ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

ড. কামাল অবসর নিন, মান্নান শান্তিগঞ্জের মন্ত্রী নন

পীর হাবিবুর রহমান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬০৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ২১, ২০২০
ড. কামাল অবসর নিন, মান্নান শান্তিগঞ্জের মন্ত্রী নন পীর হাবিবুর রহমান

১. একদম ভালো লাগে না। কোথায় কী হচ্ছে তাও বুঝছি না।

গণঅসন্তোষ তৈরির মতোন ঘটনা ঘটছে আর থেমে যাচ্ছে। থেমে যাওয়ার কারণ ওই একজনই। মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা। জনঅসন্তোষকে ধারণ করেন। জনগণের পক্ষে অবস্থান নেন। তাই স্তিমিত হয়ে যায় উত্তেজনা। সিলেটে পুলিশি নির্যাতনে এক তরুণের মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে তোলপাড়। পলাতক পুলিশকর্তা আকবরের সহযোগী গ্রেফতার হয়েছেন। শেখ হাসিনার সরকার যেখানে ধর্ষণ, অপরাধ, অন্যায় সেখানে অ্যাকশনে যাচ্ছে। আড়াল করার চেষ্টা নেই। ধামাচাপা নেই। মাজা ভাঙা বিরোধী দল ক্যাশ করবে কি কথা বলার আগেই জল ঢেলে দেন শেখ হাসিনা। আগুন জ্বলবে কী নিভতেও দেখা যায় না। যাক, সমাজে একটা স্থিতিশীল শান্তিপূর্ণ উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের পাশে করোনার বিরুদ্ধে যে অর্থনৈতিক লড়াই চলছে সেখানে বিজয়ী হলেই দেশ বিজয়ী হয়। উৎপাদনে মালিক শ্রমিক কৃষক নেমেছে। অর্থনীতি চাঙা। দুর্নীতি, ঘুষ, ব্যাংক লুট, বিদেশে অর্থ পাচার রোধ ও দেশের টাকা দেশে রাখার সর্বোচ্চ শক্তি এখন সরকারের দেখা দরকার। মৃত শেয়ারবাজারে আলো জ্বালিয়ে দেন বিএসইসির নতুন চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত। তার পদক্ষেপ প্রশংসিত হয়েছে। ব্রোকার্স হাউসগুলো থেকে বাজারের বাজিকরদের দিকে এমনকি মনিটরিং সেলের দিকেও কড়া নজরদারি রাখা জরুরি। উন্নয়ন কর্মযজ্ঞের দেশে বৈষম্য যাতে না হয় রাষ্ট্রের তা দেখা দরকার। জনগণের সঙ্গে রাষ্ট্রের চুক্তিনামা হলো সংবিধান। সংবিধান থেকে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে একচুল নড়ার সামর্থ্য নেই। কারও ক্ষমতার কর্তৃত্ব ব্যক্তির খেয়াল খুশিমতো হতে পারে না। জনগণের কল্যাণে সংবিধান, আইন, বিধি-বিধান ও রীতিনীতির বাইরে যেতে পারেন না।

