খুলনা: ‘বিএনপির দুর্গ’ হিসেবে পরিচিত খুলনা। সেই দুর্গেই এখন আঘাত লেগেছে।
একের পর এক জেলা ও মহানগর নেতাদের কারাবন্দি হওয়ার ঘটনায় নেতৃত্বহীন হতে বসেছে বিএনপি। ফলে সাংগঠনিক কার্যক্রমে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় হতাশা বিরাজ করছে তৃণমূল নেতাকর্মীদের মাঝে। দলের শীর্ষ স্থানীয় নেতারা কারাগারে ও গা ঢাকা দেওয়ায় জেলা ও মহানগর কার্যালয় থাকছে তালাবদ্ধ।
সোমবার (২৩ নভেম্বর) বিকেলে সরেজমিনে নগরীর কে ডি ঘোষ রোডস্থ দলীয় কার্যালয়ে গেলে এমন দৃশ্যের দেখা মেলে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দলের মহানগর সভাপতি ও কেন্দ্রীয় বিএনপির সহসাংগঠনিক সম্পাদক সাবেক সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম মঞ্জু পুলিশের ওপর হামলা মামলায় সোমবার (২৩ নভেম্বর) আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। আদালত তার জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠান।
নগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান মনি খুলনা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র পদ থেকেও পুলিশের ওপর হামলা মামলায় সাময়িত বহিষ্কৃত হয়ে গা ঢাকা দিয়েছেন।
তার বিরুদ্ধেও দু’টি মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। এছাড়া জেলা বিএনপির নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা থাকায় তাদের অনেকেই দলীয় কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করছেন না।
খোদ জেলা বিএনপির সভাপতি অধ্যাপক মাজিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তিনি বছরের ৩৬৫ দিনের মধ্যে ৩৬৪ দিনই ঢাকায় থাকেন। শুধুমাত্র রমজানের ইফতার মাহফিলে তিনি খুলনা আসেন বলেও দলীয় নেতাকর্মীদের অভিযোগ।
সাধারণ সম্পাদক শফিকুল আলম মনা সম্প্রতি একটি মামলায় কারাবরণের পর জামিনে মুক্ত হয়ে গা ঢাকা দিয়েছেন। একই অবস্থা সাংগঠনিক সম্পাদক আমীর এজাজ খানেরও।
এ অবস্থায় কেউই মামলার জালে পড়ে বর্তমান সময়ে প্রকাশ্যে দলের হাল ধরতে সাহস পাচ্ছেন না বলে জানা গেছে।
তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন, গত বছরের ৫ জানুয়ারির সরকার পতনের আন্দোলনের পর কয়েক দফা চেষ্টা করেও কোনো সফলতার মুখ দেখেননি তারা।
দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের কারাগারে আটক করার পর রাজপথে নামতে সাহস পাচ্ছেন না অন্য নেতাকর্মীরাও। সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতেও কেউ রাজপথে নামছেন না।
২১নং ওয়ার্ড বিএনপির কর্মী আব্দুস সালাম বলেন, মহানগর সভাপতি মঞ্জু কারাগারে। সাধারণ সম্পাদক ও খুলনা সিটির বহিষ্কৃত মেয়র মনি গ্রেফতারি পরোয়ানা নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
সহ সভাপতি ও খুলনা চেম্বারের সাবেক সভাপতি সাহারুজ্জামান মোর্ত্তজাকে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে শো’কজ করায় তিনিও সাইডলাইনে। এ অবস্থায় মহানগর বিএনপির হাল ধরার কেউ নেই বলে হতাশা প্রকাশ করেছেন আব্দুস সালাম।
ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলকে আন্দোলনের ভ্যানগার্ড বলা হলেও খুলনায় তাদের তৎপরতা নেই।
নগরীর ৩০নং ওয়ার্ড যুবদলের কর্মী মোহাম্মদ মাসুম বলেন, মামলা-মোকদ্দমায় দলের নেতাকর্মীরা জর্জরিত। গ্রেফতার আতঙ্কে নেতাকর্মীরা অনেকেই মাঠে নামতে পারছেন না। যেসব নেতারা নামছেন তারা কারাবরণ করছে। এ অবস্থায় বিএনপির সাংগঠনিক কাঠামো ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে।
বর্তমান নেতৃত্ব ও কাঠামো দিয়ে সামনের দিনে দল আর ক্ষমতায় যেতে পারবে কি-না, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তিনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মহানগর বিএনপির এক নেতা বলেন, গত কয়েক বছরে, বিশেষ করে এক-এগারোর পরে দলের রাজনৈতিক কর্মকৌশল প্রণয়নে কিছু ভুল-ত্রুটির কারণে জিয়াউর রহমানের আদর্শ থেকে বিএনপি অনেকটা সরে গেছে। ফলে যা হবার তাই হচ্ছে।
তিনি বলেন, বিএনপির দুর্গের ‘রাজপুত’ হিসেবে পরিচিত মহানগর বিএনপি সভাপতি মঞ্জুকে কারাগারে পাঠানোর ঘটনায়ও কোথাও কোনো প্রতিবাদ মিছিল বা সমাবেশ হয়নি। তরুণ নেতৃত্ব সৃষ্টির পাশাপাশি সক্রিয় নেতাদের কাজে লাগিয়ে এগিয়ে গেলে বিএনপি আবারও ঘুরে দাঁড়াতে পারবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, নগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মনি মেয়র পদ থেকে বহিষ্কৃত হলেও নগরীতে কোথাও কোনো প্রতিবাদ হয়নি। কেবলমাত্র একটি প্রেস ব্রিফিংয়ে দায় সেরেছেন দলের মহানগর নেতারা।
তিনি মনে করেন, এ অবস্থায় নেতৃত্বের হাল ধরতে ঢাকা থেকে খুলনায় আসতে পারেন মহানগর বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক ও বিসিবি’র সাবেক সভাপতি আলী আসগর লবি।
খুলনা মহানগর বিএনপির প্রথম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ তারিকুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, নেতৃত্বের সংকটে খুলনা বিএনপি, এটা মনে করা যাবে না। এটি একটি বিশাল দল। ‘মিথ্যা মামলায়’ নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হচ্ছে বলেও তিনি অভিযোগ করেন।
তিনি আরো বলেন, মহানগর বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে শতাধিক মামলা করা হয়েছে। গ্রেফতার আতঙ্কে রাতে বাড়িতে ঘুমাতে পারেন না কর্মীরা। এর মধ্যেও সম্প্রতি নগরীর ৩১টি ওয়ার্ড ও ২টি ইউনিয়ন শাখার সম্মেলন শেষ করা হয়েছে। এ থেকেই প্রমাণিত হয়, খুলনা বিএনপির সাংগঠনিক কার্যক্রম সক্রিয় রয়েছে।
খুলনা জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শফিকুল আলম মনা বাংলানিউজকে বলেন, মামলার জালে বন্দি নেতাকর্মীরা রাজপথে নামতে পারছেন না। নামলেই গ্রেফতার হচ্ছেন।
তিনি দাবি করেন, জেলা বিএনপির নেতাকর্মীরা প্রতিদিন ‘গণগ্রেফতারের’ শিকার হচ্ছেন। এ কারণে কেন্দ্র ঘোষিত সম্মেলন করা সম্ভব হচ্ছে না।
বাংলাদেশ সময়: ১১০৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৪, ২০১৫
এমআরএম/এএসআর