ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

স্মরণ

আপনার কীর্তির চেয়েও আপনি মহান 

বোরহান উদ্দিন চৌধুরী মুরাদ, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৪৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ২, ২০২০
আপনার কীর্তির চেয়েও আপনি মহান  মরহুম আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু

ত্যাগ এবং সংগ্রামের মাধ্যমে অতিবাহিত হওয়া জীবনকে আদর্শ হিসেবে যদি ধরা যায়, তাহলে জীবনে সফলতা আসবেই। আর এমন একটি জীবনই অতিবাহিত করেছেন আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু।

 

চট্টগ্রামের খ্যাতিমান রাজনীতিবিদ ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক হওয়ার পাশাপাশি চট্টগ্রামের রাজনৈতিক নেতাকর্মীদেরও খুব পছন্দের মানুষ ছিলেন বাবু ভাই। দলীয় নেতা কর্মীরা তার ছত্রছায়ায় পেতেন সাহস ও মনোবল। বিভিন্ন ধরনের সংকটময় সময়েও তিনি সব সময় দলীয় আদর্শে ছিলেন অটুট। শুধুমাত্র রাজনীতিই নয়, ব্যবসা বাণিজ্য এবং শিল্পায়নের মাধ্যমেও দেশের ও মানুষের জন্য কাজ করেছেন তিনি। দেশের বেকারত্ব হ্রাস করতে বিপুল পরিমান কর্মসংস্থান তৈরিতে সহায়তাও করেছেন তিনি।  

চট্টগ্রামের রাজনীতিতেও তিনি প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। দীর্ঘ সময় ধরে ছিলেন দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। জাতীয় সংসদ সদস্য চারবার নির্বাচিত হওয়ার পাশাপাশিও ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য। নবম জাতীয় সংসদে তিনি ছিলেন পাট বস্ত্র মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত— সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি।  

১৯৪৫ সালে আনোয়ারা হাইলধর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু। তার পিতার নাম নুরুজ্জামান চৌধুরী। তিনি ছিলেন আইজীবী এবং জমিদার। তার মাতার নাম খোরশেদা বেগম। আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ১৯৫৮ সালে পটিয়া হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে এই বছর ঢাকা নটরডেম কলেজে ভর্তি হন। ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসে পড়ার সময় তিনি বৃত্তি পেয়ে আমেরিকার ইলিনয় ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে ভর্তি হন। পরে তিনি নিউইয়র্ক ইউনিভর্সিটিতে বিজনেস অ্যাডমিটিস্ট্রেশনে পড়াশোনা করেন। সেখান থেকে অ্যাসোসিয়েট ডিগ্রি নিয়ে ১৯৬৪ সালের ডিসেম্বরে দেশে ফেরেন। ১৯৬৫ সালে তিনি বড় ভাইয়ের সাথে ব্যবসায় যোগ দেন।

১৯৫৮ সালে দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের সদস্য নির্বাচিত হন আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু । ১৯৬৭ সালে তিনি আওয়ামী লীগের সাথে তার পথ চলা শুরু। ৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি আনোয়ারা ও পশ্চিম পটিয়া থেকে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। ৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন তিনি।  

দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের এক বিবৃতিতে জানানো হয়, মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে অসহযোগ আন্দোলনের সময় তার পাথরঘাটাস্থ জুপিটার হাউজ থেকে সংগ্রাম কমিটির কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতো। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা চট্টগ্রামে আসার পর জুপিটার হাউজ থেকে সাইক্লোনস্টাইল করে প্রচার করা হয়। তার বাসা থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রসহ সব জায়গায় পাঠানো হয়।  

মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ভারতে গমন করেন এবং সেখানে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন। তিনি মুজিবনগর সরকারের ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটির সদস্য ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন, বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠন ছিলো তার মূল লক্ষ্য। তিনি প্রথম লন্ডনে যান সেখান থেকে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সদস্য হয়ে আমেরিকায় যান।  

১৯৭০ সালের প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য (এমপিএ) হিসেবে আখতারুজ্জামান চৌধুরী ১৯৭২ সালে গঠিত বাংলাদেশ গণপরিষদের সদস্য হন এবং বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নে ভূমিকা রাখেন। স্বাধীনতার  পর ১৯৮৬, ১৯৯১ এবং ২০০৯ সালে তিনি জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। স্বাধীনতার পর আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় শিল্প ও বাণিজ্য সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন।  

১৯৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু খুন হওয়ার পর আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দলের নেতাকর্মীদের সাথে যোগাযোগ করেন এবং পরবর্তীতে দলের পুর্নজ্জীবন ও পুনর্গঠনে সাহসী ভূমিকা পালন করেন। আশির দশকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনেও আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে তিনি কারা নির্যাতন ভোগ করেন।  

