ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বারো অবস্থা 

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬০৯ ঘণ্টা, জুলাই ৪, ২০২০
চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বারো অবস্থা 

এক.
২০১২ সালের মাঝামাঝি সময় হবে হয়তো। বিটিভি চট্টগ্রাম কেন্দ্র থেকে একটি অনুষ্ঠান সম্পন্ন করে বাসায় ফিরছিলাম। আমাকে বাসায় নামিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছিলেন অনুষ্ঠানের অন্যতম আলোচক আওয়ামী লীগের চট্টগ্রামের জেলা পর্যায়ের এক শীর্ষ নেতা। তিনি তখন শুধু দলীয় দায়িত্বই পালন করছিলেন। 

তার গাড়িতে বসে আলাপচারিতার এক ফাঁকে চট্টগ্রামের উন্নয়ন প্রসঙ্গ উঠে এলো। সে সময় আওয়ামী লীগ দ্বিতীয়বারের মতো দেশ শাসন করছে এবং তা প্রায় সাড়ে তিন বছর অতিক্রম করেছে।

তখন পর্যন্ত, অন্তত আমার বিবেচনায় চট্টগ্রামের উন্নয়নে একটি সমন্বিত উদ্যোগ নিতে না পারার কারণ জানতে চাইলে আমার অগ্রজপ্রতিম সে নেতা বললেন, গত সাড়ে তিন বছর ধরে আমি চট্টগ্রামের মন্ত্রী ও এমপিদের নিয়ে একটি বৈঠক করে চট্টগ্রামের সমস্যা চিহ্নিত করা এবং অগ্রাধিকার ভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনার অনেক চেষ্টা করেছি, পারিনি। এমনকি সবাইকে একসাথে একটি চা-চক্রে পর্যন্ত উপস্থিত করতে পারিনি।  

দুই.
চট্টগ্রামের প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা, যিনি জীবনের শেষ ভাগে এসে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। করোনায় আক্রান্ত হয়ে সপরিবারে ঢাকায় চলে গেছেন চিকিৎসার জন্য। তার কুশল জানার জন্য ফোন করে জিজ্ঞেস করলাম, একজন সংসদ সদস্য হওয়ার পরও চিকিৎসার জন্য আপনাকে ঢাকা যেতে হলো, চট্টগ্রামে কি চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব ছিল না? 

আমার প্রশ্নের মুখে নিরুত্তর রইলেন তিনি। আমি পাল্টা প্রশ্ন করলাম, দীর্ঘ প্রায় ১২ বছর আপনারা রাষ্ট্রক্ষমতায, এই দীর্ঘ সময়ে যে চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার আশানুরূপ উন্নয়ন করতে পারেননি তা কি এখন বুঝতে পারছেন? 

তিনি খুব কাতর কণ্ঠে বললেন, এটি আমাদের একপ্রকার ব্যর্থতা। এতদিন যারা সাংসদ ছিলেন, মন্ত্রী ছিলেন, তারা তৎপর হলে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হতো। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রামের উন্নয়নের ব্যাপারে খুবই আন্তরিক। তাকে প্রকৃত পরিস্থিতি বোঝাতে পারলে কয়েক বছর আগেই কয়েকটি আধুনিক হাসপাতাল চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠিত হতো।

তিনি বললেন, স্বীকার করি আমাদের দুর্বলতা আছে। আমার ইচ্ছা ছিল সংসদে এ বিষয়ে  মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করব। কিন্তু এখন তো আর সম্ভব হলো না।  তোমরা পারলে সরকারকে জানাও।
 
