ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি

ভেড়ামারা বিদ্যুৎ কেন্দ্র

ঘণ্টায় লোকসান ৭ লাখ টাকারও বেশি

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ ও শরীফ বিশ্বাস | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৩৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৯, ২০১৪
ঘণ্টায় লোকসান ৭ লাখ টাকারও বেশি

কুষ্টিয়া থেকে: লাইফটাইম শেষ হয়েছে ১৩ বছর আগেই। তারপরও জোড়াতালি দিয়ে চলছে ভেড়ামারা বিদ্যুৎকেন্দ্র।

আপাত দৃষ্টিতে ভালো মনে হলেও দু’দিক থেকেই ক্ষতির শিকার হচ্ছে দেশ।
 
একদিকে যেমন প্রতি বছর সংস্কারের নামে বিপুল পরিমাণ টাকার শ্রাদ্ধ হচ্ছে, অন্যদিকে তেল পুড়লেও ঠিকমতো বিদ্যুৎ দিতে না পারায় উৎপাদন খরচ বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। যার প্রভাবে লাফিয়ে বেড়েছে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ।
 
সাধারণত ডিজেল দিয়ে উৎপাদিত প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম পড়ে ১৬ থেকে ১৮ টাকা। কিন্তু ভেড়ামারা বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে প্রতি ইউনিটের উৎপাদন খরচ পড়ছে ৩২ টাকা (২০১৩ সালে)। এতে করে প্রতি ঘণ্টায় বিদ্যুৎ বিভাগের ক্ষতি হচ্ছে প্রায় ৭ লাখ ২০ হাজার টাকা।
 
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের মালিকানাধীন ভেড়ামারা ৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে ৩টি ইউনিট রয়েছে। এর মধ্যে ২টি ইউনিট ১৯৭৬ সালে, অপরটি ১৯৮০ সালের ১৯ জানুয়ারি নির্মাণ করা হয়।

নির্মাণকালে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির লাইফটাইম ধরা হয়েছিলো ১৫ বছর। পরে ওভারহোলিং করে ২৫ বছর নির্ধারণ করা হয়।
 
কিন্তু সেই লাইফটাইম শেষ হয়েছে ২০০০ সালেই। তারপরও ১৩ বছর ধরে জোড়াতালি দিয়ে কোনো রকমে চলছে পুরনো অদক্ষ এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি। সরকার কয়েক দফায় বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও বন্ধ করা হয়নি শেষ পর্যন্ত। পুরনো হয়ে যাওয়ায় কোনোভাবেই সঠিক মাত্রায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে না কেন্দ্রটি।
 
এখন পুরো লোডে চালানো হলে সর্বোচ্চ ৪৫ মেগাওয়াট আওয়ার বিদ্যুৎ উৎপাদন করলেও ঠিকই ঘণ্টায় ১ লাখ ৮০ হাজার লিটার তেল পুড়ছে। একদিকে এতে যেমন জ্বালানি খরচ বেশি পড়ছে একই সঙ্গে যখন-তখন বিকল হয়ে পড়ায় কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ হচ্ছে।   
 
চলতি অর্থবছরে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৩৮ লাখ টাকা। তবে এই টাকা দিয়ে পুরোপুরি মেরামত করা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মীর রুহুল কুদ্দুছ।
 
উপযুক্ত বিকল্প থাকলেও শুধুমাত্র পরিকল্পনা আর সরকারি উদ্যোগের অভাবে প্রতি ঘণ্টায় ৭ লাখ ২০ হাজার টাকা লোকসান দিয়ে যাচ্ছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড। এখানে মেরামতের নামে ‘উচ্চপদস্থদের বাণিজ্যও’ বেশ খানিকটা দায়ী।
 
প্রকৌশলী মীর রুহুল কুদ্দুছ বাংলানিউজকে জানান, জাপান কনসালটিং ইনস্টিটিউট (জেসিআই) একটি সম্ভাব্যতা জরিপ (ফিজিবিলিটি স্ট‍াডি)  করেছিলো ২০০২ সালে। তারা পুরাতন অবকাঠামো ব্যবহার করে স্বল্প খরচে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি রিপ্লেস করার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলো।
 
