ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি

উন্নত কয়লা মজুদ রেখেই আমদানির পরিকল্পনা!

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১০৬ ঘণ্টা, মে ৫, ২০১৬
উন্নত কয়লা মজুদ রেখেই আমদানির পরিকল্পনা!

ঢাকা : কয়লা আর কয়লা নীতির ওপর জেঁকে বসা আঁধার কিছুতেই কাটছে না। গত এক দশক ধরে একের পর এক রিভিউ কমিটির হাতে হাতে ঘুরছে প্রস্তাবিত কয়লা নীতি।

ইত্যবসরে দেশের মোট ৫টি ক্ষেত্রে প্রায় ৩ হাজার ৩শ’ মিলিয়ন টন উন্নত মানের কয়লা মজুদ রেখে চলছে বিদেশ থেকে কয়লা আমদানির মহাপরিকল্পনা।  

এর আগে বিদ্যুতের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় দেশীয় কয়লার ব্যবহারের কথা বলা হলে কয়লা উত্তোলন নিয়ে কিছুটা আশার সঞ্চার হয়েছিল। কিন্তু সেই আশার প্রদীপ নিভে যেতেও সময় লাগেনি। দেশীয় কয়লায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের সেই পরিকল্পনা পরিবর্তন করা হয়েছে।

এখন দেশীয় কয়লার পরিবর্তে আমদানি নির্ভর কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। সঙ্গে সরাসরি বিদ্যুৎ আমদানির পরিকল্পন তো রয়েছেই।
 
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) ২০১০ সালের মাস্টার প্ল্যানে বলা হয়েছিল, ২০৩০ সালে ৪০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। ওই সময়ে কয়লা দিয়ে উৎপাদন করা হবে ২০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। যার মধ্যে দেশীয় কয়লা দিয়ে ১২ হাজার এবং আমদানিকৃত কয়লা দিয়ে ৮ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে।

দেশীয় কয়লা দিয়ে যে ১২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা বলা হয়েছে, তাতে বছরে প্রায় ৩৬ মিলিয়ন টন কয়লা প্রয়োজন। বর্তমানে দেশের একমাত্র বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি থেকে বছরে মাত্র এক মিলিয়ন টন কয়লা উত্তোলন করা হচ্ছে।

সে হিসেবে ঘাটতি থেকে যায় প্রায় ৩৫ মিলিয়ন টন। যা শুধু বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি থেকে সরবরাহ করা সম্ভব নয়। তাই ধরেই নেওয়া হয়েছিল অন্যান্য কয়লা খনির ‌উন্নয়ন করা হবে।

অর্থমন্ত্রী ২০১৪-১৫ অর্থ বছরের বাজেট বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘দেশিয় কয়লা ক্ষেত্রসমুহ হতে কয়লা উৎপাদন বৃদ্ধির কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ অতীব জরুরি। ’

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদও অনেক বার বলেছেন, গ্যাস ফুরিয়ে আসছে। কয়লা উত্তোলনে এখনই পদক্ষেপ নিতে না পারলে সংকট তৈরি হতে পারে।

জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের হিসেবে, দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া, ফুলবাড়ি, জয়পুরহাটের দীঘিপাড়া, রংপুরের খালাশপীর এবং বগুড়ার কুচমাসহ পাঁচটি কয়লাক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে প্রায় ৩ হাজার ৩শ’ মিলিয়ন টন উন্নত মানের কয়লা মজুদ রয়েছে।

কিন্তু বর্তমানে কেবল বড়ুপুকুরিয়া খনি থেকে কয়লা উত্তোলন করা হচ্ছে। আর নীতি নির্ধারণী সিদ্ধান্তের অভাবে ঝুলে রয়েছে অন্য চারটি ক্ষেত্র থেকে  কয়লা উত্তোলন প্রসঙ্গ।

ফুলবাড়ি কয়লাখনির কাজ পেতে চায় এশিয়া এনার্জি। যে কোম্পানিটির বিরুদ্ধে এলাকাবাসির রয়েছে চরম অসন্তোষ। কোনোভাবেই এশিয়া এনার্জিকে সহ্য করতে চায় না তারা। ফুলবাড়ি থেকে কয়লা তুলতে যাওয়া আর অগ্নিশিখার মুখে বুক পেতে দেওয়া সমান বলে মনে করছে খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়।

