ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

নারী সমাজের প্রেরণার উৎস বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা

মফিদা বেগম, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০১৬ ঘণ্টা, আগস্ট ৭, ২০২১
নারী সমাজের প্রেরণার উৎস বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা

বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা যেমন বাঙালির অহংকার তেমনি বাংলাদেশের নারী সমাজের প্রেরণার উৎস। আমরা বিশিষ্ট ব্যক্তিদের লেখা ও স্মৃতিচারণ থেকে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি পদক্ষেপে বঙ্গমাতার বহুমাত্রিক ভূমিকার বিষয়ে জেনেছি।

তবে বাংলাদেশের নারী সমাজের বর্তমান অগ্রগতির পেছনে বঙ্গমাতার বিশেষ ভূমিকার বিষয়টি সকলের অজানা রয়ে গেছে। বঙ্গমাতার ৯১তম জন্মবাষির্কীতে এই মহিয়সী নারীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে বাংলাদেশের নারী সমাজের অগ্রগতিতে তাঁর ভূমিকা বিশ্লেষণ করার প্রয়াস নিয়েই আমার আজকের লেখা।

প্রাকৃতিক ভাবে নারী-পুরুষের মাঝে শারীরিক পার্থক্য রয়েছে। এই পার্থক্য মানব সভ্যতার দুটি ধারার বৈশিষ্ট্য। এর কোন পরিবর্তন হয়না। কিন্তু সামাজিক ভাবে নারী-পুরুষের পার্থক্য নারী-পুরুষের সমতাকে বিপর্যস্ত করে। এতে মানবিক বোধ যেমন ক্ষতিগ্রস্থ হয় তেমনি বঞ্চিত হয় সুষম জীবন যাপনের স্বপ্ন। মানব সভ্যতার হাজার বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় নারীর উপর নানা রকম বঞ্চনা করে নারীকে দমিয়ে রাখা হয়েছে। নারীরা সেই  নিপিড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে আজ এগিয়ে যাচ্ছে এবং সমাজ ও রাষ্ট্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

ভারতবর্ষের নারীদেরও অধিকার থেকে বঞ্চিত করে তাদেরকে পিছিয়ে রাখার সামাজিক রীতি প্রচলিত ছিল দীর্ঘদিন। মুসলিম মেয়েদের শিক্ষাসহ সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়া। এরই ধারাবহিকতায় অসাধারণ প্রজ্ঞার অধিকারী ফজিলাতুন নেছা মুজিব বাংলাদেশের নারী সমাজকে এগিয়ে নেয়ায় বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন।

১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট যখন ফজিলাতুন নেছার জন্ম হয়, তখন মেয়েদের স্কুলে যাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। ফজিলাতুন নেছার বাবা জহুরুল হক চাকুরী করতেন। তিনি অত্যন্ত দূরদৃষ্টি সম্পন্ন শৌখিন মানুষ ছিলেন। তিনি সব সময় বলতেন আমার দুই মেয়েকে বিএ পাশ করাবো। সে সময় টুঙ্গিপাড়া থেকে ঢাকা যেতে সময় লাগত ২২ থেকে ২৪ ঘন্টা। টুঙ্গিপাড়ার মতো অজোপাড়াগাঁয়ে বসে মেয়েদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করার চিন্তা করাটা অনেক বড় মনের পরিচয় বহন করে। ফজিলাতুন নেছার বয়স যখন তিন বছর তখন তাঁর বাবা মারা যান। তাঁর দাদা ফজিলাতুন নেছাকে চাচাতো ভাইয়ের ছেলে শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে তাঁকে বিয়ে দেন। একে তো  মেয়েদের পড়াশুনা নিষিদ্ধ, তার উপর বাল্য বিয়ে সব মিলিয়ে ফজিলাতুন নেছার পড়াশুনার দ্বার রুদ্ধ হবে এমনটাই স্বাভাবিক। কিন্তু পড়াশুনার প্রতি যাঁর রয়েছে অদম্য আগ্রহ তাঁকে দমায় কে?

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লেখা থেকে আমরা জানতে পারি মেয়েদের স্কুলে যাওয়া নিষিদ্ধ ছিল, আর ওই এলাকাতে কোন স্কুল ছিলনা। তিনি মিশনারী স্কুল থেকে প্রাথমিক  শিক্ষা গ্রহন করেন। এর পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মা-বাবা টুঙ্গিপাড়া স্কুলের প্রধান শিক্ষককে গৃহ শিক্ষক হিসাবে বাড়িতে রেখে ফজিলাতুন নেছাকে লেখাপড়া শেখান। পড়াশুনার প্রতি ফজিলাতুন নেছার অদম্য আগ্রহ থাকায় প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চ শিক্ষা গ্রহন না করেও স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হন। তিনি প্রচুর বই পড়তেন। অল্প বয়সেই বঙ্কিম চন্দ্র, রবীন্দ্র নাথ, শরৎচন্দ্র ও কাজী নজরুল সহ বিভিন্ন লেখকের বই আগ্রহ নিয়ে পড়েছেন। প্রতিদিন খবরের কাগজ পড়তেন এবং প্রতিটি খবর বিশ্লেষণ করতেন। এভাবেই নারী শিক্ষায় নানা প্রতিকূলতার মাঝেও এই সাহসী নারী নিজেকে শিক্ষিত করে তোলেন।  

ফজিলাতুন নেছার বড় মেয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘স্মৃতি বড় মধুর, স্মৃতি বড় বেদনার’ প্রবন্ধ থেকে বঙ্গমাতার শিক্ষানুরাগের কথা জানা যায়। তিনি লিখেছেন, ‘১৯৪৯ সাল থেকে আব্বা যতবার জেলে গেছেন কয়েকখানা নির্দিষ্ট বই সব সময় আব্বার সঙ্গে  থাকত। মা প্রচুর বই কিনতেন আর জেলে পাঠাতেন। মার সাথে আমরাও নিউ মার্কেটে যেতাম। বই পছন্দ করতাম, নিজেরাও কিনতাম। আমাদের বাসায় সব সময় বই কেনা ও বই পড়ার রেওয়াজ ছিল। বেশীর ভাগ বই আব্বা জেল খানার লাইব্রেরীতে দান করে দিতেন। কিন্তু মার অনুরোধে কয়েকটা বই আব্বা কখনো দিতেন না, সঙ্গে নিয়ে আসতেন। এর মধ্যে ছিল রবীন্দ্র রচনাবলী, বার্নার্ড শ, রাসেল, শেলীর কীটস এই বইগুলিতে জেলখানার সেন্সর করার সিল দেয়া ছিল। মা বই কয়টা খুব যত্ন করে রাখতেন। আব্বা জেল থেকে ছাড়া পেলেই খোঁজ নিতেন বইগুলি এনেছেন কিনা’।

তিনি নিজে যেমন বই পড়ে সমৃদ্ধ হয়েছেন, তেমনি সন্তানদেরও বই পড়ার প্রতি আগ্রহী করে তুলেছেন। আর এই কারণেই তিনি বাংলাদেশের ক্রান্তিকালে দুর্বার সাহসে দূরদর্শী সিদ্ধান্ত গ্রহন করতে সক্ষম হয়েছেন। বাংলাদেশের নারী সমাজের কাছে এটা একটা অনুকরণীয় অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত।

একজন আদর্শ মা হিসেবে বঙ্গমাতার ভূমিকা আমাদের কাছে অনুপ্রেরণা যোগায়। অভাব অনটন ও নানা প্রতিকূলতার মাঝেও তিনি সব সন্তানদের মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছেন। সন্তানদের সামান্যতম বিলাসিতা শিখাননি। এ কারণেই তাঁর সন্তানেরা আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠেছেন। বর্তমান যুগের অনেক মায়েরাই সন্তানদের সঠিক শিক্ষা দিতে পারেননি বলে তরুণ প্রজন্ম নানা ধরনের অসামাজিক কর্মকান্ডে লিপ্ত হচ্ছে।  

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সাফল্যেও মহিয়সী নারী বঙ্গমাতার উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। বঙ্গবন্ধু জেলে থাকায় ৬দফা ও ১১ দফার আন্দোলনে তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। রাজনৈতিক কারণে বঙ্গবন্ধু বেশীরভাগ সময় কারাগারে বন্দী থাকতেন। এ দুঃসহ সময়ে তিনি হিমালয়ের মত অবিচল থেকে স্বামীর কারামুক্তির জন্য উকিল ঠিক করে মামলা পরিচালনা করা সহ দলের সাংগঠনিক কাজে পরামর্শ ও সহযোগীতায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। বঙ্গমাতা ১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের নেপথ্যে ছিলেন বঙ্গমাতা  ফজিলাতুন নেছা।  

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের সাথে জড়িয়ে বঙ্গমাতাও বার বার হয়রানীর শিকার হয়েছেন, গৃহবন্দী থেকেছেন। তিনি গভীর অনিশ্চয়তা ও শঙ্কার মাঝেও অসীম ধৈর্য, সাহস ও বিচক্ষণতার সাথে পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছেন। বঙ্গবন্ধু “অসমাপ্ত আত্মজীবনী” গ্রন্থে বঙ্গমাতার প্রতি বঙ্গবন্ধুর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “রেণু আমার সব দুঃখ কষ্ট, অভাব-অনটন, কারাবরণ হাসিমুখে মেনে নিতে না পারলে আমি বঙ্গবন্ধু হতে পারতাম না। ” 

ফজিলাতুন নেছা নারীদের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করতে উদ্বুদ্ধ করতেন। বাংলাদেশের নারীদের রাজনীতিতে অংশগ্রহন বৃদ্ধির জন্য তিনি ১৯৬৯ সালের আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান মহিলা আওয়ামী লীগ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছার প্রচেষ্টায় ১৯৭০ সালের পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ নুরজাহান, বেগম বদরুনন্নেসা আহম্মেদ ও সাজেদা চৌধুরী  নির্বাচনী পর্যবেক্ষক এর দায়িত্ব পালন করেন এবং তিনি নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারীদের প্রার্থী করতে উদ্বুদ্ধ করেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত অনেক নারীকেই বঙ্গমাতা রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে উৎসাহিত করেছেন বলেই আজ নারীরা দেশসেবায় আত্মনিয়োগ করতে পেরেছে।  

বিশ্বজুড়ে যুদ্ধকালীন সময়ে নারীদের অবদান নানাভাবে মূল্যায়িত হয়। তাঁরা যোদ্ধা হিসেবে যেমন মূল্যায়িত হন, তেমনি যৌন নির্যাতনের শিকার হন বলে সমাজের কাছে হেয়ও হন। কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর সরকার নারী-পুরুষের অবদানকে সমানভাবে মূল্যায়ন করা হয়েছে। নারী-পুরুষ যোদ্ধা হিসেবে সমান মর্যাদা পেয়েছে। বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা স্বাধীনতা যুদ্ধে আত্মত্যাগী, লাঞ্চিতা মা-বোনদের পাশে দাঁড়ান। তিনি তাঁদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করাসহ ব্যক্তিগতভাবে তাঁদের পাশে গিয়ে সান্ত্বনা দেন এবং সামাজিক ভাবে তাঁদের প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি যুদ্ধে লাঞ্চিত মেয়েদের বিয়ের ব্যবস্থা করে তাঁদের সামাজিক মর্যাদাপূর্ণ জীবন দান করে জীবনের আলোর সন্ধান দেন এবং মুখে হাসি ফোটান। এভাবেই তিনি স্বাধীন দেশের নারী উন্নয়ন ও নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে কাজ করেছেন।

বঙ্গমাতার আদর্শে বেড়ে উঠা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের গৃহীত কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশের নারীরা আজ রাষ্ট্রের দায়িত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হয়ে দেশ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠার সাফল্যে বাংলাদেশ আজ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের নারীদের সাফল্যের ভূয়সী প্রশংসা করেছে এবং এর স্বীকৃতি স্বরূপ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে নানা পুরস্কারে ভূষিত করেছে।

বঙ্গমাতা ছিলেন নির্লোভ, নিরহঙ্কার ও পরোপকারী। পার্থিব বিত্ত-বৈভব বা ক্ষমতার জৌলুস কখনো তাঁকে আকৃষ্ট করতে পারেনি। রাষ্ট্রপতির স্ত্রী হয়েও তিনি সব সময় অনাড়ম্বর জীবন যাপন করতেন। বঙ্গমাতার এই গুণাবলীগুলি বাঙালি নারীর পথ চলার ক্ষেত্রে আদর্শ  হবে।

বঙ্গমাতা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর সহযোদ্ধা,বন্ধু, পরামর্শদাতা, জীবনসঙ্গী, নির্ভরতা ও ভালোবাসার শেষ ঠিকানা। আমরাও বঙ্গমাতার এই আদর্শকে ধারণ করে স্বামীর সহযোদ্ধা ও নির্ভরতার শেষ ঠিকানা হয়ে সুখী-সুন্দর জীবন তথা সমাজ গড়তে পারি।

বঙ্গমাতার দূরদর্শী চেতনাবোধ সমাজের আকক্সক্ষার স্বপ্ন পূরণ  ঘটিয়েছে। এই প্রজন্ম তাঁর কর্ম থেকে দেশ ও জাতির ক্রান্তিকালে সঠিকভাবে এগিয়ে যাওয়ার দিক নির্দেশনা কিভাবে সাহসের সাথে উপস্থাপন করতে হয় সেটা শিখবে এবং দীপশিখার মত বঙ্গমাতার আদর্শ তাঁদের পথ দেখাবে।

বঙ্গমাতা আমাদের মাঝে না থাকলেও তাঁর রেখে যাওয়া আদর্শ সব সময় আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কাল রাতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সহ পুত্র-পুত্রবধু ও নিকট আত্মীয়ের সাথে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা ধানমন্ডির নিজ বাস ভবনে স্বাধীনতা বিরোধী ঘাতকচক্রের হাতে নির্মম ভাবে শহিদ হন। বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা সহ ১৫ আগস্ট নিহত সকল শহিদদের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।


লেখক: সদস্য, জাতীয় নারী ও শিশু উন্নয়ন পরিষদ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।