তিন.
২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, নির্বাচনে জয়লাভ করলে প্রতিটি বিভাগীয় শহরে একটি করে সরকারি বিশেষায়িত শিশু হাসপাতাল গড়ে তুলবেন। নির্বাচনে জয়লাভ করে তিনি প্রতিশ্রুতি পূরণের নির্দেশ দেন। সে নির্দেশ অনুযায়ী ঢাকায় রাজউকের দেওয়া ১০ একর জায়গায় পূর্বাচলে গড়ে উঠেছে এক হাজার শয্যার একটি বিশেষায়িত হাসপাতাল। কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। প্রতিশ্রুতির অংশ হিসেবে চট্টগ্রাম শিশু হাসপাতাল গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। সে লক্ষ্যে তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী সদ্য প্রয়াত মোহাম্মদ নাসিম চট্টগ্রামে এসে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করেন এবং চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তৎকালীন পরিচালককে শিশু হাসপাতালের জন্য স্থান নির্বাচনের দায়িত্ব দেন। সে সঙ্গে প্রাথমিকভাবে পাঁচ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে। আজ পর্যন্ত শিশু হাসপাতালে গড়ে তোলার জন্য উপযুক্ত জায়গা পাওয়া যায়নি বলে পরিকল্পনাটি বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে একটি বিশেষায়িত হাসপাতাল থেকে বঞ্চিত হলো চট্টগ্রামবাসী।  

চার.
একই সঙ্গে শেখ হাসিনার সরকার প্রতিটি বিভাগীয় শহরে একটি করে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলারও পরিকল্পনা নেয়। তার অংশ হিসেবে চট্টগ্রামেও মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এরপরের কাহিনী চট্টগ্রামবাসী অবগত আছে। বিশ্ববিদ্যালয় কোথায় প্রতিষ্ঠিত হবে তা নিয়ে বিতর্ক করে কেটে গেছে বছরাধিক কাল। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হয়েছে কুমিরা বক্ষব্যাধি হাসপাতালে প্রতিষ্ঠিত হবে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।  

পাঁচ.
বর্তমানে মহামারি মোকাবেলায় চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য সেবার মান নিয়ে আলোচনার আগে পূর্বে উল্লেখিত বিষয়গুলো নিয়ে সামান্য আলোকপাত করতে চাই। প্রায় ১২ বছর ধরে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ। এর মধ্যে কেউ কেউ মন্ত্রী হয়েছেন, মন্ত্রিত্ব হারিয়েছেন। কেউ সাংসদ হয়েছেন, সংসদ সদস্যপদ হারিয়েছেন। কেউ কেউ পুনরায় মন্ত্রিত্বও পেয়েছেন। কিন্তু তারা কখনো সবাই মিলে চট্টগ্রামের সমস্যা চিহ্নিত করা এবং অগ্রাধিকারভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনা করার লক্ষ্যে ঐকমত্য হয়েছেন বলে আজও শুনিনি। এমনকি সংসদে চট্টগ্রামের স্বার্থ নিয়ে জোরালো ভূমিকা রাখতে দেখিনি কাউকে। একটি সমন্বিত উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নে মন্ত্রী-এমপিরা এক হয়েছেন বলেও কোনো সংবাদ চোখে পড়েনি।  

মাত্র দুই একর জায়গার অভাবে চট্টগ্রামে একটি বিশেষায়িত হাসপাতাল করে তোলা সম্ভব হচ্ছে না, এই খবরটি চট্টগ্রামের কোনো মন্ত্রী-এমপি জানতেন না? একটি জায়গা নির্বাচনে তাদের মধ্যে কেউ সামান্য অবদান রাখতে পারতেন না? সমস্যাটি জটিল হলে তা কি প্রধানমন্ত্রীর নজরে আনতে পারতেন না? 

দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগর, যেখানে ৭০ লাখ মানুষ বাস করে, আর পুরো জেলাসহ আশপাশের ছয়টি জেলার কয়েক কোটি মানুষের বাস, সেখানে একটিও শিশু হাসপাতাল নেই। শুধু চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ড এবং মা ও শিশু হাসপাতালের সীমিত সংখ্যক কিছু শয্যা ছাড়া।

তেমনিভাবে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য শেষ পর্যন্ত স্থান নির্বাচিত হয়েছে কুমিরার বক্ষব্যাধি হাসপাতালটি। পাকিস্তান আমলে নির্মিত এই হাসপাতালটি পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল অনেক বছর। এই হাসপাতালটিকে ঢাকার সোহরোয়ার্দী হাসপাতালের ন্যায় পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল গড়ে তুলে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কি নতুন একটি স্থান নির্বাচন করা অসম্ভব ছিল? তাতে চট্টগ্রামের মানুষদের চিকিৎসাসেবার সুযোগ বৃদ্ধি পেত।

