ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

রাজনীতি

বরিশালে ছাত্রলীগ মানেই ছিল আতঙ্ক

মুশফিক সৌরভ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৪১ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৭, ২০২৪
বরিশালে ছাত্রলীগ মানেই ছিল আতঙ্ক ২০১৫ সালের ৫ মে বরিশাল পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের প্রধান ছাত্রাবাসে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষ চলাকালীন ছবি

বরিশাল: মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জড়িত বরিশালে ছাত্রলীগের রাজনীতি। আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের সঙ্গে বরিশালের সন্তান হয়ে ছাত্রলীগের অনেকে ঢাকার রাজপথে ভূমিকাও রেখেছেন।

কিন্তু ন্যক্কারজনক হলেও সত্য যে, এই সংগঠনটি বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক থেকে আতঙ্কের নাম হয়ে ওঠে।  শুধু প্রতিপক্ষ ছাত্র সংগঠনের ওপর চড়াও হওয়াই নয়, তারা জড়িয়ে পড়ে খুন-জখম, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, তদবির বাণিজ্য, অবৈধ সম্পদ অর্জনসহ অনৈতিক ও নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে।

২০০৯ সালের নির্বাচনের পর ছাত্রলীগ তেমন কোনো ঘটনায় আলোচিত না হলেও, ২০১০ সালের বরিশাল সরকারি পলিটেকনিক ইন্সটিটিউশনে ৪ মে ধারালো অস্ত্র নিয়ে রক্তাক্ত জখমের ঘটনার মধ্য দিয়ে আলোচনায় আসে ছাত্রলীগ। যদিও সময়ের পরিক্রমায় এ দুটি ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত দুই পক্ষের নেতারাই রাজনৈতিক আশ্রয়ে নিরাপদে পরবর্তীতে বরিশাল দাপিয়ে বেড়িয়েছে।  

আর এরপর থেকেই বরিশাল সিটি করপোরেশনে সাবেক মেয়র প্রয়াত শওকত হোসেন হিরণ ও বরিশাল-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ’র অনুসারী ছাত্রলীগের মধ্যে বিভক্তির বিষয়টি ধীরে ধীরে প্রকাশ্য রূপ নেয়।

২০১৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি নতুন অধ্যক্ষ শংকর চন্দ্র দত্ত নিজ কর্মস্থল বিএম কলেজে যোগ দিতে যাওয়ার পথে কর্মপরিষদের নেতাকর্মী ও বহিরাগত ছাত্রলীগের কর্মীরা তাকে মারধর করে। এ ঘটনায় দেশজুড়েফের আলোচনার জন্ম দেয় ছাত্রলীগ। যদিও এ যাত্রায় ছাত্রলীগের কয়েকজন অনুসারী সাময়িক কারাভোগ করে রাজনৈতিক আশ্রয়ে রক্ষা পান।

তবে এর আগে থেকেই বরিশাল সরকারি ব্রজমোহন কলেজ, সরকারি বরিশাল কলেজ, সৈয়দ হাতেম আলী কলেজ, শের ই বাংলা মেডিক্যাল কলেজসহ বরিশাল মহানগর ও জেলার বিভিন্ন উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণে নেওয়া শুরু করে ছাত্রলীগ। ফলে ক্যাম্পাসগুলোতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা র‌্যাগিংসহ শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে থাকেন। অভিযোগ রয়েছে, ছাত্রলীগের প্রশ্রয়েই ক্যাম্পাসগুলোতে মাদক ও জুয়ার আসর বসত প্রতিনিয়ত।

ছাত্রলীগের অনুসারীরাই স্থানীয় সরকার বিভাগ, শিক্ষা প্রকৌশল, সড়ক ও জনপদ বিভাগ, গণপূর্ত বিভাগ, পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ঠিকাদারি কাজেও প্রভাব বিস্তার শুরু করে। ঠিকাদারি কাজকে কেন্দ্র করে বেশ কয়েকবার জেলা ও মহানগর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে মারামারির ঘটনাও ঘটে।

যদিও বরিশাল সদর আসনের সংসদ সদস্য থাকাকালীন শওকত হোসেন হিরণের মৃত্যুর পর ২০১৮ সালের এপ্রিল থেকে বরিশাল জেলা ছাত্রলীগের পাশাপাশি মহানগর ও জেলা ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় বরিশাল-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর বড় ছেলে ও সাবেক সিটি করপোরেশনের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর হাতে। এরপর থেকে হিরণপন্থিরা কোণঠাসা হয়ে পড়ে।  

তবে ২০১৪ এর উপনির্বাচনে হিরণপত্নী জেবুন্নেছা আফরোজ সংসদ সদস্য হলে কিছুটা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে হিরণপন্থি ছাত্রলীগের নেতারা।  

২০১৪ এর পর বেশ কিছুদিন সরকারি ব্রজমোহন কলেজ, শের ই বাংলা মেডিক্যাল কলেজ ক্যাম্পাসসহ নগরে হিরণপন্থি ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা সাদিকপন্থিদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। ফলে এর বিরুপ প্রভাব পরে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর। এভাবেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বরিশালজুড়ে সন্ত্রাসবাদের প্রসার ঘটায় ছাত্রলীগ।

