত করতে হবে।  

বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে করোনার প্রকোপ মোকাবেলা করার নিমিত্তে বিশ্বজুড়ে যে উদ্বেগ ও উৎকন্ঠা পরিলক্ষিত হচ্ছে, তা থেকে পরিত্রাণ পেতে দেশগুলো তাদের মতো করেই ব্যবস্থা গ্রহণের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। তবে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে সহযোগী সংস্থাগুলো পরামর্শ ও পরিস্থিতি বিবেচনায় বিবৃতি দিয়ে সাহায্য সহযোগিতা করে চলেছে। ইতোমধ্যে চীন, ইতালি, স্পেন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের উন্নত দেশসমূহ করোনার থাবায় শোচনীয় পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছে।

আইইডিসিআর এর প্রতিবেদনে জানা যায়, বাংলাদেশে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ৪৮ জন, করোনায় মৃত্যু হয়েছে ৫ জনের, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ২৭ জন, সুস্থ হয়ে বাড়িতে ফিরে গিয়েছেন ২৭ জন, প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে আছেন ৪৮ জন, হোম কোয়ারেন্টাইনে আছেন ২৩ হাজার জন এবং আইসোলেশনে রয়েছেন ৪৭ জন। উল্লেখিত দেশসমূহের অভিজ্ঞতা নিয়ে বাংলাদেশ পুলিশ তাদের পুলিশিং এর ক্ষেত্রে নতুন ও অভিনব বিষয়ের সংযোজনের মাধ্যমে করোনার থাবায় ভয়াবহতার মাত্রা ও মৃত্যুর হার কমিয়ে আনতে পারে। এ কথা স্বীকার করতেই হবে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হস্তক্ষেপে জনগণ মাস্ক পরিধান করা শুরু করেছে ও করোনার ক্ষয়ক্ষতি অনুধাবন করে ঘরমুখি হয়েছে।

মোটা দাগে বললে বলা যায়, বাংলাদেশ পুলিশ সাধারণত দু ধরনের কাজ করে থাকে। প্রথমত: অপরাধ প্রতিকার অর্থাৎ অপরাধ ঘটার পরে অপরাধীকে সনাক্তকরণে তদন্ত সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে জোরালো ভূমিকা পালন করে থাকে। দ্বিতীয়ত: অপরাধ প্রতিরোধ অর্থাৎ বিভিন্ন সোর্স থেকে প্রাপ্ত তথ্য পেয়ে অপরাধীকে অপরাধ প্রবণতা থেকে নিবৃত্ত করার প্রচেষ্টা। কিংবা এমন পরিবেশ তৈরি করা যার পরিপ্রেক্ষিতে অপরাধী অপরাধ করার দুঃসাহস দেখায় না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের কাজের পরিধি যদিও বেড়েছে তথাপি পুলিশ সাধারণত অপরাধ প্রতিকার এবং অপরাধ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে কাজ করে থাকে। ভিন্নভাবে বললে বলা হয়, পুলিশ স্বাভাবিকভাবে পুলিশিং এর ক্ষেত্রে প্রোঅ্যাকটিভ এবং রিঅ্যাকটিভ ভূমিকা পালন করে থাকে। রিঅ্যাকটিভ মানে ঘটনার পরে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে সামগ্রিক বিষয়াবলী যাচাই বাছাই করে অপরাধীকে সনাক্তকরণের ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা। প্রোঅ্যাকটিভ মানে পুলিশের ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকার পরিপ্রেক্ষিতে অপরাধীরা অন্যত্র পলায়ন করে কিংবা অপরাধ করার সাহস দেখায় না।

বাংলাদেশ নানাবিধ কারণে রিঅ্যাকটিভ পুলিশিং এর চর্চাই দেখা যায়। কিন্তু করোনা সংকট মোকাবেলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পুলিশকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে প্রোঅ্যাকটিভ পুলিশিং এর অনুশীলন করা উচিত।   

তবে করোনা প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার পূর্বে পুলিশ সদস্যদের প্রত্যেককে ব্যক্তিগত সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। সরকার সহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন থাকবে- পুলিশ সদস্যদের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে মাস্ক, হ্যান্ড গ্লাভস, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, পিপিই এবং করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য বিশেষায়িত হাসপাতাল স্থাপন করা অবশ্যম্ভাবী। কেননা, করোনায় আক্রান্ত হয়ে কোন পুলিশ সদস্য যদি জনগণের নিরাপত্তায় নিয়োজিত থাকে তাহলে ছোঁয়াচে বিধায় অন্যরাও আক্রান্ত হওয়ায় উদ্রেকের সৃষ্টি হবে। সুতরাং নিজেরা সর্বোচ্চ সাবধানতা অবলম্বন করে জনগণের নিরাপত্তায় নিয়োজিত থেকে করোনা মোকাবেলায় পুলিশ সদস্যরা সফলতায় উদ্ভাসিত করতে পারবে বাংলাদেশকে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে করোনা প্রতিরোধে পুলিশ মুখ্য প্রভাবক হিসেবে অনন্যসাধারণ উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারে। বলা হয়ে থাকে, করোনা প্রতিরোধের ক্ষেত্রে গণজমায়েত পরিহার করতে হবে, যততত্র চলাফেরা করা যাবে না। ইতোমধ্যে এ দুটি বিষয় অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী। শহরের তুলনায় গ্রামের মানুষ কম সচেতন বিধায় গ্রামে পুলিশের টহল আরো জোরদার করার প্রয়োজন রয়েছে কেননা বাজারের চায়ের দোকান আপাতত বন্ধ হলেও পাড়া মহল্লায় নতুন করে চায়ের আড্ডা বসছে। যেখানে সহজে পুলিশ প্রবেশ করতে পারে না কিংবা যোগাযোগের অপ্রতুলতা রয়েছে। এ সকল পরিস্থিতিতে কমিউনিটি পুলিশিং এর কার্যক্রমকে বেগবান করতে হবে, কারণ বর্তমান সময়ে যোগাযোগের নানা মাধ্যম থাকায় কমিউনিটি পুলিশিং এর সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ খুবই সহজ ও স্বল্প সময় ব্যয় হয়।