এতে স্টোরেজ ট্যাঙ্ক, সার্ভিস ট্যাঙ্ক, সাব-স্টেশন অ্যান্ড ট্রান্সমিশন লাইন, পানি সরবরাহ সিস্টেম, কন্ট্রোল রুম পুরোপুরি অক্ষত থাকত। আর গ্যাস টারবাইনের ভিত্তির ওপর নতুন মেশিন বসানোর কথা বলেছিলো তারা। ৬ মাসের মধ্যেই এগুলো রিপ্লেস করা যেতো বলে জানিয়েছেন প্রকৌশলী মীর রুহুল কুদ্দুছ।
 
রিপ্লেস করা হলে বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়তো আর কমে যেতো উৎপাদন খরচ। প্রতি বছর বিশাল অংকের মেরামত-ব্যয় থেকে রক্ষা পেতো বিদ্যুৎ ‍উন্নয়ন বোর্ড। এ ছাড়া নতুন ও আধুনিক মেশিন স্থাপন করা গেলে অনেক সাশ্রয়ী খরচে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব।
 
জাপানি প্রতিষ্ঠানটি রিপ্লেস করার জন্য পৃথক দু’টি প্রস্তাবও দিয়েছিলো। সরকার তাদের অর্থায়নের ব্যবস্থা করে দিতো। অথবা তারা নিজেরাই অর্থায়নের ব্যবস্থা করে নিতো। তারা জাইকার সঙ্গে কথা বলে ফান্ড সংগ্রহ করে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলো।
 
কিন্তু তৎকালীন সরকার কোনো রকম ইতিবাচক সাড়া না দেওয়ায় ফেরত গেছে জেসিআই। তবে প্রতিষ্ঠানটি সমীক্ষা প্রতিবেদন (স্টাডি রিপোর্ট) দিয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন ভেড়ামারা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যবস্থাপক।
 
বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির একাধিক কর্মকর্তা বাংলানিউজকে জানিয়েছেন, সরকার অনেক স্থানে বিদ্যুৎকেন্দ্র করতে গিয়ে জমি অধিগ্রহণসহ নানা রকম সমস্যার শিকার হচ্ছে। কিন্তু ভেড়ামারা বিদ্যুৎকেন্দ্রে ৬৪.৮৩ এক জায়গা পড়ে রয়েছে। এই জমিগুলোর সঠিক ব্যবহার করতে পারে সরকার।
 
নতুন কোনো স্থানে বিদ্যুৎকেন্দ্র করতে গেলে সেখানে অবকাঠামো উন্নয়নে কোটি কোটি টাকা ব্যয় হয়। কিন্তু এখানে কোনো রকম অবকাঠামোর উন্নয়ন প্রয়োজন পড়বে না। সরকারের এদিকে নজর দেওয়া উচিত। এমনকি নতুন জনবল কাঠামো ছাড়াও এখান থেকে বাড়তি বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব।
 
ভেড়ামারা বিদ্যুৎকেন্দ্রে ২৭ জন কর্মকর্তা। ২২ জন প্রকৌশলীসহ মোট ১৫৫ জন স্টাফ রয়েছেন। পূর্ণাঙ্গ এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে বিদ্যালয়, মসজিদ, ক্লাব ভবন, ক্যান্টিনের জন্য আলাদা ভবন, বিশ্রামাগার, কর্মকর্তা কর্মচারীদের আবাসন, ডর্মেটরি, স্টোর ভবন, আনসার ব্যারাক ও সুইপার কলোনি রয়েছে। এখানে তেল সরবরাহের জন্য ভেড়ামারা থেকে রেল লাইন বসানো হয়েছে নির্মাণকালেই।
 
নতুন একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে এ ধরনের অবকাঠামো উন্নয়ন করতে গেলে হাজার কোটি টাকা ব্যয়েও তা করা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। আর কেনই বা এরকম একটি সুযোগকে কাজে লাগানো হচ্ছে  না তাও এটা বিস্ময় তাদের কাছে।
 
অথচ মাত্র অল্প দূরে নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করছে। সেখানে অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ চলছে।
 
বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব মনোয়ার ইসলাম বাংলানিউজকে জানিয়েছেন, পুরাতন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় বেশি পড়ছে একথা ঠিক। কিন্তু কিছুটা বাধ্য হয়ে চালানো হচ্ছে।
 
মধ্য মেয়াদের বড় বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো উৎপাদনে চলে আসলেই একটি ভারসাম্য তৈরি হবে। তখন পুরাতন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো সংস্কার করার পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে।

এছাড়া প্রতি বছরেই প্ল্যানিং করে মেরামতের কাজ অব্যহত রয়েছে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব।

বাংলাদেশ সময়: ১২৪০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৯, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।