ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

রাজনীতি

লক্ষ্মীপুরে জোড়া খুনের প্রধান আসামি অধরা, জনমনে ক্ষোভ

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৪৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ৩০, ২০২৩
লক্ষ্মীপুরে জোড়া খুনের প্রধান আসামি অধরা, জনমনে ক্ষোভ বাঁ থেকে নোমান, রাকিব ও কাশেম জেহাদী

লক্ষ্মীপুর: লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার পোদ্দার বাজারে জেলা যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল নোমান এবং জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক রাকিব ইমাম হত্যা মামলার প্রধান আসামি ও সন্ত্রাসী বাহিনী প্রধান আবুল কাশেম জেহাদীকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। ঘটনার পাঁচদিনেও অধরা রয়ে গেছেন মূল অভিযুক্ত।

ফলে জনমনে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।  

শুক্রবার (২৮ এপ্রিল) দুপুরে মোটরসাইকেল মহড়া নিয়ে নিহত নোমানের বাড়িতে যান জেলা পুলিশ সুপার মো. মাহফুজ্জামান আশরাফ। ওই সময় তিনি নোমানের কবর জিয়ারত করেন এবং নিহতের স্বজনদের সান্ত্বনা দেন। পরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন পুলিশ সুপার। একই সঙ্গে ঘটনার বিষয়ে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলেন তিনি।  

ওই দিন বিকেলে ঘটনাস্থলের পাশেই পোদ্দারবাজারে বিক্ষোভ মিছিল করে বশিকপুর এলাকার সাধারণ লোকজন। মিছিল থেকে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত আবুল কাশেম জেহাদীকে গ্রেপ্তারের জোরালো দাবি জানানো হয়।  

যদিও পুলিশের অভিযানে এজাহারভুক্ত দুই আসামিসহ তিনজন এবং র‍্যাবের অভিযানে একজন ধরা পড়েছেন। কিন্তু ঘটনার সময় ব্যবহৃত অস্ত্রগুলো এখনো উদ্ধার করা যায়নি। পুলিশ গ্রেপ্তারকৃতদের জন্য সাতদিনের রিমান্ড আবেদন করলে শুক্রবার দুপুরে চারদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত।  

তারা হলেন- এজাহারভুক্ত পাঁচ নম্বর আসামি দত্তপাড়া বাজার কমিটির সভাপতি ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মনির হোসেন রুবেল (২৮), চার নম্বর আসামি বশিকপুরের নন্দীগ্রামের আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার ছেলে সবুজ (৩০), ১৪ নম্বর আসামি একই গ্রামের তাজুল ইসলামের ছেলে আজিজুল ইসলাম বাবলু (২৮)। আরেকজন ইসমাইল হোসেন, যিনি এজাহারভুক্ত আসামি নন।  

স্থানীয়দের অভিযোগ, সন্ত্রাসীদের জনপদ খ্যাত বশিকপুর এলাকাতে রয়েছে অত্যাধুনিক অস্ত্র ভাণ্ডার। যেগুলোর সাহায্যে হত্যাসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালানো হয়। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে স্থানীয় সন্ত্রাসীদের পাশাপাশি ভাড়াটে সন্ত্রাসীদেরও ব্যবহার করা হচ্ছে। আর এ এলাকাতে অস্ত্রধারী এ সন্ত্রাসী বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছেন আবুল কাশেম জেহাদী। যিনি চন্দ্রগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন।  

আবুল কাশেম জেহাদী দুইবার বশিকপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ছিলেন। ২০১১ সালের জুন থেকে ২০২২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত তিনি ইউপি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন।  

২০২১ সালের ২৬ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত বশিকপুর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তাকে হেরে যেতে হয় নিহত যুবলীগ নেতা নোমানের বড় ভাই মাহফুজুর রহমানের কাছে। এ থেকেই বিরোধের সূত্রপাত শুরু নোমানের সঙ্গে। পরাজিত হয়ে কাশেম জেহাদী কোণঠাসা হয়ে পড়েন। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নোমান ও তার ভাই ইউপি চেয়ারম্যানের সঙ্গে ঝামেলা করতেন জেহাদী।  

স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, জেহাদীর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করায় নোমানকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়।  

নোমানের ভাই ইউপি চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমান বার বার দাবি করে আসছেন, ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া বিরোধে তার ভাই নোমান ও ছাত্রলীগ নেতা রাকিব ইমামকে হত্যা করেছেন কাশেম জেহাদী। জেহাদী তাকে এবং তার ভাইকে হত্যার হুমকি দিয়ে আসছিলেন অনেকদিন ধরে।  

