কাব্যগ্রন্থ ‘ক্রিয়াপদহীন ক্রিয়াকলাপ’ প্রকাশ করেছে কোলকাতার সৃষ্টিসুখ প্রকাশন। এতে সন্নিবেশিত হয়েছে ৩৬টি ক্রিয়াপদহীন কবিতা।
বাংলানিউজের শিল্প-সাহিত্য বিভাগের বিশেষ আয়োজন ‘প্রিয় পাঁচ কবিতা ও কবিতার গল্প’র এবারের পর্বে থাকছে, কবি কাজী জহিরুল ইসলামের নিজের লেখা প্রিয় পাঁচ কবিতা ও সেগুলো লেখার পেছনের গল্প।
প্রিয় পাঁচ কবিতা
অপেক্ষারা
অপেক্ষারা হরহর করে হেঁটে যায়, তিন পায়ে
সিলিংফ্যানগুলো বাতাশে নিচে দোল খায়
ফ্লোর থেকে এক টুকরো আকাশ তুলে নেয় মিলেনিয়াম শিশু
ফুঁ দিয়ে ওড়ায় ছাদের দোতলায়
অপেক্ষারা চুপচাপ বসে থাকে টিভিস্ক্রিনে
সোফাগুলো নরম নিতম্বেঝটপট বসে পড়ে
জানালারা এগিয়ে এসে কানকথা লাগায় দুটি বোরকার মাঝখানে
বোরকাদের ভেতরে চারটি গ্রেনেড গরম হতে থাকে
মাঝরাতে কাঁদবে বলে...
অপেক্ষারা গরম কফির কাপ হয়ে ঢুকে যায় সাহেবের ঘরে
হ্যাটগুলো রোদ ঠেকাতে বসে পড়ে গোবরের স্তূপে
বেঞ্চের আড়ালে আপেলের সাইজ মাপে ইহুদি যুবক, সাপারের আগে
ইতি-উতি কী যেন খোঁজে একটি চতুর এবনি কাঠের লাঠি
ফ্লোরে তখন প্লেনগুলো উড়তে থাকে ঘোষিত সিডিউল ভেঙে
অপেক্ষারা আর অপেক্ষা থাকে না।
রাজপুত্রের নদীগল্প
তোমাকে শোনাবো খাগাতুয়া। গোমতীর সকালগুলো এখনো
জামার পকেটে ঝনঝন করে। দেখাবো তোমাকে।
দুপুর গুটিয়ে বসো। বিকেলের চিবুকে ফরাসি চুমু, তারপর গল্পের ঝাপিটা...
চা না কফি? সাথে কি নেবে? টিএসসি? চন্দ্রিমাও দিতে পারি।
স্মৃতিসৌধের বিকেল? দাঁড়াও, খুঁজে নিই। ও হ্যাঁ, এইখানে... এই যে পেয়েছি।
ঘাড়ের তারাটা, লালচে, মেঘের কতকাল বয়ে গেল। ওকে খুলে দাও।
ওখানে সহস্রাব্দের অন্ধকার এসে ভেসে যাক।
একটি দুরন্ত নদী বন্দি করে রেখেছো কেন? ওর কী দোষ বলো তো?
এই যে, অমনি দুটি ঢেউ লুকিয়ে ফেললে। শোনো, অতলান্তিকের পাড়ে আমার বসত
আমি বুঝি ঢেউ চিনি নে? এবার গল্প শোনো,
রাজপুত্র ছোট্ট এক নদী কিনে নিল। গোমতী নদীর নাম।
ঢেউ গুনে, বালিহাঁসের সাঁতার দেখে মুগ্ধ যুবরাজ হঠাৎ খুঁজে পায়
গোমতীর বুকে এক সবুজ কষ্টের দ্বীপ।
কি হলো? শুনবে না? আমার পকেটগুলো কেমন ভারি হয়ে আছে...
আমি যে হাঁটতে পারছি না।
গাড়ি
গাড়ি চালাতে চালাতে ভাবছি গাড়ির কাছে যাব
কি যেন ফেলে এসেছি গাড়িতে
কি যেন পাই না খুঁজে সংসারের হার্ডডিস্কে
নারীদের ড্যাশবোর্ডে
খুঁজে পাই না ওখানে, শৈশবের একটু ওপরে
বয়োসন্ধির বাড়িতে;
তাড়াতাড়িতে ফেলে এসেছি কি যেন
গাড়ির সিটপকেটে, না হয় টুলবক্সে
না-কি ফার্স্টএইড বক্সের ভেতর, ডেটলগন্ধের নিচে
না হয় পেছনে, ট্রাঙ্কের গুমঘরে...
গাড়ি চালাতে চালাতে তখন গাড়ির কাছে যাই
গাড়ি কই?
