প্রিয় পাঁচ কবিতা
মা সিরিজ থেকে
০১
আমার মায়ের নাম গীতা রত্ন
মা প্রতিদিন মন্দিরে পবিত্র গীতা পাঠ করেন
আর আমি মাকে পাঠ করে নিজেকে মন্দির বানাই।
যে মন্দিরে ঈশ্বরের কোনো স্থান নেই।
১১
আমার মা এক মৃন্ময়ীবৃক্ষ
তার জীবিত শরীর জুড়ে উঁইপোকার বসবাস।
আমি সেই বৃক্ষে ক্রুশবিদ্ধ হয়ে গেঁথে আছি
আর টের পাচ্ছি-বিষাক্ত কামড়ের জ্বালা।
অথচ! উঁইপোকারা জানে না-
আমাদের কাঠ থেকে তৈরি হবে ম্যাচবাক্সের কাঠি।
৯৬
কোনো বিষধর সাপ ফণা তুলে দাঁড়ালে
প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে যায়?
অথচ! সাপদের কোনো প্রশ্নের উত্তর আজও মানুষের অজানা
তাই মানুষের সাথে সাপদের এত আড়ি।
আমার মা বলেন-
কোনো কোনো মানুষ সাপেরও অধিক
তাদের এক ছোবলে হাজার মানুষ মরে।
বস্তুত সাপদের কাছে মানুষের শেখা উচিৎ
এই আভিশাপ থেকে মানুষ কবে মুক্তি পাবে।
২১৩
মা আমাকে যে বিছানায় প্রসব করেছিলেন
সে বিছানায় আমি প্রস্রাব করেছি বহুবার।
কারণ আমাদের ঘর ও আঁতুড়ঘরের কোনো পার্থক্য নেই
এমন-কি আমার পিতা-মাতার বাসরঘর ছিলো ওই ঘর।
আমাদের সেই একটি ঘরের একটি রুমের একই বিছানায়
মা আমাদের কাটিয়ে দিলেন জীবনের পুরোটা সময়।
অথচ! আমরা যখন নতুন আরেকটি বাড়ি বানালাম
সেই নতুন বাড়ির উদ্বোধনের দিনে- মা আমাদের জানালো
তিনি আজই সন্ন্যাসে যাবেন, বুকের ভেতরে বহুদূরের পথ মাড়িয়ে।
আমাদের নতুন বাড়ির দিকে তাকিয়ে মা একবার হাসলেন
তারপর পা রাখলেন সন্ন্যাসের পথে।
মা আমাদের চলে যাচ্ছে-
বুকের ভেতরের গহীন জলে ঢেউ তুলে চলে যাচ্ছে।
মা আমাদের চলে যেতে যেতে ছোট হয়ে যাচ্ছে।
ও দখিনা বাতাস-তুমি আমাদের সন্ন্যাসী মাকে বলে দিও
আমরা তাকে কাঁদতে দেখেছি।
৩০২
হেমন্তের সকালে ঘুম থেকে জেগে দেখি-
মাকড়সার জালে ধরা পড়েছে ভোরের শিশিরবিন্দু,
এ যেন আমার মায়ের অশ্রুবিন্দু-মাকড়সা জালে।
প্রতিটি অশ্রুবিন্দুর মাঝে লুকিয়ে আছে-এক একটি সূর্য
আমি এতগুলো সূর্য-একসঙ্গে কখনো দেখিনি।
অথচ হেমন্তের অশ্রুবিন্দুরা কেন যে বোঝে না?