২. মমতাজের একটি পপুলার গান আছে ‘কোনবা পথে নিতাইগঞ্জে যাই, নিতাইগঞ্জে করব বাসা মনে ছিল দারুণ আশা, ঘুমায়া ছিলাম, ছিলাম ভালো জেগে দেখি বেলা নাই। ’ পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান সুনামগঞ্জের দক্ষিণের অবহেলিত ডুংরিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। প্রতিকূল পরিবেশে মেধার স্বাক্ষর রেখে লেখাপড়া করে সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছেন। অবসর জীবনে রাজনীতিতে নেমেছেন। সেখানেও তিনি কিস্তিমাত করেছেন। তিনি আমার জেলার বাসিন্দাই নন আত্মীয়ও বটে। একজন সৎ সরল তীক্ষ্ন বুদ্ধিসম্পন্ন সাদামাটা জীবনের এই মানুষটি আমার খুব প্রিয়। আমি তার প্রশংসা করি নিয়মিত। বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে জাতীয় নেতা আবদুস সামাদ আজাদ মৃত্যুবরণ করলে সুনামগঞ্জ-৩ (দক্ষিণ সুনামগঞ্জ-জগন্নাথপুর) আসনটি শূন্য হয়। আওয়ামী লীগ নির্বাচন বর্জন করায় সামাদ আজাদ-পুত্র দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নির্বাচন করতে পারেননি। তবে এমএ মান্নান স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটযুদ্ধ করে বিএনপি জোটের প্রার্থীর কাছে পরাজিত হন। দক্ষিণ সুনামগঞ্জ তার ভোটের দুর্গ হয়ে ওঠে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে এমএ মান্নান আওয়ামী লীগের মনোনয়ন লাভ করে বিজয়ী হয়ে সংসদে আসেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা তাকে দলের ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য করেন। সে সময় গ্রাম্য রাজনীতির বিরল চেহারার জটিল চরিত্রের একজন জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা তাকে প্রাপ্য সম্মান না দিয়ে মানসিক যন্ত্রণা দেন। এটি তিনি নীরবে হজম করেন। কিন্তু সুনামগঞ্জের মানুষ তাকে প্রাণঢালা ভালোবাসা দিতে কার্পণ্য করেনি। এমপিরা সবাই তাকে সম্মান করেন। জনপ্রতিনিধিরা করেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে তিনি আবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন লাভ করেন। সে নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী আজিজুজ সামাদ আজাদ ডন ভোটের চমক দেখালেও মান্নান বিজয়ী হন। শেখ হাসিনা তাকে অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী করেন। সর্বশেষ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে এলে তার ধারণা ছিল তিনি অর্থমন্ত্রী হবেন। দুঃখ করে আমাকে বলেছিলেন, ২৮ বছর ধরে সিলেটে অর্থমন্ত্রী আর কত? এমন প্রশ্ন তুলে একটি গ্রুপ তাকে আটকে দেয়। শেখ হাসিনা তাকে পরিকল্পনামন্ত্রীর দায়িত্ব দেন। তিনি দক্ষতা ও সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। একজন মন্ত্রী গোটা দেশের মন্ত্রী। সব মানুষের মন্ত্রী। কারও প্রতি রাগ বা বিরাগের বশবর্তী হবেন না এই মর্মে বঙ্গভবনে শপথ পাঠ করেন। কিন্তু গভীর বেদনার সঙ্গে আমার প্রিয় পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নানের কাছে প্রশ্ন রাখতে ইচ্ছা করে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সারাদেশের উন্নয়ন কর্মযজ্ঞে সুনামগঞ্জকে দুই হাত ভরে উন্নয়ন উপহার দিলেও তিনি মন্ত্রীর ক্ষমতার জোরে কেন সুনামগঞ্জ জেলা সদরকে অবজ্ঞা উপেক্ষা করে তার বাড়িতে সব নিয়ে যাচ্ছেন? একটি জেলা সদর নীরব নিস্তব্ধ প্রাণহীন পরিত্যক্ত করে কি উন্নয়নের সুফল ভোগ করা যায়? এমএ মান্নান ডুংরিয়ার পাশেই শান্তিগঞ্জে একটি বাড়ি করেছেন। হিজল করচ নামের বাড়িটি মুগ্ধতা ছড়ায়।