পাশাপাশি করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য ইন্টারনেটের সহায়তায় দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে কমিউনিটির সদস্যদের যোগাযোগ বৃদ্ধি করার মাধ্যমে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করা যেতে পারে। মূল কথা হচ্ছে, করোনা প্রতিরোধের ক্ষেত্রে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে আর এর জন্য যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে প্রত্যেককে নিজের জায়গা থেকে সচেতন ও সতর্ক হতে হবে।

স্থানীয় রাজনীতিবিদ, গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, মুরুব্বী, কমিউনিটি পুলিশিং এর সদস্য, স্থানীয় ব্যবসায়ী প্রত্যেকের সঙ্গে সমন্বয় করে ঘরে অবস্থান নেওয়া জনগণের জন্য চাহিদা মোতাবেক বাজার সরবরাহের সুব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য, ওষুধ ও অন্যান্য চিকিৎসা সামগ্রী যথাযথ প্রক্রিয়ায় সরবরাহের জন্য প্রত্যেক এলাকার পুলিশ বাহিনী স্বউদ্যোগে সিএমপির ন্যায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে, যাতে স্ব স্ব এলাকার বাসিন্দারা পুলিশের ওপর নির্ভর করে ঘরে নিরাপদে বাস করতে পারে। এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারলে লকডাউন না করেও গ্রামের মানুষকে ঘরে রাখা সম্ভব হবে এবং তার জন্য পুলিশের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা প্রয়োজন।  

দুস্থ, শ্রমজীবী, শ্রমিক শ্রেণি, দিন-মজুর সকলের জন্য নিজ উদ্যোগে খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহের মাধ্যমে নৈতিক দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি অন্যদের উদ্বুদ্ধকরণের কাজটিও বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী করোনা প্রতিরোধে করতে পারে। সমাজে যারা বিত্তবান, অঢেল সম্পদের মালিক, ব্যবসায়ী শ্রেণি যদি জাতীয় সংকটে অসহায় মানুষের পাশে এসে দাঁড়ায় তাহলে করোনা সংকট মোকাবেলা ও ক্ষয়ক্ষতি সহনীয় মাত্রায় নিয়ে আসা সম্ভব। এছাড়া বাংলাদেশে করোনা প্রতিরোধে মেডিক্যাল টিম গঠন করতে পারে পুলিশ বাহিনী, কেননা পুলিশে অনেক এমবিবিএস ডাক্তার রয়েছে যারা বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এএসপি হিসেবে বাংলাদেশ পুলিশে যোগদান করেছেন। মেডিক্যাল টিম মাঠ পর্যায়ে কাজ করার পাশাপাশি করোনা আক্রান্ত পুলিশ সদস্যদের জন্য হাসপাতালে কাজ করতে পারেন এবং সেটি অত্যন্ত ফলপ্রসূ হবে।  

পরিশেষে বলতে চাই, স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও মসজিদের ইমামদের সমন্বয়ে জনগণের মধ্যে করোনা সংক্রান্ত সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা, হোম কোয়ারেন্টাইন ও আইসোলেশনের গুরুত্ব অনুধাবনের মাধ্যমে গৃহীত ব্যবস্থায় পুলিশের দায়িত্ব পালন অনেকটা সহজতর হয়। কারণ হিসেবে বলা যায়, বাঙালি হোম কোয়ারেন্টাইন ও আইসোলেশনের চর্চা কখনো করেনি, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার চর্চায়ও বাঙালি পর্যুদস্ত। সুতরাং বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা যাচ্ছে, করোনা প্রতিরোধের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পুলিশ সচেতনতা সৃষ্টি, গণজমায়েত বন্ধ, নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য ও ওষুধ সরবরাহ, মেডিক্যাল টিম গঠন, নিজস্ব ফান্ডের মাধ্যমে অর্থায়ন ও অন্যদের উদ্বুদ্ধকরণ, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে কমিউনিটি পুলিশের কার্যক্রমকে বেগবান করা সহ গুরুত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ড সম্পাদন করতে পারে।  

লেখক: প্রভাষক, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

বাংলাদেশ সময়: ১৩৪৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৩, ২০২০
এসি/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।