ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৯ কার্তিক ১৪৩১, ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

রাজনীতি

ফেনী-১ আসনে পরিবর্তন চায় আ.লীগ, নীরব বিএনপি কৌশলী বাকিরা

সোলায়মান হাজারী ডালিম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৫৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৯, ২০২৩
ফেনী-১ আসনে পরিবর্তন চায় আ.লীগ, নীরব বিএনপি কৌশলী বাকিরা

ফেনী: ফেনীর ছাগলনাইয়া, ফুলগাজী ও পরশুরাম- এই তিনটি উপজেলার দুটি পৌরসভা ও চৌদ্দটি ইউনিয়ন নিয়ে ফেনী-১ আসন।  

একটা সময় এই আসনকে বিএনপির দুর্গ বলা হলেও এখন শক্ত অবস্থানে রয়েছে আওয়ামী লীগ।

 

স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সবকটি ইউনিয়ন ও পৌরসভার জনপ্রতিনিধি হিসেবে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরাই নির্বাচিত হয়েছেন। তবে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটের সমীকরণ কী, তা দেখার অপেক্ষায় সবাই।

দীর্ঘ সময় ধরে জোটের জাসদ প্রার্থী শিরিন আখতার সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হলেও, এবার আর জোটের নয়, দলের প্রার্থী চায় আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা। তারা বলছেন, সংসদ সদস্য না থাকায় ক্ষমতায় থেকেও তারা বঞ্চিত হয়ে আসছেন। তাই দলের প্রার্থীর বিকল্প নেই।  

তবে, জাসদ বলছে- জোটের মধ্যে কোনো বিভেদ নাই।  

অপরদিকে বিএনপিতে এখনো দেখা যায়নি ভোটের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। তবে নির্বাচনে গেলে দল যাকেই মানোনয়ন দেবে, তাকেই জয়ী করতে একাট্টা তারা। এমনটাই জানিয়েছেন দলটির নেতা-কর্মীরা। অন্যদিকে তলে তলে মাঠ গোছাতে সক্রিয় জামায়াতে ইসলামীও। নিজেদের প্রার্থীও ঠিক করে রেখেছেন তারা।

এছাড়া রাস্তা-ঘাটে, মাঠে ও হাট বাজারে দেখা গেছে বেশকিছু স্বতন্ত্র প্রার্থীর পোস্টারও। তাদের অনেকেই খায়েশ দেখিয়েছেন, আসন্ন সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার।

জোটের নয়, দলীয় প্রার্থী চায় তৃণমূল আ.লীগ
ভারত সীমান্তবর্তী এ আসনে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া চারবার নির্বাচিত হয়ে দুইবার আসন ছেড়ে দেওয়ায়, তার ছোট ভাই সাইদ ইস্কান্দার উপ-নির্বাচনে নির্বাচিত হন। গত ১১টি সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি দুবার তাদের দখল নিতে পারলেও, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী ১৯৭৩ সালের পর এ আসনটি আওয়ামী লীগের হাতছাড়া হয়ে যায়। একবারও দলটির কেউই নির্বাচিত হতে পারেনি এখান থেকে।

গত দুটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ছেড়ে দেওয়ায় এ আসন থেকে নির্বাচিত হয়েছেন মহাজোটের প্রার্থী। তবে আসন্ন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা চায় দলের প্রাথী, জোটের নয়। খালেদা জিয়ার পৈত্রিক ভিটার এ আসনটি স্থায়ীভাবে শেখ হাসিনাকে উপহার দিতে চায় তারা। নেতা-কর্মীরা বলেন, একবার আসনটিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী নির্বাচিত হলে, আর কেউই ভোটে জিততে পারবে না এখানে।

এ আসনে ভোটের মাঠে প্রার্থী হিসেবে আওয়ামী লীগ থেকে আলোচনায় আছেন ছাগলনাইয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা চেয়ারম্যান মেসবাউল হায়দার চৌধুরী সোহেল। এ প্রসঙ্গে কথা হয় তার সঙ্গে।  