এইখানেই তো গাড়ি ছিল, এই কৈশোরতলায়
গাড়ি হারিয়ে ফিরে যাই
গাড়ি চালাতে চালাতে গাড়ির কথা ভাবি।
পাঁচতলা বাড়ির সিঁড়িরপথ
মাদার তেরিজাকে ডানে রেখে সানি হিলে বাঁক
নিতেই রমিজ সাদিকু, ডানে এক চিলতে ফাঁক
পাহাড়ের সিঁথি, লক্ষ্য যার উলপিয়ানা।
জানা-অজানা
এইসব পথ পাড়ি দেয় মধ্যরাতে
এক উদ্ভ্রান্ত যুবক। দুই হাতে
কিছু একটা কঠিনভাবে আঁকড়ে ধরা তার,
দু’পাশে যার কৃষ্ণচূড়া রঙের কভার
মাঝখানে ক’খান
শাদা কাগজ, চুপচাপ নিস্প্রাণ।
আনমনে একাকী হাঁটে
সাহসী যুবক মধ্যরাতের এ নীরব তল্লাটে,
অন্ধকার কানে কানে কি যেন বলে যায়
তাকে গোপন ইশারায়।
হাতের রহস্য মেলে ধরে যুবক মেঘে ঢাকা কৃষ্ণপক্ষের খণ্ডিত চাঁদে
আলো-আঁধারির অদ্ভুত ফাঁদে
পড়ে রহস্যের পাপড়িগুলো হয়ে ওঠে শাদা শাদা বরফের পাঁপর।
ধীরে ধীরে পকেটের নীল বলপয়েন্ট, পায়ের জুতো, পরণের কাপড়
সব বদলে যেতে যেতে হারিয়ে যায়
অন্ধকারের বিবর্ণ ছায়ায়
নিজেকে দেখে চমকে ওঠে
আগন্তুক যুবক, ঊর্ধ্বমুখী ছোটে
এবার অসীম ক্ষিপ্রতায়
দূর্গম পর্বত-চূড়ায়
বরফের পাঁপর ভেঙে তুলে আনে হারানো ঠিকানা সে
একাকী দাঁড়িয়ে আছে দাম্ভিক প্রাসাদ এক আলোহীন পথের ওপাশে
প্রধান ফটকে তার থমকে
দাঁড়ায় যুবক এবং হঠাৎ সে ভীষণ চমকে
ওঠে অতিচেনা একটি নামফলক দেখে।
চাঁদের জ্যোৎস্না মেখে
লিখেছেন কোন সদাশয় শিল্পী এই দূর অচেনা শহরের
এক রুদ্ধ কপাটের
জীর্ণ পাঁজরের হাড়ে উজ্জ্বল দশ বর্ণের একটি নাম?
দূরের শহর থেকে উঠে আসা প্রাসাদের ঢেউ আর ধ্যানমগ্ন মৌন গ্রাম
সব একাকার হয়ে মিশে আছে এই পাঁচতলা বাড়ির দেয়ালে।
আনমনে অদ্ভুত অজানা অমোঘ খেয়ালে
হাত রাখতেই কপাটের কঠিন হাতলে
কোনো এক জাদুমন্ত্রের কবলে
পড়ে ভেল্কিবাজির মতো দু’পাশে
সরে গিয়ে দুটি লোহার কপাট, উচ্ছাসে
উদ্ভাসিত হলো স্বর্গীয় গিরিরথ
একটি বর্ণিল সিঁড়িপথ
বুকের ওপর থেকে মেঘের আঁচল সরে যাওয়া কৃষ্ণপক্ষের চাঁদে।
পেছনের নির্মম গভীর কালো গিরিখাদে
শীতল মৃত্যুকে ফেলে রেখে সম্মুখের স্বচ্ছ মসৃণ সিঁড়িতে
পা রেখে সহসা শিহরিত হয় মধ্যনিশিথে
অনিকেত অচেনা পথিক
মনে হয় হঠাৎ ওর এই স্ফটিক
সিঁড়িপথ মহাকালের অন্তহীন
যাত্রার ভাসমান রথ, অমলিন
নিঃসীম শূন্যতার সাঁকো।
‘এইখানে তোমার নির্ভার পদচিহ্ন রাখো’
সহসা উচ্চারিত হয় দৈববাণী চতুর্দিক হতে।
অনিশ্চিত যাত্রার ধাবমান রথে
যৌবনের রঙধনু স্বপ্নের মোড়ক
অবলীলায় তুলে দেয় অলৌকিক নির্দেশে যুবক
কলকব্জার সব মজবুত গিট
খুলে মাথার ওপরে ধূসর কংক্রিট
হাওয়ায়
ডানা মেলে ভেসে যায়
অনন্ত নক্ষত্রবীথির উদার অঙ্গনে
শরতের চন্দ্রকণে
কালের বৃন্ত ছিঁড়ে এনে উৎসব জ্যোৎস্নায়
মহাকালের অমূল্য পুষ্পহার পড়েছে গলায়।
মেঘের আড়ালে চাঁদ নাকি চাঁদের আড়ালে মেঘ
আলো-আঁধারির ভৌতিক উদ্বেগ
উপেক্ষা করে চোখ রাখে সে অন্তহীন দিগন্তের নীলে।
পেছনে রেখে আসা অস্তিত্বের পঞ্চভূত মিলে
পাঁচরঙে সাজিয়েছে মহাকালের অনন্ত সিঁড়িপথখানি