আজ সামান্য চিকিৎসার অভাবে দলে দলে নেতারা ঢাকায় পাড়ি জমাচ্ছেন। চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবার মান কোন তলানিতে আছে এখন তাঁরা নিশ্চয়ই অনুধাবন করছেন। ভাগ্যিস মহামারিটি বৈশ্বিক। বিশ্বের সব দেশের ত্রাহিমধুসুধন অবস্থা। নইলে দেশে কোনো বড়লোক পাওয়া যেত না এখন। ভারত, ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর, আমেরিকা, কানাডার হাসপাতালগুলো ভরে থাকতো বাংলাদেশি রোগীতে। ভাবি, হয়তো শেখ হাসিনা মন্ত্রিসভা চালাতে হিমশিম খেতেন আর কোরাম পূর্ণ না হওয়ায় সংসদ অধিবেশনও স্থগিত করতে বাধ্য হতেন।

ছয়.
চট্টগ্রামে ইম্পেরিয়াল হাসপাতাল নামে আন্তর্জাতিক মানের একটি হাসপাতাল গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিলেন চট্টগ্রামের কিছু বিশিষ্টজন। তাদের মধ্যে দৈনিক আজাদীর সম্পাদক এম এ মালেক অন্যতম। মাঝেমধ্যে আজাদীতে তাঁর রুমে আলাপকালে তিনি এই মহৎ উদ্যোগের কথা বলতেন। কাজের অগ্রগতি বিষয়ে জানাতেন। আমি প্রথম তার কাছেই হাসপাতালের লেআউটটি দেখেছিলাম। হাসপাতালের পরিকল্পনার কথা শুনে প্রাণিত হতাম। ভাবতাম, যাক শেষ পর্যন্ত একটি আন্তর্জাতিক মানের হাসপাতাল চট্টগ্রামেই হচ্ছে। আর্থিক সংকট ও নানা টানাপোড়েন কাটিয়ে শেষ পর্যন্ত হাসপাতাল উদ্বোধন হয়েছিল কত তারিখে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অতিথি হয়ে এসেছিলেন বিশ্ববরেণ্য কার্ডিওলজিস্ট ডা. দেবী শেঠি। কিন্তু মন্দভাগ্য। শুরুতেই হোঁচট খেল এই মহতী উদ্যোগ। দেশের চিকিৎসা বাণিজ্য যারা নিয়ন্ত্রণ করেন তাদের অযাচিত ষড়যন্ত্রে হাসপাতালের কার্যক্রম হতেই বন্ধ হয়ে যায়। তবে অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে এবং চট্টগ্রামের এক প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা ও প্রাক্তন মন্ত্রীর মাধ্যমে বিষয়টি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত পৌঁছালে তিনি সঙ্গে সঙ্গে জটিলতা দূর করার নির্দেশ দেন। এখন হাসপাতালটি পরিচালনায় কোনো বাধা না থাকলেও ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণ ও চিকিৎসাসেবা প্রদানের লক্ষ্যে কিছু বিদেশি বিশেষজ্ঞ আসার প্রয়োজন ছিল, করোনা পরিস্থিতির কারণে আসতে না পারায় এখন পরিকল্পনামাফিক চালানো সম্ভব হচ্ছে না। শুরুতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি না করলে এই হাসপাতালের পরিপূর্ণ সেবা থেকে বঞ্চিত হতো না দেশবাসী। এই হাসপাতালটি চালু করার বিষয়ে চট্টগ্রামের সব দলের নেতাদের তৎপর হওয়া উচিত ছিল দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে। হাসপাতালটি বাংলাদেশের চিকিৎসাসেবার ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে বলে আমার বিশ্বাস।