প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া মেডিক্যাল কলেজ তিনি তার শান্তিগঞ্জের বাড়ির কাছে নিয়ে গেছেন। টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে প্রতিষ্ঠিত হলেও সেটিও তার বাড়ি ডুংরিয়ায় নিয়ে গেছেন। সংসদের বিগত অধিবেশনে হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিল পাস হয়। পরে সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে উভয় জেলা সদরে প্রতিষ্ঠার সংশোধনী সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। অর্থাৎ চাঁদপুর ও হবিগঞ্জ জেলা সদরে দুটি বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে। সুনামগঞ্জ জেলায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হবে সংসদের খবরে, প্রধানমন্ত্রীর উপহারে সুনামগঞ্জবাসী আনন্দে উল্লসিত হয়ে ওঠে। ১৫ অক্টোবর এ বিলটি সংসদের স্থায়ী কমিটির সভায় উত্থাপিত হয়। সেখানে সুনামগঞ্জ জেলা সদরের এমপি অ্যাডভোকেট পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ জেলা সদর উপজেলায় বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপনের জন্য শিক্ষামন্ত্রী ও সংসদীয় কমিটির সভাপতির কাছে আবেদন করেন। কিন্তু পরিকল্পনামন্ত্রীর জোর সুপারিশের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় মন্ত্রীর বাড়ি শান্তিগঞ্জেই প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হয়েছে। যা সংসদের আগামী অধিবেশনে আসবে। প্রধানমন্ত্রী হাওরের মানুষের প্রতি মমত্ববোধ থেকে যা দিচ্ছেন তাই এখন মন্ত্রীর শান্তিগঞ্জে চলে যাচ্ছে। জেলা সদরে হলে হাওরবেষ্টিত সুনামগঞ্জ, বিশ্বম্ভরপুর, জামালগঞ্জ, তাহিরপুর, ধর্মপাশাসহ সবার সুবিধা হতো। এখন যেখানে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন হচ্ছে সেখান থেকে সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের দূরত্ব মাত্র ৪০ কিলোমিটার। এবং শান্তিগঞ্জে সবকিছু প্রতিষ্ঠিত হলে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে লাভবান দূরে থাক গণঅসন্তোষের মুখে পড়বে। এসব ঘটনায় মানুষের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। পরিকল্পনামন্ত্রী হাওরে ফ্লাইওভারের স্বপ্ন দেখান, কিন্তু সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের যে বেহালদশা তার নির্মাণকাজ দুই বছরেও শেষ করাতে পারেননি। চারলেনের মহাসড়কে যুক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছেন। তার পাগলা জগন্নাথপুরে উন্নয়ন হয় না। সুনামগঞ্জের ট্রেন লাইন, ধারারগাঁওয়ে সুরমা নদীর ওপর সেতু এখনো স্বপ্নই রয়ে গেছে। সুনামগঞ্জে শিক্ষাঙ্গনগুলোতে শিক্ষক সংকট চরমে। মন্ত্রী এমএ মান্নান শান্তিগঞ্জের মন্ত্রী নন, দেশের মন্ত্রী, জেলার মন্ত্রী। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ব্যক্তিগত ক্ষমতা ব্যবহার করে নিজ বাড়িতে নেবেন না। সিলেট শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কোথাও হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর নাম নেই। এটি প্রতিষ্ঠায় তার অবদান মানুষের হৃদয়ে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে জড়িয়ে আছে। স্বাধীনতা-উত্তর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়ক নির্মাণে আবদুস সামাদ আজাদের অবদান মানুষ এখনো স্মরণ করে। কর্মই আপনাকে অমরত্ব দেবে। মমতাজের গানের মতো ‘নিতাইগঞ্জ’ নয়, শান্তিগঞ্জে দারুণ আশার বাড়ি করেছেন। সুখে থাকেন। রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের বৈষম্য সৃষ্টি করে নিজের বাড়ি নিয়ে গেলে মানুষও জেগে উঠে বলবে, শান্তিগঞ্জে কোনবা পথে যাই?

৩. দেশের প্রখ্যাত আইনজীবী সংবিধানপ্রণেতা ড. কামাল হোসেন আওয়ামী লীগ ছেড়ে গণফোরাম গঠন করেছিলেন মূলধারার রাজনীতির স্লোগান তুলে। তার সঙ্গে দলের অনেকেই যোগ দেননি যারা একসময় তাকে মার্কিনপন্থি রাজনীতিবিদ বলে প্রচার করতেন সেই বামপন্থিরাও এসে যোগ দিয়েছিলেন। নতুন দলে রাজনীতি ও সমাজের আলোকিত মানুষরা এসে যুক্ত হলেও দল আর অগ্রসর হয়নি। সেই সময়ে তার সাংগঠনিক সফরে দু-একবার সঙ্গী হয়েছিলাম। সুনামগঞ্জে জনসভা করতে গিয়ে সড়ক ভবনের গেস্টহাউসে উঠেছিলেন। সেখান থেকে সবাই হেঁটে হেঁটে যাচ্ছিলেন ট্রাফিক পয়েন্টের জনসভাস্থলে। কোর্ট থেকে ফিরছিলেন আমার বড় ভাই ’৭৫-উত্তর দুঃসময়ে জেলা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক থেকে পরপর দুবার নির্বাচিত সভাপতি অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান পীর। মন্তব্য করেছিলেন, উনারা পাকা সড়কেই হাঁটতে পারেন না, গ্রামে গ্রামে সংগঠন করবেন কীভাবে? আরেকবার মানিকগঞ্জে গেলাম। মফিজুল ইসলাম কামাল আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা ও সাবেক এমপি। গণফোরামের নেতা হলেন। তার বাড়িতে বিশাল পাঙ্গাশ মাছ ভাবি রান্না করেছিলেন। জলপাইর টক-মিষ্টি ভোলবার নয়। সংবাদকর্মী আমির খসরুও ছিলেন। ভিতরে এত নেতা, এত খাবার আয়োজন। কিন্তু বাইরে উঠোনে একটি লোক মাথা গরম করে রীতিমতো বিদ্রোহে ফুসফুস করছে। কৌতূহলবশত লোকটার কাছে গেলাম। জানতে চাইলাম তার এত রাগের কারণ কী? সে বলল, এ বাড়িতে দীর্ঘদিন ধরে আছে। মফিজুল ইসলাম কামালের মা বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার জন্য তাকে দিয়ে ৩২ নম্বরে পিঠেপুলি পাঠাতেন। এটা ছিল তার পরম আনন্দ। এখন আওয়ামী লীগ ছেড়ে এসব দল করায় তার আর ৩২ নম্বরে যাওয়া হবে না। এটা সে মানতে পারছে না। বলছিল, যান যান আপনারা খান। এসব খাবার আমি খাব না। বুঝলাম বাড়িতে বিদ্রোহ রেখে এই দল কীভাবে সম্ভব?

