ঢাকা, মঙ্গলবার, ৩০ আশ্বিন ১৪৩১, ১৫ অক্টোবর ২০২৪, ১১ রবিউস সানি ১৪৪৬

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি

৭ বছরেও চূড়ান্ত হয়নি কয়লানীতি

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬০২ ঘণ্টা, মে ১৮, ২০১১
৭ বছরেও চূড়ান্ত হয়নি কয়লানীতি

ঢাকা : সরকার আসে সরকার যায়, চূড়ান্ত হয় না কয়লানীতি। ২মাস ধরে ঝুলে আছে খসড়া কয়লানীতির রিভিউ কমিটি গঠনের প্রস্তাব।

৩টি সরকার ৭ বছরেও চূড়ান্ত করতে পারেনি খসড়া কয়লানীতি।

২০০৪ সালে বিএনপি সরকার প্রথম শুরু করে খসড়া নীতি প্রণয়নের কাজ। পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, সর্বশেষ বর্তমান সরকারও ঘুরপাক খাচ্ছে খসড়া নীতির মধ্যেই। আর কয়লানীতির চূড়ান্ত অজুহাতে টানা ৭ বছর বন্ধ রাখা হয়েছে অনুসন্ধান এবং উন্নয়ন কার্যক্রম।

পেট্রোবাংলা সূত্র জানিয়েছে, ১৯৯৫ সালে প্রণীত জাতীয় জ্বালানি নীতিমালার আলোকে দেশের গ্যাস, কয়লা, তেল ও বিদ্যুৎ বিভাগ পরিচালিত হয়ে আসছিলো।

২০০৪ সালে বিএনপি সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টা মাহমুদুর রহমান ঘোষণা করেন জ্বালানি নীতিমালার আলোকে কয়লা পরিচালিত করা হবে না। কয়লার জন্য পৃথক নীতি প্রণয়ন করতে হবে।

২০০৫ সালে আইআইএফসি নামের দেশীয় একটি প্রতিষ্ঠানকে খসড়া কয়লা নীতি প্রণয়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

আইআইএফসি খসড়া কয়লানীতি প্রণয়ন করে জমা দিলে অনুমোদনের জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার কাছে উপস্থাপন  করা হয়। প্রধানমন্ত্রী খসড়া অনুমোদন না দিয়ে বুয়েটের অধ্যাপক নুরুল ইসলামকে রিভিউ (সংশোধন সংযোজন) করার দায়িত্ব প্রদান করেন।

প্রফেসর নুরুল ইসলাম খসড়া কয়লা নীতির অনেকগুলো বিষয়ে পরিবর্তনের সুপারিশ করে রিপোর্ট জমা দেন। এরই মধ্যে বিএনপি সরকারের মেয়াদ শেষ হলে যায়।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণের ৬ মাসের মাথায় বুয়েটের সাবেক ভিসি প্রফেসর আব্দুল মতিন পাটোয়ারীকে প্রধান করে নতুন কমিটি গঠন করে খসড়া নীতি প্রণয়নের জন্য।

পাটোয়ারী কমিটি নামে পরিচিত এই কমিটি খসড়া প্রণয়ন করে জমা দিলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকার শেষ পর্যন্ত সেটিকে চূড়ান্ত করতে ব্যর্থ হয়।

ক্ষমতাসীন হন বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। শুরু হয়, কয়লানীতি নিয়ে  চলমান পর্ব। বর্তমান সরকার পাটোয়ারী কমিটি প্রণীত খসড়া কয়লা নীতি অনুমোদন না করে জ্বালানি সচিবকে প্রধান করে রিভিউ করার জন্য আন্ত:মন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করেন।

আন্ত:মন্ত্রণালয় কমিটি পাটোয়ারী কমিটির উস্থাপিত খসড়া যাচাই বাছাই শেষে, পাটোয়ারী কমিটির প্রণীত খসড়া নীতি এবং বাস্তবায়ন অংশকে দুই ভাগে ভাগ করে কিছু সংশোধনীসহ শুধুমাত্র নীতি অংশটি অুনমোদনের সুপারিশসহ জমা দেন গত বছরের অক্টোবর মাসে।

আন্ত:মন্ত্রণালয় কমিটির সুপারিশ মোতাবেক চূড়ান্ত না করে চলতি বছরের মার্চ মাসে আবারও উচ্চ পর্যায়ের রিভিউ কমিটি গঠনের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সরকার। ওই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর ২ মাস সময় পার হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত রিভিউ কমিটি গঠন করতে পারেনি জ্বালানি মন্ত্রণালয়।

জ্বালানি মন্ত্রণালয় সূত্র রিভিউ কমিটি গঠন না করার সত্যতা স্বীকার করে বলেছেন, চলতি মাসের মধ্যেই রিভিউ কমিটি গঠন করার সম্ভাবনা রয়েছে। এ বিষয়ে যুগ্ম সচিব (উন্নয়ন) শেফাউল আলমকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

