বাংলানিউজের শিল্প-সাহিত্য বিভাগের বিশেষ আয়োজন ‘প্রিয় পাঁচ কবিতা ও কবিতার গল্প’র এবারের পর্বে থাকছে, কবি ফকির ইলিয়াসের নিজের লেখা প্রিয় পাঁচ কবিতা ও সেগুলো লেখার পেছনের গল্প।
প্রিয় পাঁচ কবিতা
আমাকে দেখতে এসেছিল যে শঙ্খচিল
কবি হবার জন্য আমি কখনওই উঁচু করিনি হাত।
হাজির, হাজির বলে কোনো কাব্যসভায় দিইনি হাজিরা। পেছন সারির
দর্শক হিসেবে আজীবন শুনতে চেয়েছি কবিতা— আর নান্দনিক সন্ধ্যার
ছবিগুলো ধারণ করতে চেয়েছি আমার ক্যামেরায়। বনেদি যে পথ
আমি পেরিয়েছি— তুমি সে পথে পা, না বাড়ালেও পারো। কারণ নদীতে
পা দিলেই ভিজে যেতে পারে পায়ের পাতা। ধূসর হয়ে যেতে পারে
আলতার রঙ। কিংবা মৃত শামুকের ভাঙা খোলস রক্তাক্ত করে দিতে
পারে পায়ের আঙুল। নিশীকামী জোনাকীরা মিটিমিটি আলোয় ছায়া ফেলে
তোমাকে দেখাতে পারে ভুল পথ।
অথবা এমনও হতে পারে— তোমাকে কবিতা শিখাবে বলে কোনো হাঙর
দেখাবে তার বীভৎস দাঁত ! অতএব ফিরো না সে পথে। গ্রহণ করো অন্য
কোনো চাঁদের যাদুবিদ্যা। হাত রাখো এমন কোনো বিজলীতে, যে ঝলক
ঝলসে দেয় না পাঁজরের উত্তর মেরু। আমাকে এই নদীনক্ষত্রে দেখতে
এসেছিল যে শঙ্খচিল— তাকেও একই কথা বলেছি। কবি হবার যোগ্যতা
নেই আমার। আগুনের সাথে বায়ুর মিশ্রণে সাজিয়েছি যে তাম্রলিপি, বার বার
তা পাঠ করে হতে চেয়েছি নিতান্ত শব্দকামার।
তুলিকাব্য
রাতের রত্নরাগ দেখে নির্ণয় করেছিলাম ঘ্রাণের আভাস। তখন
ছিল শীতকাল। ক'দিন পরই আসবে বসন্ত ; এমন ঘোষনায়
প্রকৃতিও ব্রত ছিল মৌলিক আরাধনায়। আর নদীসূত্রের ভোর,
শুয়েছিল ঘাসঘেরা চরের কোলে। আমরা আগে-পিছু হয়ে ধীরে
পেরিয়েছিলাম সেই নদীভোর। যাবো না কোথাও - জেনেও
হেঁটেছিলাম সূর্যের মুখোমুখি। দেখে দেখে কান্তকিরণ। একটা
প্রজাপতি উড়ে গিয়েছিল ঠিক সামনে দিয়েই। পতঙ্গও প্রীতিরেখা
আঁকে, তা আমার জানা হয়েছিল সেই প্রথম। আমি বলেছিলাম,
'প্রজাপতির প্রজা হতে চাই'। তুমি হেসেছিলে- বলেছিলে ,'তুলি
হাতে চিত্রকর হবে না ?'