যাক, ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোরামে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, আবুল মাল আবদুল মুহিত, শেখ আবদুল আজিজ, মতিউর রহমান, মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান (অব.) পংকজ ভট্টাচার্য, মোস্তফা মহসীন মন্টু, সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক, নুরুল ইসলাম নাহিদ, শাজাহান সিরাজ, তার স্ত্রী রাবেয়া সিরাজ, নুরজাহান মুর্শেদসহ সারা দেশে অনেকে যোগ দিয়েছিলেন।

ছাত্রসমাজে মোস্তফা মহসীন মন্টুর তখনো দারুণ প্রভাব। সগীর আনোয়ারদের মতোন ছাত্রনেতারা যোগ দিলেন। কিন্তু দলটি ছাত্র সংগঠনও রাখল না। গণসংগঠন গড়তে যে পথ তৃণমূল ধরে নিতে হয় তাও আর নিল না। বিষয়টি তখন অবাক লাগে। গণমানুষকে যুক্ত করার পথ পরিহার করে সেমিনারে আগ্রহী হলো। দলের কাজের চেয়ে ড. কামাল বিদেশ ভ্রমণেই বেশি আগ্রহী হলেন। মাঠের রাজনীতিতে ব্যর্থ হলেন। জনগণের ঐক্যের নামে বায়বীয় বক্তব্যের রহস্যময়তায় কোনো কিছু খোলাসা হলো না। মাঝখানে ’৯১ সালে পরাজিত আওয়ামী লীগে ভাঙন এনে দলটিকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হলো। একদিন সংবিধানপ্রণেতা থেকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এমনকি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী করে যে ড. কামাল হোসেনকে আওয়ামী লীগ বটবৃক্ষে তৈরি করেছিল তাতে দল ভেঙে গণফোরাম করে আওয়ামী লীগের ক্ষতি কতটা করেছেন জানি না তবে নিজেকে ঝরাপাতায় পরিণত করে দেন। রাজনীতিতে নিজেকে যে কোনো সংকটে তৃতীয় শক্তির মুখ হিসেবে জনগণের সামনে এসেছে তার মুখ! কেন জানি না! বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী একজন গণতন্ত্রের আদর্শিক পথের যাত্রীর জন্য এটা সম্মানের নয়। আমি ড. কামাল হোসেনকে শ্রদ্ধা-সম্মান করি। একসময় রাজনৈতিক রিপোর্টার থাকাকালে নিয়মিত যোগাযোগ করেছি। গণতন্ত্রের সংগ্রামে তার ভূমিকা অমর অক্ষয়। একুশের গ্রেনেড হামলার পর ভুতুড়ে নগরীতে গণতদন্ত কমিশনে তার ভূমিকা অসাধারণ। দেশবাসীও জানেন। তিনি এ দেশের একজন কিংবদন্তিই নন, গর্বিত সন্তান। আমাকে একবার বলেছিলেন বালিশের নিচে সংবিধান রাখবেন। আমীর-উল ইসলাম সাহেবও রাখেন। আমি নিচে নয়, মাথার পাশে খাটের ওপর রাখি। আর দেখি রাষ্ট্র জনগণের সঙ্গে চুক্তিনামা কতটা লঙ্ঘন করেছে।