গত মঙ্গলবার (২৫ এপ্রিল) ঘটনার পর থেকে তিনি একই দাবি করে আসছিলেন। ঘটনার পরদিন বুধবার (২৬ এপ্রিল) বিকেলে নোমান এবং রাকিবের জানাজার নামাজের সময়ও একই দাবি করেছেন মাহফুজুর রহমান। তখন জানাজায় উপস্থিত হাজারো লোকজনের কণ্ঠে প্রশাসনের কাছে একটাই দাবি ছিল, সন্ত্রাসী বাহিনীর প্রধান জেহাদীকে গ্রেপ্তার করে বশিকপুরে দুই যুগের বেশি সময় ধরে চলা সন্ত্রাস নির্মূল করতে হবে।

ওই দিন রাতেই জেহাদীকে প্রধান আসামি করে আরও ১৭ জনের নাম উল্লেখ এবং অজ্ঞাতনামা ১৪ থেকে ১৫ জনকে আসামি করে চন্দ্রগঞ্জ থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন নোমানের বড় ভাই মাহফুজ।  

মামলায় দ্বিতীয় আসামি করা হয়েছে কাশেম জেহাদীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী মশিউর রহমান নিশানকে (৪৫), তৃতীয় আসামি করা হয়েছে রামগঞ্জ উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক দেওয়ান ফয়সালকে (৩৮)। যিনি জেলার রামগঞ্জ উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান বাচ্চু দেওয়ানের ভাই এবং কাশেম জেহাদীর সহচর হিসেবে পরিচিত। ঘটনার কিছু সময় পর ঘটনাস্থলের পাশে সিসি টিভি ক্যামেরার ফুটেজে যে আট সন্ত্রাসীকে অস্ত্র হাতে হেঁটে যেতে দেখা যায়, তাদের মধ্যে দেওয়ান ফয়াসলও রয়েছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয় লোকজন।  

এদিকে ঘটনার পর থেকে জেহাদী কোথায় আত্মগোপনে আছেন, তা নিয়ে নানা জল্পনা কল্পনা চলছে জেলাব্যাপী। দীর্ঘ সময় ধরে বশিকপুরের পোদ্দার বাজারে বসবাস করলেও সম্প্রতি তিনি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছেন জেলা শহরের থানা সড়কের নদী বাংলা নামে একটি বহুতল ভবনে। যেটি থানার খুবই কাছাকাছি। ঘটনার আগে বা পরে সেখান থেকেই আত্মগোপনে চলে যান তিনি- এমনটাই গুঞ্জন চলছে।

জেহাদীকে খুঁজে বের করে তাকে আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন জেলার বাসিন্দারা এবং নিহতদের স্বজনরা।  

হত্যা মামলার বাদী মাহফুজুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, ঘটনার পর থেকেই হত্যাকাণ্ডে জড়িত হিসেবে আবুল কাশেম জেহাদীকে দায়ী করে আসছি। প্রশাসনকেও বলেছি। মামলাও করেছি। কিন্তু কেন জেহাদীকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হচ্ছে না, সেটা প্রশাসনই জানে।

এদিকে নোমানের সঙ্গে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা রাকিব ইমামের হত্যাকারী হিসেবেও আবুল কাশেম জেহাদীকে দায়ী করা হচ্ছে। নিহত রাকিবের বাড়িতে যেন কান্নার রোল থামছেই না।  

মরার আগে খুনি জেহাদীর ফাঁসি দেখে যেতে চান রাকিব ইমামের বৃদ্ধ বাবা রফিক উল্যাহ। তিনি বলেন, ছেলের খুনিদের ফাঁসি হোক। আমি এটাই চাই। আমি ক্যান্সারের রোগী। ১০ বছর ধরে আমি ভুগছি। আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়ে রাখছেন আমার ছেলেকে কবর দেওয়ার জন্য।  

বলেন, খুবই দুঃখ লাগে, এখনো পর্যন্ত পার্টিগতভাবে (জেলা আওয়ামী লীগ) কোনো পদক্ষেপ নিল না।  

হত্যার ঘটনায় পুলিশ সুপার মো. মাহফুজ্জামান আশরাফ গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, প্রধান আসামি আবুল কাশেম জেহাদী আত্মগোপনে আছেন। তাকে ধরার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করছি। তার মোবাইল ফোন বন্ধ রয়েছে। আমরা আশা করছি এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত প্রত্যেককে আমরা আইনের আওতায় আনব।  

মঙ্গলবার (২৫ এপ্রিল) রাত সাড়ে ৯টার দিকে লক্ষ্মীপুরের পোদ্দার বাজার ব্রিজের পশ্চিম পাশে নাগেরহাট সড়কের মাদরাসাতুল আবরার নামক একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামনে রাস্তার পাশে সাবেক যুবলীগ নেতা নোমানের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে খুব কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এর আগে নোমানের সঙ্গে থাকা ছাত্রলীগ নেতা রকিব ইমামকে ঘটনাস্থলের অদূরে একটি করাত কলের সামনে গুলি করা হয়।  

বাংলাদেশ সময়: ১৩৩৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ৩০, ২০২৩
এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।