তবে সাদিকের একক আধিপত্যে মারামারি করে অস্ত্রের মহড়া দেখিয়েও নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে পারেনি বিকল্পপন্থিরা।

এরমাঝেই সরকারি পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের ছাত্রলীগ নেতা মো. রেজাউল করিম ওরফে রেজা ২০১৬ সালের মে মাসে হত্যার শিকার হন। আর তার মৃত্যুকে নিয়ে হিরণ ও সাদিকপন্থিদের ছাত্রলীগ নেতারা বিবাদ চরম আকার ধারণ করে।

এদিকে ২০১৮ সালে জাহিদ ফারুক বরিশাল সদর আসনের এমপি হলে হিরণপন্থিরা তার হাত ধরে কিছুটা শক্ত অবস্থানে চলে এলেও সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ মেয়র হওয়ায় নগরজুড়ে আধিপত্য ধরে রাখে তার অনুসারীরা। যদিও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন ক্যাম্পাসে সাংসদ ও মেয়রের অনুসারীরা দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে প্রায়ই মারামারিতে লিপ্ত হতে থাকে।  

কোটা আন্দোলন বানচাল করতে বরিশালের বিভিন্ন পয়েন্টে ধারালো অস্ত্র ও লাঠিসোঁটা হাতে শত শত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীর মহড়া

এদিকে এমপিপন্থিদের হাত থেকে মহানগর ছাত্রলীগের নেতৃত্ব চলে যায় মেয়রপন্থিদের হাতে। ২০১১ সালের দেওয়া কমিটির সভাপতি জসিম উদ্দিন ও সম্পাদক অসীম দেওয়ানের হাত থেকে চলে যায় নেতৃত্ব। ২০২১ সালে ছাত্রলীগের নতুন কমিটির আহ্বায়ক হন তৎকালীন সিটি মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহর আস্থাভাজন রইজ আহম্মেদ মান্না। ছাত্রলীগের নেতৃত্ব চলে যায় মান্নার অনুসারীদের হাতে। যদিও সেই কমিটিও ২০২৩ সালে বিলুপ্ত করে দেয় কেন্দ্র। তখন নির্বাচনে সাদিক আব্দুল্লাহ’র চাচা আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ প্রার্থিতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার অভিযোগ ওঠে আহ্বায়কসহ অন্যদের বিরুদ্ধে।

বরিশালে ২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি বিএনপি নেতাকর্মীদের ছাত্রলীগ-যুবলীগ কর্মীদের হামলার ছবি

প্রতিপক্ষ দলগুলোর ছাত্রনেতারা বলছেন, প্রয়াত শওকত হোসেনের সময় থেকেই মহানগর ছাত্রলীগ দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল। আর জেলা ছাত্রলীগ তো সবসময়ই সেরনিয়াবাত পরিবারের আশীর্বাদপুষ্ট ছিল। তবে নগরকেন্দ্রিক ছাত্রলীগ দুটি গ্রুপ হলেও এরা সবাই ক্ষমতার ছত্রছায়ায় গিয়ে নগরজুড়ে দখল, বিরোধীদের নির্যাতন, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, ভোট জালিয়াতি, নারী কেলেঙ্কারি, পেছন থেকে কিশোর গ্যাং গ্রুপের লিডিং দেয়া, পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন এবং তাতে বাধা দিলে শিক্ষকদের লাঞ্ছনা, তদবির বাণিজ্য, অবৈধ সম্পদ অর্জন করাসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে লিপ্ত হয়ে যায়। অবৈধ সম্পদ অর্জন না করলে ছাত্ররাজনীতি থেকে হাত বদলের সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রনেতাদের ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার, ব্যবসার প্রসার ঘটার মতো কোনো কারণই নেই বলে দাবি প্রতিপক্ষ দলগুলোর ছাত্রনেতাদের।

আবার বয়স অতিক্রম করে যাওয়া, বিয়ে করা, সন্তান হওয়ার পরও জেলা ও মহানগর ছাত্রলীগের কমিটি বহাল থাকা, ক্যাম্পাসগুলোতে নতুন কমিটি না দিয়ে বিবাদ তুঙ্গে রাখার মতো অভিযোগ রয়েছে বরিশালে ছাত্রলীগের মধ্যে।  

শুধু তাদের ভয়ে সাধারণ মানুষ থেকে মুখ খুলতে না পারলেও ২০২৪ এর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে এর বহিঃপ্রকাশ দেখা গেছে। সাধারণ মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশই এমপি-মেয়রের বাড়িঘরে হামলার পাশাপাশি বিভিন্ন আওয়ামী লীগ দলীয় কার্যালয়ও ভাঙচুর করা হয়েছে। আর সাধারণ মানুষের ভয়ে এখন অবধি বরিশালের ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা আত্মগোপনে রয়েছেন।

বাংলাদেশ সময়: ১২২৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৭, ২০২৪
এমএস/এসএএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।