অচেনা গন্তব্যের অমোঘ হাতছানি
তুলে নেয় রহস্যের জটিল সিঁড়িপথখানির ভাসমান ধাপে,
বুকের উত্তাপে
অঙ্কুরিত স্বপ্নের ভ্রূণ, যৌবনের মহীরুহ
ভেসে যায় কালের বন্যায়, তারই কঙ্কাল মাড়িয়ে দুরূহ
সিঁড়িপথে উঠে আসে ঘোর লাগা রাত্তিরে
অগণিত নক্ষত্রপুঞ্জের ভিড়ে।
এরপর অতিক্রমকরেরহস্যেরপঞ্চস্তর
এগুতে থাকে সে ধীরে ধীরে
গভীরের থেকে আরো অন্তহীন গভীরে।
বইমেলা ১৯৯৮
সানগ্লাস বাদাম খায় রোদের খোসা ছড়িয়ে
বন্দুকের সরু নল থেকে ঝরে পড়ে মূর্খ পুলিশের লালা
তরুণীরা পীনোন্নত বক্ষের ছন্দে
ছড়িয়ে দেয় ইতস্তত চাহনী
বুদ্ধিজীবীগণ কাছিমের মতো গলা বাড়ায় টেলিভিশনের বাক্সে
আমরা ক’জন স্ট্যাচু
ছবি তুলি খোদার ক্যামেরায়
হায় প্রধানমন্ত্রী, হায় বিড়ম্বিত বাংলাদেশ
আহারে পড়ুয়া পাঠক
অসহায় নবীন লেখকের প্রার্থিত ঈশ্বর
প্রতীক্ষায় প্রতীক্ষায় আমাদের সবকিছু ঝরে যায়
শরীর ও মনের নির্যাস
স্বপ্ন ও ঘামের পদ্য
প্রিয় পাঁচ কবিতার গল্প
দুবাই এয়ারপোর্টে বসি আছি। আবিদজানের প্লেন ধরবো। দেখছি নানান দৃশ্যাবলী। বোর্ডিং পাসের উল্টোপিঠে লিখতে শুরু করি কবিতা, তৈরি হয়, ‘অপেক্ষারা’ এবং একসময় অপেক্ষারা আর অপেক্ষা থাকে না।
আশ্বিনি বিচ, আইভরিকোস্ট। পেছনে নীল লেগুন, সামনে সুবিশাল আটলান্টিক। মুহূর্তেই পৃথিবীর সব জলাশয় গোমতি হয়ে যায়। আমাকে ডাকে। আমি গোমতির নরম বুকে সাঁতার কাটতে কাটতে তৈরি করি ‘রাজপুত্রের নদী গল্প’।
২০০৫ এর ০৭ অক্টোবর। আইভরিকোষ্টের রাজধানী আবিদজান শহর। গাড়ি চালাতে চালাতে মার্কোরি পেরিয়ে উঠি দ্য গল সেতুর ওপর। এপার-ওপার জুড়ে দিয়ে প্লাতু, প্লাতু পেরিয়ে কোকোডি, আমার অফিস। বড় একটি পাহাড়ি শিমুলের ছায়ায় গাড়িটি পার্ক করে খুঁজতে শুরু করি অন্য এক গাড়ি। কোথায় সে, এখানেইতো ছিলো। এই কৈশোরতলায়। এভাবেই ‘গাড়ি’ আবিষ্কার।
মধ্যরাতে উদ্ভ্রান্তের মতো হাঁটছি। বড় রমিজ পেরিয়ে একটি পাহাড়, মাদার তেরিজা স্ট্রিটকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে উঠে গেছে উল্পিয়ানার দিকে। হাঁটতে হাঁটতে একটি পাঁচতলা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াই। যুদ্ধের দ্রোহে নিভে গেছে আলো, তখন চাঁদ ওঠে। চাঁদের আলো এক ভৌতিক পরিবেশ সৃষ্টি করে। বাড়ির প্রধান ফটকে এ কার নাম, উজ্জ্বল দশ বর্ণের? চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত হয় ‘পাঁচতলা বাড়ির সিঁড়িপথ’ খানি। আমি উপরে উঠতে থাকি, উঠতেই থাকি।
ফিতা কাটবেন প্রধানমন্ত্রী। খবরদার কেউ ঢুকবে না, পুলিশের বন্দুক আমাদের কাঁধের উপর। পাঠকের ভিড় বাড়ে, তরুণ কবি সস্মমানে পথ ছেড়ে দেয় দেয় পাঠক, প্রার্থিত ঈশ্বরের জন্য। কয়েকটি দুষ্টু সানগ্লাস তখন রোদের খোসা ছড়িয়ে চিনেবাদাম খায়। ‘বইমেলা ১৯৯৮’–এর এটিই ছিলো প্রথম দিন।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৪৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৯, ২০১৭
এসএনএস