ঢাকা, রবিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

রাজনীতি

সিপিবির সমাবেশে সেদিন কী ঘটেছিল

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৫১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২০, ২০২০
সিপিবির সমাবেশে সেদিন কী ঘটেছিল ফাইল ছবি

ঢাকা: ২০০১ সালের ২০ জানুয়ারি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) পল্টনের মহাসমাবেশে বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। এতে পার্টির কয়েকজন নেতা মারা যান।

সোমবার (২০ জানুয়ারি) সকালে ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক রবিউল আলম এ হত্যাকাণ্ডের মামলার রায় ঘোষণা করবেন।

সেদিন পল্টনে সিপিবির মহাসমাবেশ চলাকালে বোমা হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা।

এ হামলায় খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার সিপিবি নেতা হিমাংশু মণ্ডল, রূপসা উপজেলার সিপিবি নেতা ও দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরির শ্রমিক নেতা আব্দুল মজিদ, ঢাকার ডেমরা থানার লতিফ বাওয়ানি জুট মিলের শ্রমিক নেতা আবুল হাসেম ও মাদারীপুরের মোক্তার হোসেন ঘটনাস্থলেই মারা যান। এছাড়া বোমা হামলায় খুলনা বিএল কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের নেতা বিপ্রদাস রায় আহত হয়ে ঢাকার বক্ষব্যাধি হাসপাতালে মারা যান। এছাড়া আহত হন বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী। এদের মধ্যে অমর মণ্ডল, লক্ষণ মণ্ডল, মো. জাহাঙ্গীর, আব্দুস সাত্তার, মিজানুর রহমান, এম এ করিমসহ অনেকেই পঙ্গু অবস্থায় বেঁচে আছেন।  

পল্টন ময়দানে সিপিবির সেই মহাসমাবেশে উপস্থিত কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী সেদিনের লোমহর্ষক ঘটনা বাংলানিউজের কাছে তুলে ধরেন।

তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটি ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা এস এম চন্দন বাংলানিউজকে বলেন, সেদিন বিকেল ৫টার দিকে সিপিবির মহাসমাবেশে আমার এক বন্ধুর সঙ্গে বাদাম খাচ্ছিলাম। ঠিক সেই সময় হঠাৎ করে বিদ্যুৎ চমকালে যেমন আলোর ঝলকানি দেখা যায়, দিনের বেলায় তেমননি আলোর ঝলকানি দেখতে পেলাম। এ সময় মনে হলো পল্টন ময়দানটাকে কে যেন একটা ঝাঁকি দিলো। এতে আমি কিছুক্ষণ হতবুদ্ধি হয়েছিলাম। আমি প্রথমে ভেবে ছিলাম কেউ হয়তো পটকা ফুটিয়েছে। একটু পরেই মনে হল পটকার শব্দ কি করে এতো তীব্র হবে, মাটি কেঁপে উঠবে, আগুনের উল্কা দেখা যাবে? এরপর একটু এগুতেই দু’জনের মরদেহ পড়ে থাকতে দেখি। এ মধ্যে একজন হিমাংশু মণ্ডল তিনি আমার পরিচিত ছিল। এরপর মরদেহ নিয়ে মিছিল হয়। স্টেডিয়ামের ভাসানী গেটের দিকে মিছিল গেলে পুলিশ মিছিলটি ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এরপর আমি রাজশাহী চলে আসি। পরদিন ২১ জানুয়ারি আধাবেলা দেশব্যাপী হরতাল ডাকা হয়।
 
তিনি বলেন, সেদিন আরও একটা ঘটনা ঘটেছিল, আমরা পরে জানতে পেরেছিলাম। স্টেডিয়াম মার্কেটের ভেতরে সিঁড়ির কাছে একই সময়ে আরও একটা বোমা বিস্ফোরণে দু’জন হকার মারা যান।  এ বিষয়টি এখনো পরিষ্কার হয়নি, সিপিবির সমাবেশে বোমা হামলার সঙ্গে জড়িতরাই কি স্টেডিয়ামের ভেতরের এ হামলা করেছেন।

সিপিবির সমাবেশে বোমা হামলার সঙ্গে এ ঘটনার কোনো যোগসূত্র রয়েছে কিনা? না অন্য কেউ এ হামলা করেছে? তবে সেদিন বোমা হামলায় সিপিবির পাঁচজন এবং দু’জন হকারসহ মোট সাতজন নিহত হয়েছিলেন বলেও জানান চন্দন।  
 