তিনি জানান, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার দেশে ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন। খালেদা জিয়ার পৈত্রিক ভিটা হওয়ার পরও শেখ হাসিনা এ আসনের মানুষকে বঞ্চিত করেননি। বরং উন্নয়নের জোয়ারে ভাসিয়ে দিয়েছেন। নানা কারণে এ আসনটি গুরুত্বপূর্ণ হলেও ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্য না থাকায় এখানকার আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বঞ্চিত হয়ে আসছেন। একবার যদি এ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী দেওয়া যায়, তাহলে তাকে বিপুল ভোটে নির্বাচিত করা যাবে এবং আসনটি স্থায়ীভাবে আওয়ামী লীগের হয়ে যাবে। স্বয়ং খালেদা জিয়া নির্বাচন করলেও এখানে তার জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

এছাড়াও এ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী তালিকায় আলোচনায় আছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক প্রটোকল অফিসার ও ফেনী বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন নাসিম, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাবেক নেতা ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট ও পরশুরাম উপজেলা চেয়ারম্যান কামাল মজুমদার।

বিগত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ফেনী আওয়ামী লীগের অঘোষিত নিয়ন্ত্রক ৯৬-এর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রটোকল অফিসার, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা আলাউদ্দিন আহম্মদ চৌধুরী নাসিম পর্দার অন্তরালে থেকে জেলা আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ-সংগঠনকে নিয়ন্ত্রণ করছেন। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সংগঠনের নেতৃত্ব নির্বাচনে এবং কেন্দ্র ও জেলা প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তার প্রভাব রয়েছে।  

গুঞ্জন রয়েছে, বিএনপি এ নির্বাচনে অংশ না নিলে তিনি এ আসন থেকে মনোনয়ন নেবেন এবং কোনো ঝুঁকি ছাড়াই জয়লাভ করবেন। দলীয় নেতাকর্মীরা তাকে চাইলেও অবশ্য তিনি সবসময় থাকতে চান পর্দার অন্তরালেই। তাইতো তার পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

সাবেক মন্ত্রী লে. কর্ণেল (অব.) জাফর ইমাম (বীরবিক্রম) ১৯৭৯ সাল থেকে বিএনপি, পরে জাপা থেকে ১৯৮৮ পর্যন্ত এ আসনের এমপি-মন্ত্রী ছিলেন। ১৯৯১ সালে জাপা প্রার্থী এবং ২০০১ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে এ আসন থেকে নির্বাচন করে বেগম জিয়ার কাছে হেরে যান। তার ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে, তিনি দলীয় মনোনয়ন পেলে হয়তো আবার আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করতে পারেন।

সম্প্রতি ঈদুল ফিতরের পর পরশুরামে নিজ বাড়িতে আসেন আলোচিত যুবলীগ নেতা ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট। এ আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচনে তার প্রার্থীতা নিয়েও রয়েছে গুঞ্জন। অনেকেই তাকে হেভিওয়েট প্রার্থীও মনে করেন।
 
নির্বাচনী মাঠে কৌশলগত প্রচার-প্রচারণায় আছেন জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও শিল্পপতি মিজানুর রহমান। গেল রমজান ও ঈদ কেন্দ্রিক নানা ধরনের কর্মসূচিতে ব্যস্ত থাকতে দেখা গেছে তাকেও।  

নীরব বিএনপি
দলীয় চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে বিএনপি নির্বাচনে যাবে কি না, এ নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিলেও ফেনী-১ আসনে তাকে ঘিরেই নির্বাচনী ছক আঁকছেন দলীয় নেতা-কর্মীরা। এ আসন থেকে খালেদা জিয়া পর পর চারবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তবে ২০০১ সালের উপ-নির্বাচনে এ আসনটি তিনি ছোট ভাই প্রয়াত সাঈদ এস্কান্দারকে ছেড়ে দেন।

বিএনপি ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করায় আসনটিতে সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ-ইনু) সাধারণ সম্পাদক শিরিন আক্তার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এখানে নির্বাচন করেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলের সভাপতি রফিকুল আলম মজনু। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তিনি প্রার্থী থাকবেন কি না, তা নিয়ে কেউ খোলাসা করেনি। তবে খালেদা জিয়া যাকেই প্রার্থী দেবেন, তাকেই বিপুল ভোটে নির্বাচিত করতে পারবেন বলে জানিয়েছে বিএনপি নেতারা।