যাক, ড. কামালের গণফোরাম একে একে সবাই ছেড়ে দিয়েছেন। ’৯৬ সালের নির্বাচনের আগেই নাহিদ আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে প্রেসিডিয়াম সদস্যই নয়, দুবার মন্ত্রী-এমপি হয়েছেন। আবুল মাল আবদুল মুহিতও দুবার অর্থমন্ত্রীই নয়, পরিবারকেই দলে মালিকানা এনে দিয়েছেন। ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের মতোন খ্যাতিমান আইনজীবী মুক্তিযুদ্ধের বীরত্ব ক্যারিশমা নিয়ে আজ নির্বাসিত। অনেকে মারা গেছেন। সারা দেশেই দলটা বিলুপ্ত। অনেকে নিজের মতোন জীবনযাপন করলেও গণফোরামে নেই। মোস্তফা মহসীন মন্টু নিঃস্ব হলেন। অধ্যাপক আবু সাইয়িদ শেষ বেলায় গিয়ে চরম ভুলটা করলেন। যাক, অবশেষে ছোট্ট পাখির নীড়ের মতোন ড. কামাল হোসেনের গণফোরামটিও ভেঙে গেল। ডিসেম্বরেই আনুষ্ঠানিক ভাঙনের নাটক দর্শকরা উপভোগ করবেন।

ড. কামাল সব সময় বিভক্তির রাজনীতির বিরুদ্ধে বলতেন। আমার প্রশ্ন- নিজের দলেই কেন এমন করুণ দশা? রুগ্ন রাজনীতির কথা বলতেন, দলটি তার কেন এত রুগ্ন? তিনি আওয়ামী লীগে দলীয় গণতন্ত্র ও যৌথ নেতৃত্বের কথা বলতেন। তাহলে গণফোরামে যৌথ নেতৃত্ব অস্তিত্বহীন কেন ছিল? দলীয় গণতন্ত্রের নিশানা কোথায় ছিল? ২৭ বছরে দলের সভাপতি থেকে সংগঠনের সীমাহীন ব্যর্থতা নিয়ে পদ থেকে সরে দাঁড়াতে পারলেন না কেন? গণতন্ত্রের কোন সংজ্ঞায় কোন প্রক্রিয়ায় হঠাৎ ভোটের আগে এসে যোগ দেওয়া ড. রেজা কিবরিয়াকে পার্টির সাধারণ সম্পাদক করলেন? আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব দেশের সেরা মর্যাদাশীল ব্যক্তিত্ববান মেধাবী দক্ষ সৎ যোগ্য অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়ার রক্তের ওপর দিয়ে সেদিনের ঘাতক সরকারি দলের সঙ্গে যোগ দিয়ে যে সন্তান এমপি হতে ঐক্যফ্রন্টে গেছেন তাকে দিয়ে আদর্শের রাজনীতি হয় কোন বিবেচনায়? আর যে ড. কামাল হোসেন সেনাশাসক এরশাদের সঙ্গে মঞ্চে ওঠেননি তিনি কীভাবে গ্রেনেড বোমা রাজনৈতিক হত্যাযজ্ঞের রক্তে মাখা বিএনপি ও তার পেছনের দরজায় ঐক্যে শামিল জামায়াত নিয়ে ঐক্যফ্রন্ট করলেন?

সুপ্রিম কোর্টে আজ বিখ্যাত আইনজীবীদের বড় আকাল। আইকন নেই। ব্যারিস্টার রফিক-উল হকও শয্যায়। ড. কামাল হোসেন একজন অভিভাবকতুল্য সম্মানিত মানুষ। গুণীজন হিসেবে রাজনীতিতে ব্যর্থ হতেই পারেন। আতাউর রহমান খান, ড. আলিম আল রাজীসহ অনেকে ব্যর্থ হয়েছেন। জীবনের শেষ সময়ে মানুষের শ্রদ্ধা-ভালোবাসা নিয়ে যে কজন বেঁচে আছেন জাতির প্রয়োজনে পরামর্শ দিন। জনস্বার্থে আদালতে দাঁড়ান। মুক্তিযুদ্ধ গণতন্ত্র ও মানুষের অধিকার নিয়ে কথা বলুন। কিন্তু দয়া করে গণফোরামই নয়, রাজনীতি থেকে অবসর নেন। দেশকে আপনি অনেক দিয়েছেন। দেশ ও বঙ্গবন্ধু আপনাকে অনেক দিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য ড. কামাল হোসেন হয়েই বাকিটা জীবন মানুষের জন্য অবসরে কাটান। এটা হবে সম্মান ও গৌরবের। গণফোরামের ব্যর্থতা গ্লানি লজ্জা ও ব্যর্থতার। আশা করি, আমার প্রস্তাব বিবেচনায় নেবেন।

লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।

বাংলাদেশ সময়: ১৬০৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ২১, ২০২০
টিএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।