ঢাকা: বিগত নির্বাচনে জাতীয় পার্টি স্পষ্ট দু’টি ধারায় বিভক্ত হয়ে যায়। একদিকে ছিলেন নির্বাচনে না যাওয়ার পক্ষে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ শিবির।
এরশাদ বারবার নির্বাচন বয়কটের ঘোষণা দেন। জাপা প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। এমনকি ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর এরশাদকে গোয়েন্দা বাহিনী তুলে নিয়ে যাওয়ার পরদিন এরশাদের বরাত দিয়ে সবাইকে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের অনুরোধ জানান তৎকালীন মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার। এরশাদের সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান দলের ২১৬ জন প্রার্থী।
অন্যদিকে রওশন এরশাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নির্বাচনে অংশ নেন ৭২ জন প্রার্থী। অনেক নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে জাতীয় পার্টি থেকে ৩৪ জন নির্বাচিত হন। সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। মন্ত্রিসভায় ঠাঁই হয় জাপার তিন নেতার। খোদ এরশাদও মন্ত্রী পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর দূত হিসেবে শপথ নেন।
তখন নেতারা বলাবলি করতেন, এরশাদকে চাপে রেখে এসব করানো হচ্ছে। এতে তার (এরশাদ) কোনোই সমর্থন নেই। সুযোগ পেলেই বেঈমানদের শায়েস্তা করবেন এরশাদ। সিএমএইচে ভর্তি এরশাদও না-কি তাদের সেই কথা বলেছেন। এমনকি এরশাদের নির্দেশ অমান্য করে যারা নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন তাদের উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া হবে। তাদের ভাগ্যে নেমে আসতে পারে বহিস্কারের খড়গ।
সিএমএইচে ভর্তি এরশাদের সেই কথার ওপর ভিত্তি করে অনেকেই আশায় বুক বেঁধেছিলেন। এমনকি এরশাদের মুক্তির জন্য পোস্টারিং থেকে শুরু করে আন্দোলনে নেমেছিলেন। এজন্য তখন তাদেরকে নানা রকম হুমকি-ধামকি সহ্য করতে হয়। তখন এরশাদ বলেছিলেন, ‘তোমরা আমার পাশে দাঁড়িয়েছো। আমি হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এসে তোমাদের মূল্যায়ন করবো’।
এরশাদ মুক্তির সেই ‘আন্দোলনে’ প্রেসিডিয়াম সদস্যদের মধ্যে ছিলেন মাত্র সাতজন- গোলাম মোহাম্মদ কাদের, গোলাম হাবীব দুলাল, অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন খান, আহসান হাবীব লিংকন, মীর আব্দুস সবুর আসুদ, শেখ সিরাজুল ইসলাম ও হাজী সাইফুদ্দিন আহমেদ মিলন।
অন্যরা সবাই প্রকাশ্যে অথবা গোপনে রওশনের দলে ভিড়েছিলেন। কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে ভাইস চেয়ারম্যান এটিএম গোলাম মাওলা চৌধুরী, জহিরুল আলম রুবেল, বনানী থানা জাতীয় পার্টির নেতা আনোয়ার হোসেন তোতা, মোটর শ্রমিক পার্টির নেতা মোস্তাকুর রহমান প্রকাশ্য অবস্থান নেন।
অন্যদিকে রওশনপন্থী গ্রুপের অগ্রভাগে ছিলেন প্রেসিডিয়াম সদস্য তাজুল ইসলাম চৌধুরী, জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু, ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, কাজী ফিরোজ রশীদ, এসএম ফয়সল চিশতীরা।
তৎকালীন পার্টির মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদারের প্রকাশ্য ভূমিকা ছিলো এরশাদের পক্ষে, কথাবার্তা বলতেন এরশাদের সুরেই। কিন্তু কার্যক্রম ছিলো রহস্যজনক। তার বাসা থেকেই রাতের আঁধারে লাঙ্গল প্রতীক বরাদ্দের চিঠি দেওয়া হয়। আবার তিনি বারবার মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের জন্যও অনুরোধ করে যাচ্ছিলেন জাপার প্রার্থীদের।
কিন্তু নিজে এবং তার স্ত্রী রত্না আমিন হাওলাদার মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার থেকে বিরত থাকেন। এমনকি আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে তার স্ত্রীকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত করে নেন। যে কারণে তাকে ‘বেঈমান’ হিসেবে চিহ্নিত করেন এরশাদ সমর্থকরা।
