ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

চট্টগ্রামে নেই সেক্টর কমান্ডার নাজমুল হকের স্মৃতিচিহ্ন

মিনহাজুল ইসলাম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১৭ ঘণ্টা, আগস্ট ৪, ২০২১
চট্টগ্রামে নেই সেক্টর কমান্ডার নাজমুল হকের স্মৃতিচিহ্ন সেক্টর কমান্ডার মেজর নাজমুল হক।

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কাছে যারা মাথা নত না করে নিজের জীবন দিয়ে দেশের স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে এনেছিলেন, তাদেরই একজন লোহাগাড়ার সন্তান মুক্তিযুদ্ধে সাত নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর নাজমুল হক।  

পুরো জাতি যখন শ্রদ্ধাবনত চিত্তে জাতির বীর সেনানীদের স্মরণ করছে বিশেষ দিনগুলোতে, তখন সেক্টর কমান্ডার মেজর নাজমুল হকের জন্মভূমি চট্টগ্রাম নগরে তার স্মৃতি ধরে রাখার কোনও চিহ্নই চোখে পড়ে না।

বইয়ে বা বিভিন্ন সংবাদ-সাময়িকী ও টেলিভিশনের পর্দায় মুক্তিযোদ্ধাদের ছবিগুলো যখন দেখানো হয়, তখন চট্টগ্রামের নতুন প্রজন্মের কাছেই তিনি যেন অপিরিচিত কেউ। নগরে তার ভাস্কর্য বা স্মৃতিফলক তৈরির জন্য মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম দাবি জানিয়ে আসলেও এখনো দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।  

মেজর নাজমুল হকের জন্ম ১৯৩৮ সালের ১ আগস্ট (মতান্তরে ১০ আগস্ট) লোহাগাড়া উপজেলার আমিরাবাদ গ্রামে। কুমিল্লার পেশোয়ারা পাঠশালা থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে তিনি ঢাকায় যান। এরপর জগন্নাথ কলেজ (বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। ঢাকা আহসান উল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়) দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময়ই যোগ দেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। ১৯৬২ সালের ১৪ অক্টোবর আর্টিলারী কোরে কমিশন লাভ করেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর এক সপ্তাহ আগে ১৯৭১ সালের ১৮ মার্চ ৭ ইপিআর উইংয়ের অধিনায়ক করে মেজর নাজমুল হককে পাঠানো হয় নওগাঁয়।  

মার্চের উত্তাল দিনগুলোতে সারাদেশ তখন ফুঁসছে ক্ষোভে। পাকিস্তানি শাসন-শোষণ থেকে মুক্তির জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের প্রস্তুতি নিচ্ছে জনতা। এমন পরিস্থিতিতে পাঞ্জাবি উইং কমান্ডার মেজর আকরাম কোনো বাঙালির কাছে দায়িত্ব হস্তান্তরে প্রথমে রাজি হননি। পরে বাধ্য হয়ে তিনি মেজর নাজমুল হককে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেন। ২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকায় গণহত্যার মাধ্যমে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামকে স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল। নওগাঁয় সে খবর পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে নাজমুল হক স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। ২৬ মার্চ নওগাঁ মহকুমা মুক্তাঞ্চল ঘোষণার মাধ্যমে শুরু হয় তাঁর মুক্তিযুদ্ধ।

এদেশে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ যে অসংখ্য বীরের জন্ম দিয়েছে, আমিরাবাদের সন্তান মেজর নাজমুল হক ছিলেন তাঁদের একজন। রাষ্ট্রীয় বীর খেতাব না পেলেও জনতার কাছে তিনি একজন প্রকৃত বীর। মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে তিনি সম্মুখযুদ্ধেই কেবল অংশ নেননি, একই সঙ্গে স্থানীয় যুবকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছেন লড়াই করার জন্য। পালন করেছেন সাত নম্বর সেক্টরের অধিনায়কের দায়িত্ব।  

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিল দশম খণ্ডে ও মেজর রফিকুল ইসলামের লেখা লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে বইয়ে শহীদ মেজর নাজমুলের বীরত্বের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর তিনি বেঁচেছিলেন  মাত্র ছয় মাস। এই ছয় মাসে সাত নম্বর সেক্টরের অধীনে সমগ্র রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া জেলা, দিনাজপুর ও রংপুরের কিছু এলাকায় অসংখ্য অভিযান পরিচালনা করেন। ইপিআর সদস্য ও স্থানীয় যুবকদের সঙ্গে নিয়ে নওগাঁ ও বগুড়ার সেনাক্যাম্পে হামলা করেন তিনি। শত্রুমুক্ত করেন সমগ্র বগুড়া জেলা। এরপর গ্রহণ করেন রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ মুক্ত করার পরিকল্পনা।  

মেজর নাজমুল হকের নেতৃত্বে সাত নম্বর সেক্টরে প্রায় ১৫ হাজার মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধ করেন। নিয়মিত বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা ছিল প্রায় আড়াই হাজার এবং সাড়ে ১২ হাজার মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন গণবাহিনীর সদস্য। এই সেক্টরের আটটি সাব-সেক্টর ছিল। প্রতিটি সাব-সেক্টরের অপারেশনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত থাকতেন। অনেক সময় তিনি নিজেই অভিযানে নেতৃত্ব দিতেন। ২৭ সেপ্টেম্বর মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত যৌথবাহিনীর বৈঠক শেষে ভারতের তৎকালীন পশ্চিম দিনাজপুরের শিলিগুড়ি বাগডোগরা ক্যান্টনমেন্ট থেকে বৃষ্টির মধ্যে গাড়িতে ফেরার সময় ইসলামপুরে গাছের সাথে গাড়ি ধাক্কা লেগে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন এই বীর যোদ্ধা। তাঁর মরদেহ নিয়ে আসা হয় শিবগঞ্জের ঐতিহাসিক সোনামসজিদ চত্বরে। সেখানেই তাকে দাফন করা হয়।  

সাহসী, রণকৌশলী, সদালাপি মেজর নাজমুল হক সাদাসিধে জীবনযাপন করতেন। প্রতিনিয়ত খোঁজ-খবর নিতেন মুক্তিযোদ্ধাদের। দিতেন উৎসাহ অনুপ্রেরণা। মেজর নাজমুল হকের মৃত্যুর পর ৭ নম্বর সেক্টরের দায়িত্ব নেন সুবেদার মেজর এম.এ রব এবং পরে লেফটেন্যান্ট কর্নেল কাজী নুরুজ্জামান। মেজর নাজমুল হক মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলেও তাঁকে দেওয়া হয়নি রাষ্ট্রীয় কোনো সম্মাননা পদক। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক ইতিহাস লেখা হলেও সেখানে তাঁর অবদানের কথা নেই বললেই চলে।

বীর মুক্তিযোদ্ধাদের দাবি, সেক্টর কমান্ডার মেজর নাজমুল হককে দেওয়া হোক যথাযোগ্য স্বীকৃতি ও মর্যাদা। ইতিহাসে তুলে ধরা হোক তাঁর অবদানের কথা। মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান জাতি কখনোই ভুলবে না। জাতির এই বীর সন্তানকে আজ জন্মভূমির মানুষ ভুলতে বসেছে-এটা দুঃখজনক।  

লেখক: গণমাধ্যম কর্মী

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।