জ্বালানিসচিব মেজবাহ উদ্দিন কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি।

পেট্রোবাংলার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (মাইনিং) মকবুল-ই ইলাহী বাংলানিউজকে বলেছেন, ‘সময় অনেক পার হয়ে গেছে। খসড়া কয়লানীতির মধ্যে আটকে থাকলে চরম বিপর্যয় নেমে আসতে পারে জ্বালানি খাতে। ’

তিনি আরো বলেন, ‘১৯৯৫ সালের জ্বালানি নীতিমালার আলোকে যদি তেল, গ্যাস উত্তোলন চলতে পারে তাহলে নতুন নীতিমালা না হওয়া পর্যন্ত কয়লার বিষয়টি ঝুলে রাখা হবে কেন?‌‌’

তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব আনু মুহাম্মদ বাংলানিউজকে বলেছেন, ‘কয়লানীতি চূড়ান্ত করার প্রধান বাধা হচ্ছে, সরকার দেশের স্বার্থে আন্তরিক নয়। তারা দেশি-বিদেশি লুটেরাদের স্বার্থ সংরক্ষণ করার জন্য কৌশল করতে গিয়ে নানাভাবে খসড়া (ড্রাফট) করছে। ’

‘প্রস্তাবিত খসড়াতে চালাকি করে বিভিন্ন বিষয় সংযোজন করা হয়েছে‘ দাবি করে আনু মোহাম্মদ আরো বলেন, ‘এখানে রফতানির সুযোগ রাখা হয়েছে। একইসাথে ‘বিদেশি কোম্পানি’ শব্দটির স্থানে ‘বিদেশি রাষ্ট্র’ শব্দটি জুড়ে দেওয়া হয়েছে।

নীতিগতভাবে কয়লার শতভাগ মালিকানা, শতভাগ দেশের জন্য ব্যবহার, উত্তোলন পদ্ধতি জনস্বার্থে করলেই কোনও সমস্যা থাকে না।

প্রস্তাবিত খসড়া অনুমোদন হলে দেশের পানিসম্পদ নষ্ট হবে, খাদ্য নিরাপত্তা বিঘিœত হবে এবং সর্বোপরি জনগণের ভোগান্তি বাড়বে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ইজাজ আহম্মেদ বাংলানিউজকে বলেন, ‘বর্তমান সরকার খসড়া কয়লানীতি প্রণয়নের বিষয়ে পুরোপুরি ব্যর্থ। সাহস দেখাতে ভয় পাচ্ছে। ’

তাদের কর্মকান্ড দেখে মনেই হয় না, তারা আসলে কয়লানীতি প্রণয়ন করতে চায়। সরকার কয়লা  তোলার বিষয়েও আগ্রহী বলে মনে হয় না আমার। ’  

তিনি আরও বলেন,‘আজকে সিদ্ধান্ত নিলেও নতুন কোনও খনি থেকে কয়লা উত্তোলনে সময় লাগবে কমপক্ষে ৪ বছর। আজকের সিদ্ধান্তের উপরই নির্ভর করছে ৪ বছর পরে আমরা কী করতে চাই। ’

সরকার তার প্রস্তাবিত খসড়া কয়লানীতির মুখবন্ধে লিখেছে, ‘অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম চালিকাশক্তি জ্বালানি। বাণিজ্যিক জ্বালানির জন্য দীর্ঘদিন ধরে দেশে মূলত প্রাকৃতিক গ্যাসের উপর নির্ভরশীলতা প্রায় ৭৩ শতাংশ গড়ে উঠেছে। ’

‘প্রাকৃতিক গ্যাসের উত্তোলনযোগ্য মজুদ দ্রুত নি:শেষিত হয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে গ্যাসের চাহিদা এবং সরবরাহের মধ্যে বড় ধরণের ব্যবধানের সৃষ্টি হয়েছে। শিগগিরই নির্ভরযোগ্য বিকল্প জ্বালানি সরবরাহ ও ব্যবহার নিশ্চিত করা না গেলে ভবিষ্যতে সংকট আরো ঘনীভূত হবে। ’

‘দেশের বিদ্যমান জ্বালানি উৎসসমূহের বিবেচনায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের অন্যতম প্রধান বিকল্প জ্বালানি হিসেবে কয়লা ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। ’

অর্থাৎ সরকার নিজেও জ্বালানি সংকটের ভয়াবহতা সম্পর্কে উদ্বিগ্ন। কিন্তু তাদের কর্মে সে উদ্বেগের কোনই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না বলে দাবি করেছেন বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশ সময়: ১২১০ ঘন্টা, মে ১৮, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।