কিন্তু বিপিসির নতুন চেয়ারম্যান মো. আকরাম আল হোসেন এক তুড়িতে সব আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করে ফেলেছেন। নতুন উদ্যোমে শুরু হয়েছে গণমুখী এই প্রকল্পটির কাজ।
এরকম আরও অনেকগুলো নজির সৃষ্টি হয়েছে বিপিসিতে। যেসব প্রকল্প নানা কারণে এতদিন ