ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা: সর্বংসহা সংগ্রামী নারী

কামাল চৌধুরী, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০২৫ ঘণ্টা, আগস্ট ৭, ২০২১
বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা: সর্বংসহা সংগ্রামী নারী

মানব ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে সমাজবদল বা পরিবর্তনের কুশীলব হিসাবে নারীরা তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। রাজনীতি, যুদ্ধ-বিগ্রহ, শিল্প-সাহিত্য, সমাজসেবা সকল ক্ষেত্রেই অবদান রেখেছেন নারীরা।

কিন্তু এই ইতিহাসের সত্য যে সকল ক্ষেত্রে নারীর এই ভূমিকা স্পষ্ট হয়নি বা প্রত্যক্ষ করা যায়নি। অনেকের ভূমিকা অন্তরালে থেকে গেছে। বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছার ভূমিকাও তাঁর মৃত্যুর আগে অনেকাংশে অন্তরালে ছিল। আমাদের জাতীয় ইতিহাসে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আন্দোলন-সংগ্রামের একজন অবিচল সহযোদ্ধা হিসাবে, সর্বংসহা নারী হিসাবে তিনি যে ভূমিকা পালন করেছেন তা আজ ক্রমাগত স্পষ্ট হচ্ছে- উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হচ্ছে।  

তাঁর অনেক তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকার মধ্যে একটি বিশেষ ভূমিকার কথা আমি শুরুতে উল্লেখ করতে চাই। সেটি হলো লেখক বঙ্গবন্ধুকে আমরা যে পেয়েছি-এর পেছনে তাঁর অবদান। বঙ্গবন্ধুকে তিনি লেখার জন্য উৎসাহ দিয়েছেন, অসমাপ্ত আত্মজীবনীর শুরুতেই তার বিবরণ আছে। লেখার জন্য খাতা কিনে বঙ্গবন্ধুকে সরবরাহ করেছেন, বঙ্গবন্ধু জেল থেকে বের হলে সংগ্রহ করে রেখেছেন খাতাগুলো। মূলত তাঁর প্রবল উৎসাহের কারণে আমরা লেখক বঙ্গবন্ধুকে পেয়েছি। এ নিয়ে বঙ্গবন্ধু অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন:

আমার সহধর্মিণী একদিন জেলগেটে বসে বলল, “বসেই তো আছ, লেখ তোমার জীবনের কাহিনী। ” বললাম, “লিখতে যে পারি না; আর এমন কি করেছি যা লেখা যায়! আমার জীবনের ঘটনাগুলি জেনে জনসাধারণের কি কোনো কাজে লাগবে? কিছুই তো করতে পারলাম না। শুধু এইটুকু বলতে পারি, নীতি ও আদর্শের জন্য সামান্য একটু ত্যাগ স্বীকার করতে চেষ্টা করেছি। ”

একদিন সন্ধ্যায় বাইরে থেকে তালা বন্ধ করে দিয়ে জমাদার সাহেব চলে গেলেন। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ছোট্ট কোঠায় বসে বসে জানালা দিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে ভাবছি, সোহরাওয়ার্দী সাহেবের কথা। কেমন করে তাঁর সাথে আমার পরিচয় হল। কেমন করে তাঁর সান্নিধ্য আমি পেয়েছিলাম।

হঠাৎ মনে হল লিখতে ভাল না পারলেও ঘটনা যতদূর মনে আছে লিখে রাখতে আপত্তি কি? সময় তো কিছু কাটবে। বই ও কাগজ পড়তে পড়তে মাঝে মাঝে চোখ দুইটাও ব্যথা হয়ে যায়। তাই খাতাটা নিয়ে লেখা শুরু করলাম। আমার অনেক কিছুই মনে আছে। স্মরণশক্তিও কিছুটা আছে। দিন-তারিখ সামান্য এদিক ওদিক হতে পারে, তবে ঘটনাগুলি ঠিক হবে বলে আশা করি। আমার স্ত্রী যার ডাক নাম রেণু আমাকে কয়েকটা খাতাও কিনে জেলগেটে জমা দিয়ে গিয়েছিল। জেল কর্তৃপক্ষ যথারীতি পরীক্ষা করে খাতা কয়টা আমাকে দিয়েছেন। রেণু আরও একদিন জেলগেটে বসে আমাকে অনুরোধ করেছিল। তাই আজ লিখতে শুরু করলাম। ১

শেখ হাসিনা লিখেছেন:
আমার মায়ের প্রেরণা ও অনুরোধে আব্বা লিখতে শুরু করেন। যতবার জেলে গেছেন, আমার মা খাতা কিনে জেলে পৌঁছে দিতেন, আবার যখন মুক্তি পেতেন তখন খাতাগুলো সংগ্রহ করে সযত্নে রেখে দিতেন। তাঁর এমন দূরদর্শী চিন্তা যদি না থাকতো তাহলে এ মূল্যবান লেখা আমরা জাতির কাছে তুলে দিতে পারতাম না। ২

এর মাধ্যমে শেখ ফজিলাতুন নেছা আমাদের ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রেও তাৎপর্যময় ভূমিকা রেখেছেন। আজ যখন বঙ্গবন্ধুর লেখা আমরা পাঠ করি- ইতিহাসের অনেক তথ্য ও বিবরণ অনুপুঙ্খভাবে পাই। এতে আমাদের ইতিহাসের অনেক অস্পষ্টতা কেটে গেছে। অনেকের এতদিনের মনগড়া আলোচনা গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে এখন।

তবে এজন্য তাঁর কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিশেষ ধন্যবাদ জানাতে হয়। মহীয়সী মাতা যেমন গভীর মমতায় বঙ্গবন্ধুকে কারাগারের নিঃসঙ্গ জীবনে লেখায় উৎসাহ দিয়েছেন, বঙ্গবন্ধুর লেখা সংরক্ষণ করার চেষ্টা করেছেন, তেমনি শেখ হাসিনাও এইগুলো প্রকাশ করে, সেই সঙ্গে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে পুলিশী গোপনীয় প্রতিবেদন প্রকাশ করে আমাদের কৃতজ্ঞ করেছেন। ৩ বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবের জন্মদিন উদ্যাপন অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনার স্মৃতিচারণ থেকেও এ স¤পর্কে আমরা অনেক তথ্য পাই:

’৫৮ সালে যখন আব্বা গ্রেপ্তার হয়ে গেলেন, তারপরে ’৬০ সালে তিনি মুক্তি পান। সেই সময় যেহেতু আইয়ুব খানের মার্শাল ল, আব্বার প্রায় ৬ খানা খাতা তারা নিয়ে রাখল, দিল না। আমার মা নিজে জেলগেটে গেলেন খাতাগুলির খোঁজ করতে আব্বাকে মুক্তি দিলে নিয়ে আসার সময় খাতাগুলি দিল না। ওরা নিয়ে গেল। তখন ছিল ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ আইবি অফিস, এখন যেটা এসবি অফিস। আমার মা কিন্তু হাল ছাড়েননি, আমার চাচা, আব্বার ফুফাতো ভাই খোকা কাকা আমাদের সঙ্গে ছিলেন। ঐ খোকা কাকাকে বারবার পাঠাতেন। ভাই একটু যা দেখ তো, আমাদের খাতাগুলি দেবে না কেন? তারপর একটা পর্যায় যাওয়ার পরে তাঁরা চারখানা খাতা দিল আর দু’খানা খাতা বাজেয়াপ্ত করল। সেই খাতাগুলি দিল না। ঐ ৪ খানা খাতা দিল এবং আমার মা কিন্তু প্রতিবারই ঐ খাতাগুলি নিজে সংগ্রহ করে রাখতেন। ৪

আমার মাকে দেখেছি সব সময় আব্বাকে বই দিতেন। কতগুলি বই আবার খুব প্রিয় ছিল। কিছু বই উনি নিয়মিত দিতেন। একটা ছিল নজরুলের, রবীন্দ্রনাথের রচনাবলি, তারপরে বার্নার্ড ‘শর হোল ওয়ার্ল্ডস অব বার্নার্ড শ’। এছাড়া রবীন্দ্রনাথের, নজরুলের লেখা, এরকম বেশ কিছু বই, ঐ বইগুলি যতবার আব্বা জেলে যেতেন, কয়েকখানা বই ছিল মা নিয়মিত দিতেন। তা আমরা তখন বুঝতে পারিনি যে কেন নিয়মিত এই বইগুলি আবার পাঠান। পরে যখন বড় হলাম তিনিই দেখালেন যে দেখ তোমার আব্বা যতবার জেলে যাচ্ছেন এই বই পাঠালে তারা সেন্সর করছে, সেন্সরের একটা সিল আর তারিখটা ওখানে লেখা থাকত এবং ঐজন্য তিনি কয়েকখানা বই ছিল, ওটা বারবারই পাঠাতেন। ৫

যথার্থ অর্থেই বেগম মুজিবকে সর্বংসহা মনে হয়। বঙ্গবন্ধুর লেখা গ্রন্থসমূহ পাঠ এবং সেইসঙ্গে গোয়েন্দা পুলিশের গোপনীয় প্রতিবেদন পাঠে অবাক হতে হয়। শেখ মুজিব রাজনীতি করতে গিয়ে যে ত্যাগ স্বীকার করেছেন, জেল-জুলুম-নির্যাতন স্বীকার করেছেন সেটি তাঁর পরিবারের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। বেগম মুজিব অসীম ধৈর্য ও সহনশীল মন নিয়ে সংসার সামলেছেন, কন্যা-পুত্রদের যত্ন নিয়েছেন, সেইসঙ্গে রাজনীতির সার্বিক পরিস্থিতির প্রতি রেখেছেন গভীর দৃষ্টি। বঙ্গবন্ধু কারাগারে থাকা অবস্থায় সপরিবারে বারবার কারাগারে দেখা করতে গেছেন। স্বামীকে সাহস দিয়েছেন, বিভিন্ন খবরা-খবর দিয়েছেন। তখনকার পরিস্থিতিতে এ ধরনের যাতায়াত সহজ ছিল না, অধিকন্তু গোয়েন্দা নজরদারি ছিল সার্বক্ষণিক। শেখ হাসিনা স্মৃতিচারণ করেছেন:

মা শুধু খবরই শুনতেন যে এই অবস্থা, কাজেই স্বামীকে তিনি খুব কম সময়ই কাছে পেতেন। আমি যদি আমাদের জীবনটার দিকে ফিরে তাকাই এবং আমার বাবার জীবনটা যদি দেখি, কখনও একটানা দুটি বছর আমরা কিন্তু বাবাকে কাছে পাইনি। কাজেই স্ত্রী হিসেবে আমার মা ঠিক এভাবে বঞ্চিত ছিলেন। কিন্তু কখনও কোনদিন কোন অনুযোগ-অভিযোগ তিনি করতেন না। তিনি সব সময় বিশ্বাস করতেন যে, তাঁর স্বামী দেশের জন্য কাজ করছেন, মানুষের জন্য কাজ করছেন, যে কাজ করছেন তা মানুষের কল্যাণের জন্য করছেন। মায়ের দাদা যে সম্পত্তি দিয়ে গেছেন প্রচুর জমিজমা। জমিদার ছিলেন। সব স¤পত্তি মা’র নামে। এর থেকে যে টাকা আসতো আমার দাদা সবসময় সে টাকা মার হাতে দিয়ে দিতেন। একটি টাকাও মা নিজের জন্য খরচ করতেন না, সব জমিয়ে রাখতেন। কারণ জানতেন যে, আমার বাবা রাজনীতি করেন, তাঁর টাকার অনেক দরকার, আমার দাদা-দাদি সবসময় দিতেন। দাদা সবসময় ছেলেকে দিতেন, তার পরেও মা তাঁর ওই অংশটুকু, বলতে গেলে নিজেকে বঞ্চিত করে টাকাটা বাবার হাতে সবসময়ই তুলে দিতেন। এভাবেই তিনি সহযোগিতা শুরু করেন। তখন কতইবা বয়স। ৬

১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়ী হলে শেখ মুজিব সর্বকনিষ্ঠ মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। ১৫ মে মাসেই শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। কিন্তু ৩০ই মে কেন্দ্রীয় সরকার ষড়যন্ত্রমূলকভাবে ৯২ (ক) ধারা জারি করে মন্ত্রিসভা বাতিল করে দেয়। শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে। শেখ মুজিব মন্ত্রী হওয়ার পর পরিবার নিয়ে মিন্টু রোডের তিন নম্বর বাসায় উঠেছিলেন। ১৪ দিনের মাথায় তাদের বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয় সে দুঃসময়ের স্মৃতিচারণ করেছেন শেখ হাসিনা তাঁর বক্তৃতায়:

মন্ত্রী থাকা অবস্থায় ওই বাসায় মানুষে মানুষে গমগম করত, কিন্তু ওইদিন সব ফাঁকা। আমার আব্বার ফুফাতো ভাই, আমার এক নানা, তাঁরা এলেন, বাড়ি খোঁজার চেষ্টা। নাজিরাবাজারে একটি বাড়ি পাওয়া গেল, সে বাসায় আমাদের নিয়ে উঠলেন। এভাবেই একটার পর একটা ঘাত-প্রতিঘাত এসেছে। কিন্তু একটা জিনিস আমি বলব যে, আমার মাকে আমি কখনও ভেঙে পড়তে দেখিনি। যত কষ্টই হোক আমার বাবাকে কখনও বলেননি যে তুমি রাজনীতি ছেড়ে দাও বা চলে আসো বা সংসার করো বা সংসারের খরচ দাও। কখনও না।

সংসারটা কীভাবে চলবে স¤পূর্ণভাবে তিনি নিজে করতেন। কোনদিন জীবনে কোন প্রয়োজনে আমার বাবাকে বিরক্ত করেননি। মেয়েদের অনেক আকাক্সক্ষা থাকে স্বামীদের কাছ থেকে পাওয়ার। শাড়ি, গয়না, বাড়ি, গাড়ি, কত কিছু। এত কষ্ট তিনি করেছেন জীবনে কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলেননি। চাননি। ৭

১৯৫৫ সালে বঙ্গবন্ধু আবার মন্ত্রী হয়েছিলেন কিন্তু সংগঠন পরিচালনার স্বার্থে তিনি মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করেছিলেন। কোনো অনুযোগ করেননি বেগম মুজিব। আইয়ুব খানের মার্শাল ল জারির পর তিনি আবার গ্রেফতার হন। তখনও ৬ দিনের মাথায় তাঁর পরিবারকে বাড়ি ছেড়ে দিতে হয়। অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে সে অবস্থা সামাল দিয়েছেন বেগম মুজিব।

বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ সালে বাঙালির মুক্তির সনদ ঐতিহাসিক ৬-দফা দাবি উত্থাপনের পর সারা বাংলাদেশে এর পক্ষে ব্যাপক গণসংযোগ করেন। ভীত পাকিস্তানি সরকার বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে। এ প্রেক্ষাপটে আসে ৭ই জুন। বঙ্গবন্ধুসহ নিরাপত্তা বন্দীদের মুক্তির দাবিতে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। পুলিশের গুলিতে মনু মিয়াসহ ১১ জন শহিদ হন তাতে। এ হরতাল পালনের নেপথ্যে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন বেগম মুজিব।

তিনি শুধু গৃহিণীর দায়িত্ব পালন করেননি, প্রবলভাবে ছিলেন রাজনীতি সচেতন। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তিনি নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। বাড়িতে রান্না করে খাওয়াতেন। আমরা সবাই জানি বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি শক্তি ছিল অসাধারণ। শেখ হাসিনা আমাদের জানিয়েছেন যে তার মায়ের স্মৃতিশক্তিও ছিল টেপ রেকর্ডারের সঙ্গে তুলনীয়। জেলখানায় গিয়ে পরিস্থিতি সম্পর্কে জানানো, প্রয়োজনীয় নির্দেশ নিয়ে আসা, আওয়ামী লীগ ছাত্রলীগকে সেভাবে কাজে লাগানো সবই তিনি করতেন।

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বেগম মুজিবের উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা সম্পর্কে আমরা জানতে পারি শেখ রেহানার লেখা থেকে। ১৯৬৮ সালের ৩রা জানুয়ারি পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে এক নম্বর আসামী করে মোট ৩৫ জন বাঙালি সেনা ও সিএসপি অফিসারের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে। ১৭ই জানুয়ারি তাঁকে জেল থেকে মুক্তি দিয়ে পুনরায় জেলগেট থেকে গ্রেফতার করে ঢাকা সেনানিবাসে আটক রাখা হয়। ৮ পরিবারের সদস্যরা এ খবর জানেন না। বেগম মুজিব সন্তানদের নিয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে গেলেন দেখা করতে। গিয়ে জানলেন তাঁকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে জেলের লোকজনও বলতে পারছে না। শেখ রেহানা লিখেছেন:

তারপর একদিন আমরা গেছি জেলগেটে। যথারীতি দেখার জন্য অনুমতি নেওয়া আছে। আমরা পাঁচ ভাইবোন, মা। জেলের লোকেরা বলে, “উনি তো জেলে নাই। ” জেলে নাই কোথায় আছেন? তারা বলে, “আমরা জানি না, উনি কোথায় আছেন। ” মার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। সীমাহীন শঙ্কায় উদ্বেগে আমরা কাতর হয়ে পড়লাম। মা ৩২ নম্বরের বাড়ির গেটের ভিতরে ঢুকেই মাটিতে বসে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কাঁদতে লাগলেন। সে যে কী কান্না মা’র! এত কাঁদতে আমি মাকে আর কখনো দেখিনি। তারপরতো খবর এলো, আব্বাকে ক্যান্টনমেন্টে রাখা হয়েছে। ৯

বঙ্গবন্ধুকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল, আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মী চেয়েছিলেন প্যারোলে মুক্তি নিয়ে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানে গোলটেবিল বৈঠকে যাবেন। কিন্তু বেগম মুজিব রাজি ছিলেন না। আমরা শেখ হাসিনার স্মৃতিচারণ থেকে জানি তাঁর মাধ্যমে বেগম মুজিব বঙ্গবন্ধুকে লিখে পাঠিয়েছিলেন প্যারোলে মুক্তি না নিতে।  

বেগম মুজিবের এ অনমনীয় ভূমিকা নিয়ে অনেক লেখা হয়েছে। ফয়েজ আহমেদ১০, এবিএম মূসাসহ১১ বিভিন্ন জনের লেখায় এ ঘটনা সম্পর্কে বর্ণনা আছে। জি ডব্লিউ চৌধুরীর১২ গ্রন্থেও আমরা এর উল্লেখ পাই। ঘটনাটি এখন কিংবদন্তীর রূপ নিয়েছে বিধায় বিভিন্ন জন বিভিন্নভাবে ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন। তবে এ স¤পর্কে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্য আমরা পাই শেখ হাসিনার বিভিন্ন বক্তব্য ও লেখায়। কারণ ঢাক ক্যান্টনমেন্টে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে মায়ের ম্যাসেজ শেখ হাসিনা পৌঁছে দিয়েছিলেন।  
শেখ হাসিনা এ সম্পর্কে লিখেছেন:

আমি যখন ফিরে এলাম অনেকে আমার সাথে আমাদের বাড়িতে ফিরে এলেন এবং আমার মাকে দোষারোপ করলেন। তারা ভয় দেখাচ্ছিলেন যে, আপনি এত কঠিন, আপনি জানেন না যে ওনাকে ফাঁসি দেবে, ফাঁসি দিয়ে মেরে ফেলবে। আমার মা বলেছিলেন যে, “বিধবা হলে তো আমিই হবো আর পিতা হারালে আমার সন্তানরা হারাবে। আপনারা ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? সারা বাংলাদেশের মানুষের আশা-আকাক্সক্ষাকে পদদলিত করে তিনি প্যারোলে যেতে পারেন না। ”১৩ বঙ্গবন্ধু যদি প্যারোলে মুক্তি নিতেন তাহলে তাঁর সারাজীবনের আপসহীনতার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হতো। আইয়ুব বিজয়ী হতেন। বেগম মুজিব রাজনীতির গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে সম্যক অবহিত ছিলেন। তিনি জানতেন জনগণ শেখ মুজিবের পক্ষে তাঁকে মুক্তি না দিয়ে গত্যন্তর নেই। তিনি অনেক নেতার মতামতের সঙ্গে একমত হননি। বেগম মুজিব তুচ্ছ করেছেন সব ভয়। এই দৃঢ় মনোবল, দূরদর্শিতা ও সাহস তাঁর চরিত্রের অসাধারণ বৈশিষ্ট্য।

অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধুও তাঁকে নিয়ে বেগম মুজিবের উদ্বেগ সম্পর্কে লিখেছেন:
রেণু আমাকে যখন একাকি পেল, বলল, জেলে থাক আপত্তি নেই। তবে স্বাস্থ্যের দিকে নজর রেখ। তোমাকে দেখে আমার মন খুব খারাপ হয়ে গেছে। তোমার বোঝা উচিত আমার দুনিয়ায় কেউ নাই। ছোটবেলায় বাবা-মা মারা গেছেন, আমার কেউই নাই। তোমার কিছু হলে বাঁচবো কি করে? কেঁদেই ফেলল। ১৪

কারাগারের রোজনামচা পাঠে আমরা দেখি প্রতি মাসে দুই-তিনবার তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে কারাগারে গেছেন। এসব বর্ণনায় তাঁর প্রতি বঙ্গবন্ধুর গভীর ভালোবাসা ও অনুরাগের প্রতিফলন দেখা যায়।
১৯৬৬ সালের ২২শে জুন বঙ্গবন্ধু লিখেছেন:

আজ নাস্তা খেয়ে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম। কারণ বৃষ্টি হয়েছে। ১২টায় সিকিউরিটি জমাদার সাহেব এলেন, কিছু বাজার করতে হবে, বিস্কুট চাই, মুড়ি চাই, আমার বাড়িতে মুড়ি খাবার অভ্যাস। বাড়িতে দিলে পাঠাইয়া দিতো। কষ্ট দিতে ইচ্ছে হয় না বেচারীকে। সকল কিছুই তো তার করতে হয়, আমি তো মুসাফির। বাড়িতে আমি বেগম সাহেবার মুসাফির। এখানে সরকারের মুসাফির। ১৫

বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ছিল বাঙালির ইতিহাসে নব অধ্যায়ের সূচনা। সেই উত্তাল দিনগুলোতে বঙ্গবন্ধুর কাছে জাতির প্রত্যাশা ছিল পর্বতসম। অন্যদিকে যুদ্ধবাজ পাকিস্তানি সেনাদের হুমকি। এই কঠিন সময়ে ৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু কী বলবেন এ নিয়ে নানাজন নানা পরামর্শ দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু তখন কী পরিমাণ মানসিক চাপে ছিলেন তা সহজেই অনুমেয়। সে সময়ে বেগম মুজিব যে পরামর্শ দিয়েছিলেন কালের বিচারে ও ভাষণের তাৎপর্য বিচারে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

১৯৭১-এর ৭ই মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় যাওয়ার আগে দুপুরে খাওয়ার পরে আব্বা বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। আম্মা এবং আমি তাঁর সঙ্গে ছিলাম। সেদিন জাতির পিতা কী বলবেন- সে সম্পর্কে অনেকে অনেক পরামর্শ দেন। আম্মা বলেছিলেন, ‘তোমার চেয়ে বাংলার মানুষকে কে ভালো জানে। তোমার মন যা চায়- তুমি তাই বলবে। ’১৬

এরপরে আমরা দেখি স্বতঃস্ফূর্ত এক ঐতিহাসিক ভাষণ যার মাধ্যমে আমরা উপনীত হলাম স্বাধীনতা সংগ্রাম ও যুদ্ধে। পরবর্তীকালে, মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধু যখন পাকিস্তানের কারাগারে- দুই সন্তান শেখ কামাল, শেখ জামাল মুক্তিযুদ্ধে- বেগম মুজিব পরিবার নিয়ে পাকিস্তানিদের বন্দী দশায়। কিন্তু তিনি মনোবল হারাননি।
স্বামীর সহযাত্রী হিসাবে আন্দোলন সংগ্রামে ভূমিকা রাখা নারীদের মধ্যে মহাত্মা গান্ধীর স্ত্রী কস্তুরবাঈ, জওহরলাল নেহেরুর স্ত্রী কমলা নেহেরু, চিত্তরঞ্জন দাশের স্ত্রী বাসন্তী দেবী কিংবা নেলসন মে-েলার প্রাক্তন স্ত্রী উইনি মে-েলার কথা আমরা জানি। এরা সবাই ছিলেন রাজনীতিতে সক্রিয়, যাকে বলে অ্যাক্টিভিস্ট- আন্দোলন-সংগ্রামে প্রকাশ্যে অংশ নিয়েছেন। জেল খেটেছেন। কিন্তু বেগম মুজিবের ভূমিকা ছিল অন্তরালে- রাজনীতি সম্পর্কে ছিলেন প্রবলভাবে সচেতন, সেই সঙ্গে রাজনৈতিক বলয়ে প্রেরণাদাত্রীর ভূমিকা পালন করেছেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর মতামতকে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন- বঙ্গবন্ধুর বন্দীদশায় রাজনীতির গতি-প্রকৃতি স¤পর্কে খোঁজ রাখতেন। বঙ্গবন্ধুকে বাইরের অবস্থা সম্পর্কে অবহিত রাখতেন। তাঁর এই ভূমিকা ছিল অপ্রকাশ্য কিন্তু দ্ব্যার্থবোধক। তাঁর সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশের অন্য কোনো খ্যাতিমান রাজনীতিবিদের সহধর্মিনীর ক্ষেত্রে এ ধরনের উদাহরণ দেখা যায় না।  

বিভিন্ন ঘটনার বিশ্লেষণ থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাঁর অপ্রকাশ্য কিন্তু এই দৃঢ় ভূমিকা স¤পর্কে উপলব্ধি করা যায়। চিরকাল স্বামীর পাশে ছিলেন কিন্তু রাজনীতি ও ক্ষমতা তাঁর শ্বাশ্বত নারীর রূপটি বদলাতে পারেনি। তিনি প্রধানমন্ত্রীর সহধর্মিনী হয়ে অথবা রাষ্ট্রপতির পত্নী পরিচয়ে ফার্স্ট লেডি হতে চাননি। আটপৌরে জীবন যাপন করেছেন- ক্ষমতার জৌলুসের কাছে বিলীন হতে দেননি তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।
এবিএম মূসা লিখেছেন:

তিনি রাজনীতিতে নিবেদিত জননেতা স্বামীর দীর্ঘ রাজনৈতিক দুর্যোগপূর্ণ সময়ের সহযাত্রী ও সহমর্মী ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অংশীদার হওয়ার কোনো বাসনা তাঁর ছিল না। তারপরও স্বামীর জীবনযুদ্ধে, আদর্শের সংগ্রামে, এমনকি জনসম্পৃক্ততায় তাঁর একটি অপ্রকাশ্য ভূমিকা অবশ্যই ছিল। পারিবারিক জীবনে সুখ-দুঃখের ভাগীদার যেমন ছিলেন, তেমনি রাজনৈতিক জীবনে ছিলেন তাঁর আদর্শের ‘প্রেরণাদাত্রী বিজয়লক্ষ্মী নারী’। ১৭

বঙ্গবন্ধু ২৬শে মার্চ ১৯৭২ সালে প্রদত্ত ভাষণে বলেছিলেন, “যে নারী তার স্বামীকে এগিয়ে দেয় নাই, সে স্বামী জীবনে বড় হতে পারে নাই। ”১৮ বঙ্গবন্ধুর এ কথাটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। সম্ভবত বেগম মুজিবের ভূমিকার কথা মনে করে তিনি এ গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছিলেন। বেগম মুজিব একদিকে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ছায়াসঙ্গী, অন্যদিকে সহযোদ্ধা। শ্বাশ্বত নারীর প্রতিমূর্তিতে তিনি সহিষ্ণুতার যে অনন্য অভিজ্ঞান সৃষ্টি করেছেন তার ফলেই বঙ্গবন্ধুর পক্ষে সম্ভব হয়েছে ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ জীবনতরী পাড়ি দেওয়া।

অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছিল তাঁদের। বঙ্গবন্ধু পরিবারকে সময় দিতে পারেননি। জীবনের বহু বছর কাটিয়েছেন কারাগারে। বেগম মুজিব যদি ছায়াসঙ্গী হিসাবে আন্দোলন-সংগ্রাম ও কারাগারের সুকঠিন সময়ে বঙ্গবন্ধুকে সাহস ও শক্তি না যোগাতেন তাহলে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে রাজনীতিতে এরূপ ত্যাগ ও নিবেদন কঠিন হতো। বেগম মুজিব অন্তরালে থেকে এ মহান দায়িত্ব পালন করেছেন। পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুকে উৎসাহ দিয়েছেন, বইপত্র সরবরাহ করেছেন, লিখতে উৎসাহ দিয়েছেন। যে ইতিহাস বঙ্গবন্ধু নির্মাণ করেছেন বাঙালির জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে- তার নেপথ্যের সহযাত্রী হিসাবে বেগম মুজিবের ভূমিকাও আমাদের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।

সারাজীবন তিনি ছায়াসঙ্গী ছিলেন বঙ্গবন্ধুর। মৃত্যুতে শারীরিক বিচ্ছিন্নতা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর শেষ শয্যা হয়েছে টুঙ্গিপাড়ায়- বেগম মুজিব পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ে বনানী কবরস্থানে সমাহিত আছেন। শরীরকে হত্যা করা যায় কিন্তু আত্মাকে ধ্বংস করা যায়না। ১৯৭২ সালে ডেভিড ফ্রস্টের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আপনি একজন মানুষকে হত্যা করতে পারেন। সে তো তার দেহ। কিন্তু তার আত্মাকে কি আপনি হত্যা করতে পারেন? না, তা কেউ পারে না। ১৯

মৃত্যু তাঁদের ধ্বংস করতে পারেনি। বাঙালির হৃদয়ে তাঁরা মিশে আছেন শ্বাশ্বত স¤পর্ক ও সংগ্রামের সহযোদ্ধা হিসাবে।

লেখক: ড. কামাল আব্দুল নাসের চৌধুরী ওরফে কামাল চৌধুরী, কবি, প্রধান সমন্বয়ক, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্য সচিব।
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।