দিঘীপাড়া কয়লা খনির কাজ নিয়ে বসে আসে পেট্রোবাংলা। সম্প্রতি ক্ষীণ আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে উত্তোলনের বিষয়ে। অন্যদিকে খালাশপীর থেকে আন্ডারগ্রাউন্ড মাইনিং পদ্ধতিতে কয়লা তুলতে চায় সমীক্ষাকারি কোম্পানি হোসাফ-কনসোর্টিয়াম লি.। এ নিয়ে খুব বেশি সমালোচনা নেই, আবার আলোচনাও নেই। হোসাফ ২০০৬ সালে খনি উন্নয়নের আবেদন করে। কিন্তু সেই প্রস্তাব এখনও ঝুলে রয়েছে।

যদিও এই মূল্যবান খনিজ সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে, ২০০৪ সালে কয়লার জন্য পৃথক নীতি প্রণয়নের কাজ শুরু করা হয়। ২০০৫ সালে আইআইএফসি নামে দেশীয় একটি  প্রতিষ্ঠানকে খসড়া কয়লানীতি প্রণয়নের দায়িত্বও দেওয়া হয়।

আইআইএফসি খসড়া কয়লানীতি প্রণয়ন করে জমা দিলে অনুমোদনের জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার কাছে উপস্থাপন  করা হয়। তিনি খসড়া অনুমোদন না দিয়ে বুয়েটের অধ্যাপক নুরুল ইসলামকে রিভিউ (সংশোধন-সংযোজন) করার দায়িত্ব দেন।
 
প্রফেসর নুরুল ইসলাম খসড়া কয়লানীতির অনেকগুলো বিষয়ে পরিবর্তনের সুপারিশ করে রিপোর্ট জমা দেন। কিন্তু বিএনপি সরকারের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার ছয় মাসের মাথায় বুয়েটের সাবেক ভিসি প্রফেসর আব্দুল মতিন পাটোয়ারীর নেতৃত্বে রিভিউ কমিটি গঠন করে দেয়। পাটোয়ারী কমিটি খসড়া প্রণয়ন করে জমা দিলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকার শেষ পর্যন্ত সেটিকে চূড়ান্ত করতে ব্যর্থ হয়।
 
আবার ক্ষমতার পালাবদল ঘটে। মহাজোট সরকার মসনদে বসে পাটোয়ারী কমিটির খসড়া কয়লানীতি অনুমোদন না করে তৎকালীন জ্বালানি সচিবকে প্রধান করে আন্তঃমন্ত্রণালয় রিভিউ কমিটি গঠন করে। ওই কমিটি খসড়ার নীতি ও বাস্তবায়ন অংশকে দুই ভাগে ভাগ করে কিছু সংশোধনীসহ শুধু নীতি অংশটি অনুমোদনের সুপারিশসহ ২০১০ সালের অক্টোবর রিপোর্ট জমা দেয়।

আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটির সুপারিশ আমলে না নিয়ে ২০১১ সালের মার্চে আবারও উচ্চ পর্যায়ের রিভিউ কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ওই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে গঠন করা হয় রিভিউ কমিটি। কমিটিকে ৪ মাসের মধ্যেই রির্পোট দেওয়ার জন্য সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছিল।
 
রিভিউ কমিটি নির্ধারিত সময়ে অনেক পরে একটি রিপোর্ট জমা দেয়। সেই রিপোর্ট নিয়ে দীর্ঘদিন চলে লুকোচুরি। কমিটি বলতো আমরা জমা দিয়েছি। কিন্তু মন্ত্রণালয় বলতো আমরা পাইনি। পরে প্রাপ্তি স্বীকার করে ওয়াটার মডেলিং (পানি ব্যবস্থাপনা) বিষয়ে রিপোর্ট চাওয়া হয়েছে একটি সংস্থার কাছে। এভাবে রিভিউয়ের পর রিভিউ। কিন্তু কোনই সুরাহা হয়নি কয়লা নীতির।
 
এ প্রসঙ্গে পেট্রোবাংলার সাবেক পরিচালক ও মাইনিং বিশেষজ্ঞ মকবুল ই-এলাহী চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, নীতির কথা বলে অযুহাত দেখানো হচ্ছে। কাজের জন্য নীতি সমস্যা নয়। বড়পুকুরিয়া থেকে যে নীতিমালায় উন্নয়ন হচ্ছে, সেই নীতিমালায় উন্নয়ন হতে তো কোন সমস্যা নেই।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেন, কয়লা এখন পলিটিক্যাল ফুটবলে পরিণত হয়েছে। কয়লা উত্তোলন এখন টেকনিক্যাল বা ইকোনমিক্যাল ইস্যু নয়, পুরোপুরি রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। এটা এখন পলিটিক্যাল ফুটবল।
 
বাংলাদেশ সময়: ১০৫৬ ঘণ্টা, মে ৫, ২০১৬
এসআই/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।