এ প্রসঙ্গে কথা হয় ছাগলনাইয়া উপজেলা বিএনপির সদস্য মো. আলমগীরের (বিএ) সঙ্গে। তিনি বলেন, সরকার উন্নয়নের নামে দেশে লুটপাট চালিয়েছে। দেশের মানুষ দেখেছে, এই সরকার কিভাবে মানুষের ওপর অত্যাচার নির্যাতন চালিয়েছে। কিভাবে দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে মানুষের জীবনকে অসহনীয় করে তুলেছে। এমন অপশাসন দেখেও এই সরকারকে এবং এই দলের প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার প্রশ্নই আসেনা। ভোট হলে মানুষ তাদের প্রত্যাখ্যান করবে।  

স্থানীয় বিএনপির এই নেতা বলেন, এই আসন বিএনপির ঘাঁটি। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোট হলে এখানে বিএনপির প্রার্থীই বিপুল ভোটে নির্বাচিত হবে।

আশাবাদী জাসদ
গত দুই মেয়াদে সংসদ সদস্য থাকায় উন্নয়নের ফিরিস্তি উল্লেখ করে আসন্ন সংসদ নির্বাচনেও মহাজোটের মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী জাসদ (ইনু)।

এ বিষয়ে সংসদ সদস্য শিরিন আখতার বলেন, বর্তমান সরকারের আমলে এ আসনের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। নারী ক্ষমতায়নে এখানে ব্যাপক সফলতা রয়েছে। আবারও যদি মনোনয়ন দেওয়া হয়, জনগণ উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বাজায় রাখতে মহাজোটের প্রার্থীকেই বিপুল ভোটে নির্বাচিত করবে।

শিরিন আখতার আরও বলেন, আবার যদি তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন, তাহলে অসাম্প্রদায়িক সমাজ ও নারী শিক্ষাকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবেন।  

তিনি আরও বলেন, সবাইকে সঙ্গে নিয়ে এতদিন কার্যক্রম চালিয়েছি। গোটা এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে।

সক্রিয় অন্যরাও
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে এ আসনে তলে তলে সক্রিয় অন্যরাও। রমজান ও ঈদে কৌশলগত প্রচার-প্রচারণা চালাতেও দেখা গেছে অনেককেই। যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্তদের দল জামায়াতে ইসলামীও এখানে সক্রিয় ভূমিকায়।  

একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে, নিজেদের প্রার্থীও ঠিক করে রেখেছেন তারা। সূত্র জানায়, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এস এম কামাল উদ্দিনকে প্রার্থী ঠিক রেখে মাঠে কাজ করছে তারা।  

অপরদিকে বেশ কয়েকজন স্বতন্ত্র প্রার্থীকেও দেখা গেছে প্রচারণায়। এর মধ্যে ব্যারিস্টার নিজাম উদ্দিন ভূঞাঁ রাসেল নামের এক প্রার্থীর পোস্টার দেখা গেছে বিভিন্ন হাট-বাজার ও গুরুত্বপূর্ণ এলাকায়।
 
অন্যদিকে এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি আলহাজ এমএ কাসেম, চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্সের সিনিয়র সহ-সভাপতি নুরুন নেওয়াজ সেলিম ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি খন্দকার এনায়েত উল্যাহর নাম শোনা গেলেও নির্বাচনী মাঠে তাদের দেখা যাচ্ছে না।

ভোটার সংখ্যা
ফুলগাজী, পরশুরাম ও ছাগলনাইয়া- এ তিনটি উপজেলা নিয়ে ফেনী-১ আসনটি গঠিত। ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে এ আসনে মোট ভোটার ছিল ৩ লাখ ৫ হাজার ৫৫ জন। হালনাগাদের পর ২০২৩ সালে তাতে আরও বেড়েছে ৫১ হাজার ৭৪২ জন। এ আসনে বর্তমান ভোটার তাই ৩ লাখ ৫৬ হাজার ৭৯৭। ১০৬টি ভোট কেন্দ্র ও ৫৬৬টি ভোটকক্ষে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে এ আসনে।

বাংলাদেশ সময়: ১২১০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৯, ২০২৩
এসএইচডি/এনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।