সাত.
এটি আমাদের স্বীকার করতে হবে যে, যেকোনো মহামারি মোকাবেলা করার পূর্ণ সামর্থ্য কোনো দেশেরই থাকে না। যেমন বর্তমানে কভিড-১৯ মোকাবেলার ক্ষেত্রেও দেখতে পাচ্ছি। বিশ্বের বাঘা বাঘা দেশ, উন্নত, সামর্থ্যবান দেশ যেখানে চরম বেকায়দায় পড়েছে সেখানে বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত দেশে বিশৃঙ্খলা হবে তা অনেকটা স্বাভাবিক। তারপরও অনেক অনিয়ম, অবহেলা, সমন্বয়হীনতা ও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা নিয়ে প্রশ্ন না তুলে পারা যায় না। শুধু চট্টগ্রামের চিত্রটাই তুলে ধরি।  

এখনো চট্টগ্রামসহ আশেপাশের জেলা যেমন, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, কক্সবাজার, ফেনী, নোয়াখালী লক্ষ্মীপুর জেলার কয়েক কোটি মানুষের চিকিৎসার অন্যতম ভরসা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। জেনারেল হাসপাতালকে ২৫০ শয্যায় উন্নীত করা হলেও এটির অবস্থা বা সক্ষমতা দেশের ছোট জেলাগুলোর সীমিত শয্যার হাসপাতালের চেয়েও কম। সবজি কাটতে গিয়ে বটিতে সামান্য আঙুল কাটা রোগীকে এরা ফিরিয়ে দেয় এমন একটি হাসপাতালকে কভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসার জন্য প্রথমে নির্বাচন করার মধ্য দিয়ে চট্টগ্রামে চিকিৎসা ব্যবস্থার দৈন্যই প্রথমে ধরা পড়েছে। চট্টগ্রামে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তারা কভিড-১৯ রোগটিকে শুরুতে যে হালকাভাবে নিয়েছিলেন এটি তার একটি নমুনা। ৮ মার্চ প্রথম বাংলাদেশে তিনজন এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার খবর জানায় রোগতত্ব, নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)। তার  দশ দিন পর ১৮ মার্চ সত্তরোর্ধ্ব এক ব্যক্তির মৃত্যুই ছিল বাংলাদেশে প্রথম করোনাক্রান্ত রোগীর প্রথম মৃত্যু। আর এই লেখা যখন লিখছি তখন বাংলাদেশে মৃত্যুর সংখ্যা এক হাজার আট শ,  আক্রাত এক লাখ ৪৫ হাজার। এই হিসাব স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মঙ্গলবার দেওয়া তথ্যবিবরণীর। বাস্তবচিত্র ভিন্ন। হিসাবের বাইরে প্রচুর লোক আছেন যারা আক্রান্ত হয়েছেন, অনেক আক্রান্ত হয়ে নিজে নিজে নিরাময় লাভ করেছেন।

১৮ মার্চ যখন বাংলাদেশে কোভিদ রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটল তখন ইতালি-স্পেন ও আমেরিকায় মৃত্যুসংখ্যা প্রতিদিন হাজার পেরিয়ে যাচ্ছে। ইউরোপ ও আমেরিকায় করোনা ভাইরাসের ভয়াবহ সংক্রমণ দেশেও বাংলাদেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর কোন প্রকার পূর্ব প্রস্তুতি গ্রহণ করেনি। এমনকি শুরুতেই যখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বিভিন্ন জেলার খবরাখবর নিচ্ছিলেন তখন তাঁকে ভ্রান্ত ধারণা ও মিথ্যা আশ্বাস দেওয়া হচ্ছিল। কিছুই ঠিক না করে বারবার সব ঠিক আছে বলে প্রধানমনত্রীকে বোঝানো হচ্ছিল। এ বিষয়টি আমার একটি কলামে উল্লেখ করেছিলাম।  