বর্তমানে একটি বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত সিপিবি সদস্য মুর্শিকুল ইসলাম শিমুল বাংলানিউজকে সেদিনের বোমা হামলা প্রসঙ্গে বলেন, সমাবেশ চলাকালে মোর্শেদ আলীর (তৎকালীন সিপিবির প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং কৃষক সমিতির সভাপতি) বক্তব্য দেওয়ার সময় বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। এর কিছুক্ষণ আগে কয়েকজন মোটর শ্রমিক তৎকালীন সিপিবি সভাপতি মঞ্জুরুল আহসান খান সম্পর্কে বানোয়াট ও মিথ্যা তথ্য সম্বলিত কিছু লিফলেট বিতরণ করছিল। তখন আমি এবং তৎকালীন খুলনা ছাত্র ইউনিয়নের রাসেল নামে একজন লিফলেট বিতরণকারীকে আটক করি। বোমা যেখানে বিস্ফোরণ ঘটে তার থেকে একটু দূরেই আমি ছিলাম। বিস্ফোরণের সময় আমি মাটিতে পড়ে যাই, বোমার আঘাতে আমার কানের পর্দা ফেটে যায়। মাটি থেকে উঠেই দেখি চারিদিকে শুধু ধোঁয়া আর ধোঁয়া। এরপর দেখি কয়েকটি মরদেহ পড়ে আছে।
 
বর্তমান সিপিবির উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য শাহাদত হোসেন সেদিনের বোমা হামলা প্রসঙ্গে বলেন, বোমা হামলা যেখানে হয় আমি সেখান থেকে সামান্য দূরে মাঠে ছিলাম। সমাবেশে তখন বক্তব্য চলছিল। হঠাৎ বোমা বিস্ফোরণ ঘটে। এরপর চারিদিকে মানুষের ছোটাছুটি শুরু হয়ে যায়। সমাবেশস্থলের আশপাশে কয়েকটি মরদেহ পড়ে থাকতে দেখি। আহতদের চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠানো হয়।
 
বর্তমানে সিপিবির সম্পাদক ও তৎকালীন সিপিবির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রুহিন হোসেন প্রিন্স বোমা হামলার প্রসঙ্গে বলেন, সেদিন সিপিবির সমাবেশের বিশেষত্ব ছিল সমাবেশে ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক, ক্ষেতমজুরসহ সমাজের প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী এবং কমিউনিস্ট পার্টি ছাড়াও সমস্ত বামপন্থি দলের নেতারাও উপস্থিত ছিলেন। মঞ্চে আরও উপস্থিত ছিলেন সরদার ফজলুল করিম, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, হাসান ইমাম প্রমুখ।  

তিনি বলেন, সেদিন সিপিবির লাখো মানুষের সমাবেশ দেশে বামপন্থিদের উত্থানের একটা বার্তা দেখা যাচ্ছিলো। আমার ধারণা প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি বামপন্থিদের মধ্যে ভীতি সঞ্চারের জন্য বোমা হামলা চালায়। যেন বামপন্থিদের উত্থান না ঘটতে না পারে।

তিনি আরও বলেন, আমরা মঞ্চে ছিলাম। মঞ্চ থেকে একটা বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পাই। প্রথমে আমরা বুঝতে পারিনি যে এমন একটা ভয়াবহ ঘটনা ঘটে গেছে। আমরা তখনো মঞ্চ থেকে নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে সমাবেশের কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেই। কিছুক্ষণ পর দেখি রক্ত আর রক্ত। আমাদের চারজন নেতা সেখানেই মারা যান। এরপর সমাবেশের চারিদিকে হুড়োহুড়ি লেগে যায়। আহতদের কীভাবে হাসপাতালে পাঠানো যায় সেই ব্যবস্থা করা হয়। এ ঘটনায় আমাদের খুলনার সিপিপি নেতা হিমাংশু মণ্ডল বোমার আঘাতে মৃত্যুবরণ করলেও শ্রমিক কৃষক মেহনতি মানুষের মুক্তির প্রতীক লাল পতাকা হাতে উঁচু করে ধরে রেখেছিলেন।

এদিকে, ২০১৪ সালের ২১ আগস্ট আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত। রাষ্ট্রপক্ষে মোট ১০৬ জন সাক্ষীর মধ্যে ৩৮ জন আদালতে সাক্ষ্য দেন। তবে আসামিপক্ষে কেউ সাফাই সাক্ষী দেননি।

মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, রাজধানীর পল্টন ময়দানে ২০০১ সালের ২০ জানুয়ারি সিপিবির সমাবেশে দুর্বৃত্তদের বোমা হামলায় ৫ জন নিহত এবং ২০ জন আহত হয়। ২০০৩ সালের ডিসেম্বরে আসামিদের বিরুদ্ধে নির্ভরযোগ্য তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি মর্মে তদন্ত শেষে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছিল।

বাংলাদেশ সময়: ০৯৫০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২০, ২০২০
আরকেআর/আরআইএস/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।