ঢাকা: রায়ের পর কোনো পক্ষকে সহিংস আন্দোলনের কর্মসূচিতে না যাওয়ার আহবান জানিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। এরপরও ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে হরতাল ডেকে আদালত অবমাননার অভিযোগের মুখোমুখি হন জামায়াত-শিবির নেতারা ও তাদের আইনজীবী।
সে যাত্রায় ভবিষ্যতে কোনো রায়ের পর রাজনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ করার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা হবে বলে লিখিত প্রতিশ্রুতি দিয়েই ক্ষমা চেয়েছিলেন জামায়াত-শিবিরের বর্তমান পাঁচ শীর্ষ নেতা। এরপরও ট্রাইব্যুনাল বা আপিল বিভাগ কোনো যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতাকে মানবতাবিরোধী অপরাধে কোনো দণ্ডাদেশ দিলেই বারবার হরতাল ডেকে আসছে যুদ্ধাপরাধীদের দলটি। ফাঁসির রায় কার্যকরের পরও ডেকেছে হরতাল।
এবার তাদের দলের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকরের প্রক্রিয়া চলাকালেই হরতাল ডেকে বসেছে জামায়াত। সোমবার (২৩ নভেম্বর) সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতালের ডাক দেওয়া হয়েছে। এর আগে মুজাহিদের রিভিউ আবেদন খারিজ করে মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল থাকার পরও গত বৃহস্পতিবার (১৯ নভেম্বর) হরতাল পালন করে দলটি।
অথচ বিচারিক আদালত ট্রাইব্যুনাল থেকে শুরু করে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ পর্যন্ত সব আদালতে সব ধরনের আইনি লড়াই চালিয়েছে এসব যুদ্ধাপরাধী এবং তাদের দল।
মুক্তিযুদ্ধে দলগতভাবে সশস্ত্র বিরোধিতাকারী জামায়াতের এসব হরতাল বা কোনো কর্মসূচি ডাকাকে তাই আদালত অবমাননার শামিল বলেই মনে করা হচ্ছে। একদফায় মুচলেকা দিয়ে ক্ষমা পেলেও এ ধরনের আদালতবিরোধী কার্যক্রমের জন্য আদালত অবমাননার অভিযোগে তাদেরকে কঠোর শাস্তি দেওয়া উচিৎ বলে মনে করছেন ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন।
এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ বলেন, আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হরতাল ডাকা নিঃসন্দেহে আদালত অবমাননা। আদালতের কোনো রায়ের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচি হতে পারে না।
তিনি আরও বলেন, এটিএম আজহারের মামলার রায়ের পর হরতালসহ নানা কর্মসূচি দেওয়ায় ট্রাইব্যুনালে জামায়াতের কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা হয়েছিল। সে অভিযোগের শো’কজ নোটিশের জবাবে ভবিষ্যতে কোনো রায়ের পর রাজনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ করার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা হবে- এ কথা বলে তারা নিঃশর্ত ক্ষমাও চেয়েছেন। ট্রাইব্যুনাল তাদের সতর্ক করে দিয়ে ক্ষমাও করে দিয়েছিলেন।
তুরিন আফরোজ আরো বলেন, আইনের ভেতর থেকে সকল ধরনের সুযোগ-সুবিধা তারা গ্রহণ করছেন, আবার আদালতের রায় বিরুদ্ধে গেলে সে রায়ের বিরুদ্ধে হরতাল দিচ্ছেন।
এবার দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হরতাল দিয়েছে জামায়াত। আমি মনে করি, এ হরতাল আদালতের বিরুদ্ধে। নিঃসন্দেহে এ কর্মসূচি আদালত অবমাননা।
গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলামের মামলার রায় পড়া শুরুর আগে ভূমিকা বক্তব্যে ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম রায়ের পর কোনো পক্ষকে সহিংস আন্দোলনের কর্মসূচিতে না যাওয়ার আহবান জানান। তিনি বলেন, সহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে রায় পরিবর্তন করা যায় না। এর জন্য আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যেতে হবে।
প্রসিকিউশন, আসামিপক্ষ, সাংবাদিক এবং রায় পর্যবেক্ষকদের উদেশ্যে ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বলেন, ফৌজদারি মামলায় সব পক্ষকে খুশি করে রায় দেওয়া সম্ভব নয়। এ কথা আগেও বলেছি, এখন আবারও উচ্চারণ করছি।