এরশাদের ডাকে সাড়া দিয়ে যারা মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেছিলেন, তারা আশায় ছিলেন, এরশাদ ফিরলে তাদেরকে বুকে তুলে নেবেন। কিন্তু এরশাদ তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেননি। বরং রওশনপন্থী ও তৃণমূলের কাছে ‘বেঈমান’ হিসেবে চিহ্নিতদের প্রমোশন দেন। আর তারাও পদ পেয়েই নির্বাচনকালীন সময়ের গ্রুপিংয়ের ক্ষোভ ঝাড়েন।
বিশেষ করে রওশনপন্থী নেতা জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু ও এসএম ফয়সল চিশতীর কারণে অনেকে ত্যাগী নেতাকর্মীর ওপর নেমে আসে বহিস্কারের খড়গ। যে আনোয়ার হোসেন তোতা ও মোস্তাকুর রহমান মোস্তাক ‘এরশাদ মুক্তি আন্দোলন’ করতে গিয়ে মারপিটের শিকার হন, তাদেরকেই দল থেকে বহিস্কার করেন এরশাদ।
এরশাদের এই দ্বি-মুখিতার কারণে এবার অনেকেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। আবার কেউ কেউ দুই দিকেই যোগাযোগ রক্ষা করে চলছেন। তারা মনে করছেন, এরশাদের সঙ্গে থেকে কোনো লাভ নেই। এক সময় তারা আবার মিশে যাবেন। শুধু শুধু প্রকাশ্য অবস্থান নিয়ে কারো বিরাগভাজন হওয়ার কোনো মানে হয় না।
যার প্রভাব দেখা গেছে মঙ্গলবারের (১৯ জানুয়ারি) বিশেষ সংবাদ সম্মেলনে। এদিন এরশাদের পাশে উপস্থিত হয়েছিলেন মাত্র ৩ জন প্রেসিডিয়াম সদস্য। অন্যদিকে আগের দিনে রওশন এরশাদের বাসায় এক ঘণ্টার নোটিশের বৈঠকে হাজির হয়েছিলেন ১৫ জন প্রেসিডিয়াম সদস্য ও ১৮ জন সংসদ সদস্য।
নানা কারণে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের এবারের দলের নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি নিজের কাছে রাখার ‘সংগ্রামটা’ সহজ হবে না বলে মনে করছেন অনেকেই।
এরশাদের এ দ্বি-মুখিতার কারণে অভিমানে দল ছেড়েছেন যুগ্ম মহাসচিব অধ্যাপক ইকবাল হোসেন রাজু।
তিনি বাংলানিউজকে জানিয়েছেন, আমরা আশা করেছিলাম, যারা তার কথা শুনে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেছেন, তাদেরকে বুকে টেনে নেবেন। কিন্তু ঘটেছে উল্টো। সব ‘মিরজাফরদের’ প্রমোশন দিয়েছেন। তাই দল ছেড়ে দিয়েছি।
আগের ক্ষোভের রেশ এখনও কাটেনি। তখন তৃণমূলের কাছে ‘মিরজাফর’ হিসেবে চিহ্নিত রুহুল আমিন হাওলাদারকে আবার মহাসচিব নিয়োগ দিয়েছেন এরশাদ। এতে চরম ক্ষুব্ধ সিনিয়র নেতারা। তারা বাবলুকে যেমন মানতে রাজি ছিলেন না, তেমনি রুহুল আমিন হাওলাদারের ফিরে আসাটাও প্রত্যাশা করেননি। তারা চেয়েছিলেন এরশাদের পরীক্ষিত সৈনিকদের মধ্যে থেকে কাউকে মহাসচিব করার জন্য।
নানা কারণে বিশাল একটি অংশ রওশনের পেছনে একাট্টা। বিশেষ করে এমপিরা প্রায় সকলেই (৫ জন ছাড়া) রওশনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। তারা নাকি রওশনকে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য খোলা মত দিয়ে রেখেছেন। যে কারণে রওশন বেঁকে বসলে বড় ধরনের সংকটে পড়তে হতে পারে এরশাদকে। এমনকি তার সাধের লাঙ্গলও হাত ছাড়া হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
দলের ভেতরে যেমন সংকট রয়েছে, তেমনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও অনেকটা বন্ধুহীন হয়ে পড়েছেন এরশাদ। বিশেষ করে গত সংসদ নির্বাচনের আগে ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে সাক্ষাত শেষে এরশাদ অকূটনৈতিকসুলভ বক্তব্য দিয়ে তিনি বিপদে রয়েছেন বলে মনে করেন সিনিয়র নেতারা।
জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান জিএম কাদের বাংলানিউজকে জানিয়েছেন, ‘চেয়ারম্যান নিশ্চয়ই সবকিছু ভেবে- চিন্তেই করেছেন। মানুষতো ভালো-মন্দ মিলেই হয়। আমার মনে হয়, হয়তো রুহুল আমিন হাওলাদারের চেয়ে উপযুক্ত কাউকে খুঁজে পাননি তিনি’।
‘জাতীয় পার্টির সংসদীয় দলের মধ্যে একটি গ্যাপ রয়েছে। এতে হাওলাদার সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করতে পারবেন। এতে বিভক্তি কমে আসবে’ বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন জিএম কাদের।
বাংলাদেশ সময়: ০০০৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২২, ২০১৬
এসআই/এএসআর