আঁকায় আমার অবিশ্বাস ছিল না কোনোকালেই। আমি তো
আঁকতেই চেয়েছিলাম,জন্মঝড়, ঋতুঋণ ,বর্ষাবৃত্তান্ত,পুষ্পপরিধি
...... আরো অনেক কিছুই। এঁকে এঁকে ভাসিয়ে দিতে চেয়েছিলাম
সেই দীর্ঘদীঘিতে , যেখানে একদা ছিল তোমার সাঁতার সাম্রাজ্য।
সেই থেকে শুরু, আজও আঁকি। তরুণ কবিকে করে যাই নিমন্ত্রণ
সেই নিমফুলের মাঠে। ঘাটে দাঁড়িয়ে, দেখি প্রেমের হাত ধরাধরি।
তুমি যেভাবে বসেছিলে আমার হাতধরে , আজ থেকে অষ্টদশ বর্ষ
আগে,চাঁদগাঙে ভাসিয়ে দিয়ে তরী ।
পুনর্পাঠের তথ্যতালিকা
অসম্পূর্ণ থেকে যায় পাওনার ছায়াতালিকা। দেনার নক্ষত্রগুলো লাল চোখ দেখিয়ে
পাড়ি দেয় অন্য ভূপৃষ্ঠে। এখানে কোনও সম্প্রদান নেই। যে আলো ঘিরে রাখে
প্রাকৃত সুন্দর— সেই তপস্যাগৃহে মানুষেরাই শিখে নেয় জন্মদান পদ্ধতি, প্রেমহিস্যা।
মূলতঃ এই পৃথিবীও একদিন পাঠগামী ছিল। যারা পড়তে পারতো না
বৃক্ষের শরীর, তাদেরকেই বলা হতো আদিম। যারা সূর্যের তথ্যসমূহ
সংগ্রহ করে যেতো বনভোজনে, তাদের বলা হতো আলোকিত অনন্ত প্রজন্ম।
আর শিশুরা তাদের হাতেই শিখতো আলোবিদ্যা। কোনও বিদ্যালয়
ছিল না যদিও, পাতাগুচ্ছই পালন করতো শিক্ষকের ভূমিকা।
জলের কাছ থেকেই মানুষ শিখেছিল পুনর্পাঠ। শিখেছিল পাখির কাছ থেকে।
নদীকে সহোদরা ভেবে যে নারী অঝোরে কেঁদেছিল— সে ছিল চাঁদের প্রথম
প্রেমিকা। যে কৃষ্ণ বাঁশি বাজাতে জানতো না—সে' ই মেয়েটিকে ডাকতো রাধিকা।
পেরেকপাত্রে একা
আমাকে যে আপেলবাগানে নিয়ে যেতে চাইছো,
সেখানে অনেকগুলো কালো ভোমর থাকে।
আমাকে নিয়ে যেতে চাইছো যে আখক্ষেতে, সেখানে
এক মধ্যরাতে মুখ থুবড়ে পড়েছিল চন্দ্রের শবদেহ
আর কয়েকটি পিঁপড়ে, সেই শবদেহ টেনে নিয়ে
ফেলে দিতে চেয়েছিল নদীতে।
পেরেকপাত্রে এতোদিন একা পড়েছিল আমার যে
মৃত আত্মা, তুমি তাকে দিতে চেয়েছিলে যে প্রেম-
আমি এমন ভালোবাসা কখনও চাই'নি।
অংশীদারিত্বের প্রকরণে যে হিসেব- নিকেশ থাকে,
কবিতা তার পাশে বসতি গাড়ে না,
কবি জীবনেও হতে পারে না শাসনের তাবেদার।
প্রিয় জেনারেল
প্রথাগত সুন্দর আর আকাশের বেগুনী মলাট ছিঁড়ে উড়ে যাচ্ছে
একটুকরো মেঘ। উড়ে যাচ্ছে পূর্বে। পশ্চিমের সকল পুঁজি বহন
করে যে ভিক্ষুক রাস্তায় নেমেছিল, সেও চেয়ে দেখছে তার পায়ের
নিচের মাটি সরে যাচ্ছে ক্রমশ।
‘আরও রক্ত চাই’-এমন হুংকার শুনে হেসে উঠছে শিশুরা।
যারা আকাশে ঘুড়ি উড়াবার জন্য মাঠে নেমেছিল, তারাও
ভাঙা নাটাই হাতে নিয়ে, ফিরছে ঘরে। পেরেক বিষয়ক প্রবন্ধ
লিখার জন্য কিছু তথ্য সংগ্রহে গুগল সার্চ সেরে নিচ্ছে ঘরবন্দী
পিতাদের দল।
বন্দিদশা মানুষের আজন্ম নিয়তি ! এই তথ্যগুলো সামনে ভেসে
উঠার সাথে সাথে কেউ কেউ সারমর্মগুলোর প্রিন্টও নিতে চাইছে
কালো কাগজে। শাদা দুঃখগুলো নির্বাসিত হবার পর এই নগরে
আর কেউ সফেদ কাগজে কলম ঘষে না। শিল্পীরাও কালির বদলে
ব্যবহার করেন তাজা রক্তের ফোঁটা।
রাতগুলো দীর্ঘ ছিল এই নগরের। আর দিনগুলো, বোমা এবং
বৈধব্যের স্থিরচিত্র ধারণ করে ক্রমশই লিখে যাচ্ছিল দাসত্বের ইতিহাস।
‘আজ এই দাসপ্রথার প্রথম পর্বের সমাপ্তি হবে’। একজন জেনারেল
সগর্বে এই ঘোষণাটি দেবার পর, বাগদাদের মরুভূমি থেকে
ছুটে আসেন একজন বেদুইন।
‘আপনি সত্যি চলে যাচ্ছেন প্রিয় জেনারেল !