তিনি আরো বলেন, বিচারকরা আইন এবং সংবিধানসম্মতভাবে বিচার করে থাকেন। আইনের সেই বিচার প্রক্রিয়ায় কোনো ভুল থাকলে সেটা আইনসম্মতভাবেই প্রতিকারের সুযোগ আছে। যে পক্ষই অসন্তুষ্ট বা সংক্ষুব্ধ হন না কেন, তা উচ্চ আদালতে আপিলের সুযোগ রয়েছে।
বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম বলেন, রায়ের পর আইনে বিশ্বাসী কোনো মানুষ কোনো সহিংস কর্মসূচি দিতে পারেন না। এবং কোনো সহিংস কর্মসূচি কাম্যও নয়। বিচারকদের মানসিক চাপের কারণ হতে পারে এমন কর্মসূচি থেকেও বিরত থাকা উচিত।
আজহারের মামলাটির রায়ের আগে ট্রাইব্যুনাল এ আহবান জানালেও তা গ্রাহ্য করেনি জামায়াত। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রংপুর জেলা আলবদর বাহিনীর কমান্ডার আজহারকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়ায় ওই রায়ের বিরুদ্ধে ৩১ ডিসেম্বর ও ১ জানুয়ারি দু’দিনের হরতাল ডেকে বসে তারা। রায়ের প্রতিবাদে দেওয়া বিবৃতিতে এ রায়ের প্রতিক্রিয়ায় নানা বিরুপ কথা বলেন জামায়াতের পাশাপাশি শিবিরের শীর্ষ পদে থাকা নেতারাও। এমনকি রায়ের প্রতিক্রিয়ায় জামায়াত নেতাদের আইনজীবী তাজুল ইসলাম বলেন, ট্রাইব্যুনাল, প্রসিকিউশন ও রায়ের প্রতি চরম অবমাননাকর, ঔদ্ধত্যপূর্ণ নানা মন্তব্য করেন।
বারবার ক্ষমা চেয়ে আদালত অবমাননার অভিযোগ থেকে ক্ষমা পাওয়া জামায়াতের আইনজীবী তাজুল ইসলাম সেদিন রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশন যে সাক্ষ্য-প্রমাণ দিয়েছেন, সেটা গ্রহণ না করে ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলা হলেই সুবিচার হতো’।
যে সাক্ষ্য ও প্রমাণের ভিত্তিতে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলামকে ফাঁসির রায় দেওয়া হয়েছে তা এক ‘অষ্টম আশ্চর্যজনক ঘটনা’ বলেও মন্তব্য করেন তাজুল।
আজহারের এই আইনজীবী বলেন, একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে ট্রেন থেকে আজহারকে নামতে যে তিনজন দেখেছেন বলে ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়েছেন, তাদের কেউ দেখেছেন ৬ কিলোমিটার দূর থেকে, কেউ ৩ কিলোমিটার ও আবার কেউ দেখেছেন দেড় কিলোমিটার দূর থেকে। এসব সাক্ষ্যের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা ‘অষ্টম আশ্চর্যজনক ঘটনা’ বলে আমরা মনে করি।
অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম বলেন, যেসব সাক্ষ্য ও দালিলিক প্রমাণের ভিত্তিতে আজহারুল ইসলামকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে, সেসব সাক্ষ্য ও দালিলিক কাগজপত্র যদি ডাস্টবিনে ফেলা হতো তাতে সুবিচার হতো।
এসব সাক্ষ্য-প্রমাণে মৃত্যুদণ্ড হওয়া দূরের কথা, এসব অভিযোগ দাখিলের জন্য প্রসিকিউশনের জরিমানা হওয়ার দরকার ছিল বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে এ হরতাল ডাকা ও এসব বিরুপ মন্তব্য করায় গত ১২ জানুয়ারি জামায়াত-শিবিরের পাঁচ শীর্ষ নেতা ও তাজুল ইসলামের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ এনে শো’কজ নোটিশ দিয়েছিলেন ট্রাইব্যুনাল। নোটিশে কেন তাদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা হবে না- তা জানতে চেয়েছিলেন ট্রাইব্যুনাল। ২৮ জানুয়ারি তাদেরকে সশরীরে হাজির হয়ে অথবা আইনজীবীর মাধ্যমে এর ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়।
শো’কজপ্রাপ্ত জামায়াত-শিবির নেতারা হলেন- জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমির মকবুল আহমেদ, ভারপ্রাপ্ত নায়েবে আমির মুজিবুর রহমান ও ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল ড. শফিকুর রহমান এবং ছাত্রশিবিরের সভাপতি আব্দুল জব্বার ও সাধারণ সম্পাদক মো. আতিকুর রহমান।
গত ২৮ জানুয়ারি অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম এবং ১৫ এপ্রিল জামায়াত-শিবিরের ৫ নেতা আইনজীবীর মাধ্যমে লিখিত ব্যাখ্যা দাখিল করে নি:শর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেন।
জামায়াত নেতাদের জবাবে লিখিতভাবে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় যে, ভবিষ্যতে কোনো রায়ের পর রাজনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ করার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা হবে।
গত ৪ মে লিখিত জবাবে নি:শর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করায় অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলামকে এবং ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য হওয়ায় তিন জামায়াত নেতাকে ক্ষমা করে দেন ট্রাইব্যুনাল। একইসঙ্গে তাদেরকে ভবিষ্যতের জন্য এ ধরনের কাজ থেকে বিরত থাকতে সতর্ক করে দেওয়া হয়।
তবে দুই শিবির নেতার ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য হয়নি উল্লেখ করে ওইদিন (৪ মে) তাদের বিরুদ্ধে রুল জারি করা হয়। রুলে কেন তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে না তা জানতে চাওয়া হয়েছিল।
পরে শিবিরের দুই নেতাও আইনজীবীর মাধ্যমে এ রুলের জবাব দাখিল করে নি:শর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেন। সেদিন শুনানি শেষে ৩০ জুনের চূড়ান্ত আদেশে শিবির নেতাকেও সতর্ক করে ক্ষমা করেন ট্রাইব্যুনাল-১।
বাংলাদেশ সময়: ০৮০২ ঘণ্টা, নভেম্বর ২২, ২০১৫
এমএইচপি/এএসআর
** গ্রেফতার থেকে ফাঁসি: পাঁচ বছরের বিচারিক প্রক্রিয়া
** ফাঁসিতে ঝুললেন সাকা
** কারাফটকে সাকা-মুজাহিদের মরদেহ বের করার প্রস্তুতি
** ফাঁসির মঞ্চে তারা কোনো রিঅ্যাক্ট করেননি
** গহিরা কবরস্থানে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অবস্থান
** শেষ দেখা করে ফিরলো মুজাহিদের পরিবারও
** সাকা প্রাণভিক্ষা চাননি, দাবি বিএনপিরও
** মৃত্যুদণ্ড রাতেই কার্যকর, দাফন গ্রামের বাড়িতে
** সাকা-মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরে আতঙ্ক নেই রাজধানীবাসীর
** ফাঁসির মঞ্চের রক্ষী দল কারাগারে
** কারাগারে মুজাহিদের পরিবার, বের হয়েছে সাকার পরিবার
** তওবা পড়াতে কারাগারে ইমাম
** প্রাণভিক্ষা চাননি বাবা, শেষ দেখা করে দাবি হুম্মামের
** কারাফটকে ৪ অ্যাম্বুলেন্স
** মুজাহিদ-সাকার মৃত্যুদণ্ড পর্যায়ক্রমে কার্যকর হবে
** সাকার মরদেহ ঠেকাতে রাউজানের প্রবেশপথে মুক্তিযোদ্ধারা
** আইডিয়াল ক্যাডেট মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে মুজাহিদের শেষ ঠিকানা
** প্রাণভিক্ষা চাওয়ার বিষয়টি জানে না সাকার পরিবার!
** রায় কার্যকরের অপেক্ষায় শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ
** ঔদ্ধত্যের অবসান, মুজাহিদই সেই যুদ্ধাপরাধী!
** মুক্তিযোদ্ধাদের স্লোগানে মুখর কারাফটক
** কারাগারের পথে ফাঁসির নির্বাহী আদেশ
** কারাগারে ম্যাজিস্ট্রেট-আইজি প্রিজন-ডিসি-সিভিল সার্জন
** প্রাণভিক্ষার আবেদন: একাত্তরের অপরাধ স্বীকার মুজাহিদ-সাকার
** কারাগারের ভেতরে সাকার পরিবার, অপেক্ষায় মুজাহিদের
** মুজাহিদ-সাকার ফাঁসি : দ্বিতীয়দিনের মতো প্রশিক্ষণ নিলেন সাত জল্লাদ
** সাকা-মুজাহিদের ফাঁসি সময়ের ব্যাপার
** মুজাহিদের বাড়ির সামনে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অবস্থান
** ‘প্রাণভিক্ষার আবেদনের বিষয়টি দ্রুত নিষ্পত্তি হবে’
** ফের কারাফটকে ধরনা সাকার আইনজীবীর
** প্রাণভিক্ষার আবেদন নিষ্পত্তি সময়ের ব্যাপার: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
** মুজাহিদের স্ত্রীর বক্তব্যের ভিত্তি নেই, বললেন অ্যাটর্নি জেনারেল
** একাত্তরের অপরাধ স্বীকার মুজাহিদ-সাকার
** ফের কারাফটকে ধরনা সাকার আইনজীবীর
** রাষ্ট্রপতি সাংবিধানিক অভিভাবক, সুবিচার চাই
** সাকার প্রাণভিক্ষা নিয়ে বিএনপি-ফারহাত কাদেরের ভিন্নমত