খুলনা: হঠাৎই খুলনায় রাজনীতিতে নতুন উত্তাপ দেখা যাচ্ছে। রাজপথে আগের চেয়েও বেশি সোচ্চার হতে শুরু করেছে বিএনপি ও তার অঙ্গ সংগঠন।
কেন্দ্র ঘোষিত বিক্ষোভ সমাবেশে চলাকালে ছাত্রলীগ ও পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনায় পণ্ড হয়ে যায় বিএনপির সমাবেশ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে টিয়ার-শেল নিক্ষেপ করে পুলিশ। ঘটনাস্থলে বিএনপি-যুবদল-ছাত্রদল ও ছাত্রলীগের মোট অর্ধশতাধিক নেতা-কর্মী আহত হন।
এ ঘটনায় মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব শফিকুল ইসলাম তুহিন, যুগ্ম-আহ্বায়ক সৈয়দা রেহেনা ঈসাসহ যুবদল, মহিলাদল ও ছাত্রদলের অন্তত ৩৭ জনকে আটক করেছে পুলিশ। এর প্রতিবাদে গতকাল সন্ধ্যার পর দলের জেলা সদস্য সচিব এস এম মনিরুল হাসান বাপ্পীর নেতৃত্বে নগরীতে বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়।
অপরদিকে, লোয়ার যশোর রোডস্থ দলীয় কার্যালয়ে নগর ও জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের উপস্থিতিতে তাৎক্ষণিক প্রেস ব্রিফিং করে ছাত্রলীগ। অন্যদিকে, বিএনপির কর্মসূচিতে পুলিশ ও ছাত্রলীগ-যুবলীগের হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়ে শুক্রবার (২৭ মে) প্রেস ব্রিফিং করবে বিএনপি।
কি ঘটেছিল বৃহস্পতিবার-
বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টার দিকে খুলনা থানাধীন ৬ নম্বর কে ডি ঘোষ রোডস্থ বিএনপির দলীয় কার্যালয়ের সামনে খুলনা মহানগর ও জেলা বিএনপির উদ্যোগে বিক্ষোভ সমাবেশ কর্মসূচি চলছিল। সমাবেশে প্রায় সাড়ে তিন থেকে চার হাজার নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন। অপরদিকে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক কর্তৃক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে কুরুচিপূর্ণ ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ মন্তব্যের প্রতিবাদে খুলনা ছাত্রলীগের উদ্যোগে বিকেল চারটার দিকে দলীয় কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ মিছিল কর্মসূচি চলছিল। এতে আড়াই থেকে তিন হাজার নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন।
বিকেল ৪টার দিকে ছাত্রলীগ হাদিস পার্কের সমাবেশ শেষ করে মিছিল নিয়ে পিকচার প্যালেস মোড়ের দিকে যায়। অপরদিকে কেডি ঘোষ রোডের সমাবেশ থেকে বিএনপির কর্মীরা পুলিশকে ধাওয়া করে। এ সময় পুলিশ পিছু হটে পিকচার প্যালেস মোড়ের দিকে যায়। পরে পুলিশ ও ছাত্রলীগ বিএনপির কর্মীদের পাল্টা ধাওয়া করে। এছাড়া যুবলীগের আরেকটি গ্রুপ কেডি ঘোষ রোডের দক্ষিণ দিক থেকে থানার সামনে থেকে বিএনপির কর্মীদের ধাওয়া করে। এ সময় দুই পক্ষের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায় পিকচার প্যালেস থেকে কেডি ঘোষ রোডের বিএনপির অফিসের সামনের গোটা এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।
সংঘর্ষে ছাত্রলীগ ও বিএনপির অন্তত অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী আহত হয়। এতে বিএনপির পূর্ব নির্ধারিত সমাবেশ পণ্ড হয়ে যায়। সংঘর্ষ চলাকালে উভয় দলের কর্মীরা দোকানপাট ভাঙচুর করে। এ সময় আতঙ্কে নগরীর দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। পরে বিএনপি অফিসের সামনে রক্ষিত পাঁচ শতাধিক চেয়ার ও বিএনপির সমাবেশের মঞ্চ ও ব্যানার-ফেস্টুন ভাঙচুর করা হয়।
বৃহস্পতিবার রাতে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি পারভেজ হাওলাদার অভিযোগ করেন, সম্পূর্ণ বিনা উস্কানিতে ছাত্রলীগের শান্তিপূর্ণ মিছিলের ওপর বিএনপি হামলা চালিয়েছে।