সত্যিই নামিয়ে নিচ্ছেন আপনাদের লাল নীল পতাকা !
আমাদের বিদীর্ণ আকাশ থেকে সত্যি খসে পড়ছে
আপনাদের পঞ্চাশটি তারকা !’
বলতে বলতে দুহাত তুলে দাঁড়ান বৃদ্ধ বেদুইন।
আপনাকে আমি খুব ভালোবাসি প্রিয় জেনারেল !
খুব ভালোবাসি আপনার হাতের আগ্নেয়াস্ত্র ! কারণ এই
অস্ত্রই আমাকে পিতৃহীন করেছে। আমাকে করেছে ভিটেসূত্রহীন।
হারানোর বেদনা আমার পাঁজরে জমিয়েছে অজস্র পলিকণা। উর্বর
হতে হতে আমি জেনে গেছি যুদ্ধই জীবনের পরিণত পরিণাম।
আপনি চলে যাচ্ছেন প্রিয় জেনারেল ! সাথে নিয়ে যাচ্ছেন আপনার
রক্তাক্ত চোখ। যে চোখে জমে আছে অগণিত নবজাতের রক্ত।
একটি মানব-ভ্রূণ ধারণ করার চার সপ্তাহ পর আপনাদের বোমার
আঘাতে আবু গারিব শহরের উপকূলে ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল যে
তরুণী, জানি তার রক্তের দাগও লেগেছিল আপনার উর্দিতে।
সুখ্যাতি(!)র স্টারগুলো সামলাতে সামলাতে আপনি শুধুই বলেছিলেন-
‘উই উইল উইন দ্যা ওয়ার’।
নিরীহদের হত্যা করতে করতে হায়েনারা এভাবেই যুদ্ধ জয় করে,
প্রিয় জেনারেল ! এভাবেই বনেদি বেনিয়ারা আমাদের চারপাশে
সেরে নেয় রক্ত এবং তেলের মিশ্রণ। খনিজসম্পদে চোখ বুলাতে
বুলাতে ভ্রমণ করে লক্ষ মরুমাইল। কখনও গোপন মাইন পোঁতে,
সনাক্ত করে সম্পদের উৎস।
‘বোমার বিনিময়ে বাণিজ্য চাই’-এমন মিশন সেরে আপনি সত্যি
চলে যাচ্ছেন প্রিয় জেনারেল ! ৩১ ডিসেম্বর ২০১১ এর আগেই
আরেকটি কারবালার হাহাকার তৈরি করে সদলবলে আপনি
চলে যাচ্ছেন। রেখে যাচ্ছেন আমাদের জন্য গণতন্ত্রের ধনুক।
তীরটা সাথে করেই নিয়ে যাচ্ছেন। যাতে প্রয়োজনে আবার কাজে
লাগাতে পারেন।
চতুর শিকারিরা এভাবেই, ভিন্ন জনপদে রেখে যায় তাদের গৃহপোষা
ঈগল। কখনও রেখে যায় বিষধর সাপও। নির্দেশ পেলেই যাতে নগরে
মনুষ্যকুলকে ছোবল দিতে পারে।
আমার খুব কষ্ট হচ্ছে প্রিয় জেনারেল! আপনি এই নগর ছেড়ে চলে
যাচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু আপনাদের রক্তদৃষ্টি, বজ্রবৃষ্টির মতোই দখল করতে
চাইবে নতুন কোনো জনপদ। আপনার সাবমেরিন খুঁজতে চাইবে নতুন
কোনো গন্তব্য। একদিন পেন্টাগনের কপাট ছুঁয়ে আপনি যে শপথ
নিয়েছিলেন, তা ছিল মানবতা রক্ষার অঙ্গীকার। অথচ আমরা দেখলাম,
ভোগের কাছেই পরাজিত হলো রক্তাক্ত মানবতা। ছটপট করতে করতেই
মৃত্যুবরণ করলো ডানাহীন অসংখ্য পাখি।
বিষণ্ন নির্জনতা জাগিয়ে দিয়ে আপনি চলে যাচ্ছেন, প্রিয় জেনারেল !