আট.
সরকার ইচ্ছা করলে যে কোনো সময় যে কোনো জমি অধিগ্রহণ করতে পারে। জরুরি অবস্থা বা জাতির কল্যাণে যে কোন প্রতিষ্ঠান সরকারের নিয়ন্ত্রণে নিতে পারে। কিন্তু আমরা অবাক হয়ে দেখলাম চট্টগ্রামে সরকারি চিকিৎসাসুবিধা একেবারে অপ্রতুল হওয়া সত্ত্বেও সরকার কোনো প্রাইভেট হাসপাতাল বা ক্লিনিক রিকুইজিশন করল না। সরকারের পক্ষ থেকে অনুরোধ জানানোর পর চট্টগ্রামের বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক মালিকপক্ষ গত দেড়যুগ ধরে পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকা হলি ক্রিসেন্ট হাসপাতালকে কভিড-১৯ চিকিৎসার জন্য মনোনীত করল, যা এখনও চিকিৎসাসেবাই় শুরু করতে পারেনি।  

করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ও ভয়াবহতা অনুধাবন করে প্রয়োজন ছিল আগে ভালো ও আধুনিক সুবিধা সম্বলিত অর্থাৎ আইসিইউ ও ভেন্টিলেশনের সুবিধা আছে এমন হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলো সরকারি ব্যবস্থাপনায় এনে করোনারোগীদের সেবায় নিয়োজিত করা। এই প্রয়োজনীয় কাজটি এখনো হয়নি। এমনকি এখন পর্যন্ত স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয় বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে বাধ্য করতে পারেনি সব ধরনের রোগীদের সেবা প্রদানে। ফলে চট্টগ্রামে কোভিড ও ননকভিড রোগীদের দুর্দশার শেষ নেই। এই ক্লিনিক থেকে সেই ক্লিনিক করতে করতে মারা যাচ্ছে রোগী। এই খবর চট্টগ্রামবাসী নিত্যদিনই পাচ্ছেন, আমাকে নতুন করে লিখতে হচ্ছে না। এর মধ্যে যে কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতাল কভিড রোগের চিকিৎসা দিচ্ছে তাদের বেশকটির বিরুদ্ধে গলাকাটা বিল আদায়ের অভিযোগ আছে।  

প্রশ্ন হলো, বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে কভিড রোগীদের চিকিৎসা দিতে অথবা হাসপাতালগুলো সরকারি নিয়ন্ত্রণে নিতে বাধা কোথায়? চৌদ্দগোষ্ঠীর ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করে আধুনিক নগরায়নের নামে সরকার কি বড়লোকদের জন্য আবাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলছে না?  গাড়ি থেকে যাত্রী নামিয়ে পুলিশ কি যখন তখন গাড়ি রিকুইজিশন করে না? তাহলে লাখ লাখ মানুষের চিকিৎসার স্বার্থে বেসরকারি হাসপাতাল রিকুইজিশন করতে বাধা কোথায়? বেসরকারি হাসপাতালের অধিকাংশ তো এমনিতেই চিকিৎসাসেবা সীমিত করে রেখেছে। এমন একটি সংকটকালো কি সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা একসাথে বসে সমস্যা সমাধানে একটি ঐকমত্যে আসতে পারতেন না? বর্তমানে বিএমএ বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন নিয়ন্ত্রণ করে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ বা স্বাচিপ। এরা সরকারের সমর্থক। ফলে এখন দেশের চিকিৎসাক্ষেত্রে় এই সংগঠনের আধিপত্য প্রশ্নাতীত ও বাধাহীন। এই দুর্যোগকালে এদের বড় কোনো ভূমিকা চোখে পড়লো না। শুধু বদলি ও নিয়োগবাণিজ্য আর টেন্ডারের ভাগ নেওয়াই কি তাদের অন্যতম কাজ?  মানুষ জানে দেশের শিক্ষা ও চিকিৎসা বাণিজ্যের সিংহভাগ নিয়ন্ত্রণ করে এখনো জামাত- শিবির এবং তাদের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান। আওয়ামী লীগের দীর্ঘ ১২ বছরের শাসনকালে এদের নির্বিঘ্নে চিকিৎসাবাণিজ্য চালাতে অসুবিধায় পড়তে হয়নি। কারণ তাদের মাথায় ছাতা হয়ে আছেন সরকারসমর্থিত সংগঠনের নেতারা। এমনকি এই মহামারিতে রোগীর সেবা না করলেও তাদের অনেককে জবাবদিহি করতে হচ্ছে না।

লেখক: কবি ও সাংবাদিক

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।