যাকে সে বুকে ধারণ করে-সেই তাকে শুষে নেবে।
হায় সূর্য-যে তোমাকে বুকে ধারণ করে।
তুমি তাকেই শুষে নেও।
কবিতার পেছনের গল্প
আমি নিজেকে যতটা কবি মনে করি তারও অধিক মনে করি কবিতা সংগ্রহকারী। আমি সাধারণত প্রাণীজগত, বস্তুজগত ও মনোজগত থেকে কবিতা সংগ্রহ করি। তাই আমার প্রতিটি কবিতার নেপথ্যে রয়েছে রহস্যময়ী গল্প। গল্প আমার কবিতার শিল্পপ্রাণ। যদিও আমি-বিভিন্ন কবিদের মহৎ কবিতা পাঠ করতে গিয়ে নিজেকে মূর্খকবি মনে হচ্ছে, আর টের পাচ্ছি কবিতার গভীরতা।
আমার ‘মা সিরিজ’ লেখার পিছনের গল্প খুবই ট্র্যাজেডিপূর্ণ। এই গল্পটি আমার ভাবতেই কষ্ট লাগে। ২০১৫ সালের জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের কোনো একদিন হবে (তারিখ মনে পড়ছে না), মা আমাকে রাত ৯টার দিকে ফোন করে জানালেন- তার মন খুবই খারাপ, কারণ তিনি প্রতিরাতে স্বপ্নে দেখেন, এদেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। তাই আমি যেনো সময়-সুযোগ করে দ্রুত বাড়ি চলে আসি। মায়ের ফোন পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি বিচলিত হয়ে পড়ি। আমি তখন শাহবাগে ছিলাম এবং সেই সময়েই মাকে জানিয়ে আমি বাড়ির পথে যাত্রা করি। শাহবাগ থেকে রাত সাড়ে ৯টায় আমি গুলিস্তানে যাই।
গুলিস্তানে এসে দেখি আমাদের গোপালগঞ্জ জেলার সব দূরপাল্লার বাস ছেড়ে গেছে। তবুও আমি ভেঙে ভেঙে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে পাদ্মাঘাট (মাওয়া) পর্যন্ত যাওয়ার জন্য ইলিশ নামে একটি বাসে উঠে পড়ি। পদ্মাঘাটে পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই ঝড় উঠলো নদীতে। তুমুল ঝড়। তাই নদীর সব ফেরি পারাপার বন্ধ ছিলো। আমি মাকে ফোন করে জানালাম, নদীর অবস্থা ভালো না, ফেরি চলাচল বন্ধ, তুমি ঘুমিয়ে পড়ো, আমি সকাল হলে এখান থেকে রওনা দেবো। ঝড় থেমে গেলে রাত দেড়টার দিকে ফেরি ছাড়ে এবং আমার মোবাইলে চার্জ না থাকার কারণে বন্ধ হয়ে যায়। এভাবে আমি যখন রাত ৪টা ৪৫ মিনিটে বাড়ি ফিরি; তখন আমার মা, আমার পায়ের আওয়াজ শুনে ঘরের ভেতর থেকে আমার ছোটবোন শম্পাকে ডেকে বলছে, ‘শম্পা দরজা খুলে দে, তোর দাদা এসেছে’। মায়ের এই আওয়াজ শুনে আমি থমকে যাই, কেননা আমার উপস্থিতি আমাদের ঘর থেকে কোনোভাবেই টের পাওয়া সম্ভব নয়। ওই দিন আমি অনুধাবন করি- পৃথিবীতে একমাত্র মা পারেন তার সন্তানের পায়ের আওয়াজ বুঝতে, একমাত্র মা পারেন তার সন্তানের জন্য সারারাত জেগে থাকতে। তাই আমি ওই দিন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম- মাকে নিয়ে আমি একটি কবিতার বই লিখবো। মায়ের সঙ্গে আমার এই ঘটনা নিয়ে ‘মা সিরিজ ০১’ কবিতাটি লিখি। এভাবে আমি মাকে নিয়ে এক-একটি কবিতা লিখতে লিখতে আজ অব্দি মা সিরিজের ৩৫৮টি কবিতা লেখা হয়েছে।