পুলিশের দাবি, সংক্ষিপ্ত সমাবেশ শেষে খুলনা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে ডাক বাংলো মোড় থেকে ঘুরে ফের দলীয় কার্যালয়ে ফেরার সময় পিকচার প্যালেস মোড় অতিক্রম করতে থাকে। এ সময় খুলনা মহানগর ও জেলা বিএনপির নেতাকর্মীরা দেশীয় অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ইট-পাটকেল নিয়ে মিছিলটির ওপর অতর্কিত হামলা চালায়।
এ সময় দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা বিএনপির নেতাকর্মীদের থামানোর চেষ্টা করলে তারা বাধা দেন। পুলিশকে লক্ষ্য করে তারা ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকেন বলে দাবি করেছেন বাহিনীর সদস্যরা।
বিএনপির নেতাকর্মীরা পুলিশ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ওপর চরম মারমুখী হয়ে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে। তাদের ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ার শেল নিক্ষেপ ও এবং শটগানের ফাঁকা গুলি করে পুলিশ।
খুলনা মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান রাসেল বলেন, বিএনপির নেতাকর্মীরা অতর্কিতভাবে আমাদের মিছিলে হামলা চালান। তারা প্রচুর পরিমাণ ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন। এতে আমাদের বেশ কিছু নেতাকর্মী আহত হন। তাদের মধ্যে অনেককে খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
বিএনপির মহানগর আহ্বায়ক শফিকুল আলম মনা বলেন, খুলনায় বিএনপির শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে পুলিশ ও ছাত্রলীগ-যুবলীগ ক্যাডাররা পূর্ব-পরিকল্পিতভাবে হামলা চালায়। তারা দলীয় কার্যালয়ের সামনে স্থাপিত মঞ্চ, সমাবেশ স্থলের শতাধিক চেয়ার, আশেপাশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ও ফুটপাতের দোকানপাট ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। বিএনপি অফিসের দরজা ভেঙে পুলিশ প্রবেশ করে এবং কার্যালয় এলাকা থেকে মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব শফিকুল আলম তুহিন, যুগ্ম আহ্বায়ক সৈয়দা রেহানা ঈসা, নগর মহিলা দলের সভাপতি আজিজা খানম এলিজাসহ বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মীকে আটক করে।
খুলনা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাসান আল মামুন বলেন, বিএনপির নেতাকর্মীদের ছোড়া ইট-পাটকেলের আঘাতে ১৪ পুলিশ সদস্য জখম হয়েছেন। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারি অস্ত্র-গুলি ও জানমাল রক্ষার্থে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা ১২৭ রাউন্ড শটগান, ৪৩ রাউন্ড গ্যাস-গান ফায়ার করেন। ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ আমলযোগ্য অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকায় খুলনা মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব শফিকুল আলম তুহিনসহ দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের ৩৭ জন নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করেছে। রাতে খুলনা সদর থানায় বিএনপি নেতা শফিকুর আলম তুহিনকে প্রধান আসামি করে ৯২ জনের নাম উল্লেখ করে এবং ৭০০-৮০০ অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামি করে একটি মামলা হয়। মামলা নং-৩১।
কয়েক বছর ধরে খুলনার মাঠের রাজনীতিতে মুখোমুখি অবস্থানে ছিল না বিএনপি-আওয়ামী লীগ। দীর্ঘদিন থেকে রাজনীতির মাঠে একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে ক্ষমতাসীন দল। দীর্ঘদিন পর মামলা ও ধরপাকড়ে রাজনীতির গরমের আবহ সৃষ্টি হয়েছে খুলনায়।
বাংলাদেশ সময়: ১২৩০ ঘণ্টা, মে ২৭, ২০২২
এমআরএম/এমজে