কেবল রাজনীতিতেই নয়, আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু একজন সফল ব্যবসায়ী ও শিল্পদ্যোক্তা ছিলেন। স্বাধীনতার পূর্বে তিনি বাটালী রোডে রয়েল ইন্ডাস্ট্রি নামে একটি কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। একই সাথে তিনি বড় ভাইয়ের কারখানাগুলোও দেখাশোনা করতেন। পরবর্তীতে আখতারুজ্জামান বাবু আসিফ স্টিল মিল, জাভেদ স্টিল মিল, আসিফ সিনথেটিক, প্যান আম বনস্পতি, আফরোজা অয়েল মিল, বেঙ্গল সিনথেটিক প্রোডাক্ট ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেন। ভ্যানগার্ড স্টিল মিল, সিনথেটিক রেজিন প্রোডাক্ট ক্রয় করে স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের প্রথম দু’দশকে জামান শিল্পগোষ্টির গোড়াপত্তন করেন। তিনি বিদেশি মালিকানাধীন আরামিট মিল ক্রয় করে সেটিকে সুদৃঢ় ভিত্তিক উপর দাঁড় করান। বাংলাদেশে বেসরকারি ব্যাংকিং সেক্টর প্রতিষ্ঠায় তিনি পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন। তিনি দেশে দ্বিতীয় প্রাইভেট ব্যাংক ইউনাইটেড কমার্সিয়াল ব্যাংক লিমিটেড (ইউসিবিএল) এর উদ্যোক্তা এবং প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। তিনি ২০১১ সালে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান পুননির্বাচিত হন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেন।  

আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু দেশের ব্যবসায়ী সমাজের মুখপাত্র ও ব্যবসায়ী নেতা হিসেবে ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি দু-দফায় চট্টগ্রাম চেম্বারের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ১৯৮৮ সালে তিনি দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠক এফবিসিসিআইর প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ওআইসিভুক্ত দেশসমুহের চেম্বারের প্রেসিডেন্ট হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন।  

১৯৮৯ সালে তিনি ৭৭ জাতি গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তিনিই একমাত্র বাংলাদেশি যিনি এই মর্যাদাপূর্ণ আন্তর্জাতিক সংস্থার ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন।  

তিনি ব্যক্তি জীবনে ৩ পুত্র ও ৩ কন্যা সন্তানের জনক।  

আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু একজন সমাজহিতৈষী, দানবীর ও জনদরদী ছিলেন। ১৯৬৭ সাল থেকে ৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি হাইলধর ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত চেয়ারম্যান ছিলেন। স্বাধীনতার পরেও তিনি হাইলধর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং থানা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। বটতলী মোহছেন আউলিয়া ডিগ্রী কলেজ, চন্দনাইশ বরমা কলেজ, এনায়েত বাজার মহিলা কলেজ, এ.জে.চৌধুরী ডিগ্রী কলেজ, রায়পুর উপকূলীয় উচ্চ বিদ্যালয়সহ আনোয়ারা পশ্চিম পটিয়ার ও চট্টগ্রামে অনেক স্কুল কলেজের প্রতিষ্ঠাতা দাতা সদস্য। এছাড়া বহু জনহিতকর কাজের সাথে জড়িত ছিলেন তিনি।  

আমি সৌভাগ্যবান, ধন্য আমার জীবন। আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর মতো এত বড় মাপের মহৎ হৃদয়বান জাতীয় নেতার সহচার্য লাভের সুযোগ হয়েছে। বিশ্বস্ততার সহিত মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার অভিভাবকত্বে তার সহিত রাষ্ট্রের সেবামূলক কাজ করেছি এবং তার সেবা করার সুযোগ পেয়েছি। তাকে কাছ দেখেছি, মিশেছি। সুখ, দুঃখের সঙ্গী হয়েছি। আমি দেখেছি, তার মধ্যে এক নরম প্রকৃতির হৃদয়, মানুষকে ভালবাসার উদার মন-মানসিকতা।  

আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু সমস্ত লোভ-লালসার উর্ধ্বে উঠে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়  অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে নির্মাণের সম্মুখ সৈনিক ছিলেন। তিনি স্বাধীনতা উত্তরকালের সেই সব বিরল রাজনীতিবিদদের অন্যতম যারা আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে হাল ধরেছেন, রাজনীতি করেছেন নিজের অর্থ ব্যয় করে।

বর্ষীয়ান আওয়ামী লীগ নেতা, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ছিলেন এমনি এক অসাধারণ মহাপুরুষ। যার সঙ্গে সঙ্গে চলে গেছে বিশাল এক প্রাণবন্ত জগৎ। তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে সংগঠন ও জনগণের আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়েছেন। সুস্থ ও পরিচ্ছন্ন রাজনীতিবিদ হিসেবে আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর জীবনী থেকে নতুন প্রজন্মের অনেক কিছু শেখার আছে। জীবনে অনেকবার মন্ত্রিত্বের সুযোগ পেয়েও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে বিচ্যুতি হয়নি। তিনি অত্যন্তদূরদর্শী ও বিচক্ষণ রাজনীতির ধারক ছিলেন। চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে তিনি এক উজ্জল জ্যোতিষ্ক। তিনি চট্টগ্রাম আওয়ামীলীগের এক অনন্য কর্ণধার। তিনি ছিলেন একজন রাজকীয় এবং বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্ব। রাজনীতিতে যেমন ব্যবসা, ব্যাংক, বীমা ও শিল্প স্থাপনে তিনি ছিলেন একজন ঈষার্ণীয় সফল ব্যক্তিত্ব। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তিনি ছিলেন একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা।  

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তার অবদান অপরিসীম। যে কোনো কঠিন সময়ে দলের জন্য তিনি ছিলেন নিবেদিত এক কর্মী। ক্রমেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের একজন অভিভাবক। তার মৃত্যু চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগকে শুধু অভিভাবকহীন করেনি, সামগ্রিক রাজনীতিতে একটি শূণ্যতা সৃষ্টি করেছে। যদিও তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই, তবুও তিনি আমাদের অন্তরে চির জাগ্রত।  

লেখক: মরহুম আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর সাবেক একান্ত সচিব

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।