‘মা সিরিজ ১১’ কবিতাটা আমার মস্তিষ্কে জন্ম নেয় ২০১৩ সালের বসন্তদিনের কোনো একরাতে। তখন আমিসহ কয়েক বন্ধু মিলে মেস করে থাকতাম আজিমপুরে। সেইসময় আমি প্রতি গভীর রাতে একাকী ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতাম, বিশেষ করে পার্কগুলোতে। এভাবে একরাতে রমনাপার্কের ভিতরে দেখি, ল্যাম্পপোস্টের আলোর কাছে অজস্র উঁইপোকা উড়ছে। আরও কাছে গিয়ে দেখি, উঁইপোকাগুলোর উৎস হলো একটি জীবিত গাছ। উঁইপোকাগুলো গাছটিকে খেয়ে খেয়ে ঢোল বানিয়ে দিয়েছে অথচ গাছটির কিছুই করার নেই। আমি এই চিত্রকল্পটি নিয়ে দীর্ঘ তিনবছর ধরে প্রায় বিশটিরও বেশি কবিতা লিখেছি কিন্তু কোনো একটি কবিতা পছন্দ না হওয়ার কারণে-সবগুলো ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছি। তবে এবার যখন ‘মা সিরিজ’ লেখা শুরু করলাম তখন দেখি-আমার মায়ের সঙ্গে ওই বৃক্ষটির অনেক মিল। কারণ, আমি ছেলেবেলায় দেখেছি-বাবা মায়ের গায়ে হাত তুলতো কিন্তু মা কখনও বাবাকে কিছুই বলতো না। এ যেনো জীবিত বৃক্ষ হয়ে উঁইপোকার কামড় সয়ে যাওয়া। এই চিন্তা থেকে আমি ‘মা সিরিজ ১১’ কবিতাটি লিখি ২০১৫ সালের জুলাই মাসের কোনো এক ভোররাতে।
‘মা সিরিজ ৯৬’ কবিতাটি আমি লিখেছি ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে। ওইসময় আমি আজিমপুর থেকে হেঁটে হেঁটে শাহবাগে প্রতিদিন বিকেলে আসতাম। তখন প্রতি মঙ্গলবার বিকেলে দেখতাম ক্যানভাসাররা নিউমার্কেটের ১নং গেটের পাশে সাপখেলা দেখিয়ে তাবিজ-কবজ বিক্রি করতেন আর সেই সঙ্গে থাকতো জোঁকের তেল। কী মনে করে যেনো আমিও সাপ খেলা দেখা শুরু করলাম। সাপগুলো যখন ফণা তুলে একটি আরেকটি দিকে তাকিয়ে দুলছে, তখন সাপুড়ে জনগণের উদ্দেশ্যে বলছে, ‘আপনারা দেখবার পারছেন একটি সাপ আরেকটি সাপকে কীভাবে প্রশ্ন করছে’। তখন আমার মস্তিষ্কে কবিতার এই লাইনটি আসে ‘কোনো বিষধর সাপ ফণা তুলে দাঁড়ালে / প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে যায়?’ সাপখেলা দেখে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে এসে পুরো কবিতাটি লিখে ফেলি। সত্যি কথা বলতে কী, এই কবিতাটির কবি আমি নই, কবি হলো ওই সাঁপুড়ে।
‘মা সিরিজ ২১৩’ কবিতাটি আমি লিখেছি আমাদের পরিবার ও জীবন জিজ্ঞাসা নিয়ে। এর নেপথ্যে তেমন কোনো কাহিনী নেই। তবে আমি রামায়ণের আশ্রয় নিয়েছি।
‘মা সিরিজ ৩০২’ কবিতাটি আমি লিখেছি এই তো কিছুদিন আগে। হেমন্তের প্রথম দিকে। আমি একদিন ঘুম থেকে জেগে জানলা খুলে দেখি, আমাদের অ্যান্টেনার প্যাঁচানো তারের মাকড়সা জালে বিন্দু বিন্দু শিশির জমেছে। আর প্রত্যেকটি শিশির বিন্দুর মধ্যে খলবলিয়ে সূর্য হাসছে। তখনই আমি কবিতাটি লিখে ফেলি। এইসব কারণে আমি নিজেকে কবি না মনে করে কবিতা সংগ্রহকারী মনে করতে পছন্দ করি।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৫৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২১, ২০১৭
এসএনএস