মাঝে মাঝে এভাবেই চলে যেতে হয়। নামিয়ে নিতে হয় দখলের পতাকা।
এই মরুরৌদ্রে বসে আমার উত্তরসূরিরা নিশ্চয়ই একদিন পরখ করবে
অতীতের লগ্নকাল। সবগুলো চন্দ্রগ্রাস অস্বীকার করে তারা লিখবে
নতুন ইতিহাস। যে ইতিহাস সাক্ষ্য দেবে, গোটা বিশ্ব থেকেই কীভাবে
সরে যাবে তিনরঙা রাহুগ্রহ। কীভাবে নেমে যাবে শোষণের উড্ডীন পতাকা।
প্রিয় জেনারেল, আপনি আমাদেরকে ঘুরে দাঁড়াতে শিখিয়েছেন। এই
মরুমাটিতে, আপনার পদধূলি না-পড়লে আমাদের কোনোদিনই চেনা হতো না,
বিদগ্ধ যুদ্ধের এইসব বিপরীত সম্মোহন। কিছু মুখোশের অভিন্ন ছলাকলা।
কবিতার পেছনের গল্প
কবি শহীদ কাদরী নিউইয়র্কে একটি সাহিত্য আড্ডার হোস্ট ছিলেন। এর নাম ছিলো 'একটি কবিতা সন্ধ্যা'। শহীদ কাদরী চাইতেন, নতুন কবিতা লেখা হোক। আমি খুবই অনুপ্রেরণা পেতাম তার কাছ থেকে। 'আমাকে দেখতে এসেছিল যে শঙ্খচিল' কবিতাটি সেই কবিতা আড্ডাকে ঘিরেই লেখা। মনে পড়ছে, আমি যখন কবিতাটি পড়ে শেষ করি তখন শহীদ ভাই একবাক্যে বলেছিলেন, 'বাহ!' আমি শুধুই তাকিয়েছিলাম তার মুখের দিকে।
দ্বিতীয় কবিতাটি 'তুলিকাব্য' আমার প্রেমিকাকে নিয়ে লেখা। সেই প্রেমিকা এখনও আমার প্রেমিকা। আমার সহধর্মিনী। হ্যাঁ, এই কবিতায় আমি আগামীর তরুণ প্রেমিক কবিকে প্রেমমহলে আমন্ত্রণ জানিয়েছি মাত্র।
তৃতীয় কবিতা 'পুনর্পাঠের তথ্যতালিকা'য় আমি মানুষ ও প্রকৃতির যুথসম্পর্ক আঁকতে চেয়েছি। আমি অনেক কথাই নিজের মতো করে লিখি পঙক্তিমালায়। এটাও তেমনি একটি কবিতা।
'পেরেকপাত্রে একা'- কবিতাটিতে আমার জীবনের বোহেমিয়ান প্রশ্বাসই প্রকাশিত হয়েছে। আমি মূলত বাউলবাদী মানুষ। লেখালেখির শুরুও বাউল গান দিয়ে। আমি সবসময়ই মনে করি, পৃথিবীটা একটা পেরেকপাত্র। আর সেখানে প্রেম নিয়ে, বিরহ নিয়ে, বৈভব নিয়ে, দারিদ্র্য নিয়ে মানুষ একান্তই একা। আর সেই মানুষটি যদি কবি হয়! না, কোনো শাসনের তাবেদারিই মানতে পারে না সে।
'প্রিয় জেনারেল' একটি দীর্ঘ রাজনৈতিক কবিতা। কি বলেছি, কেন বলেছি- তা পড়লেই সহজে বোঝা যায়। আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন অভিবাসী নাগরিক হিসেবে অনেক ঘটনাই ভেতর থেকে দেখেছি। আমি জানি, শেষ পর্যন্ত মজলুম মানুষেরই জয় হয়। ইরাক-আমেরিকা যুদ্ধে সেটাই হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১০৫৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৫, ২০১৭
এসএনএস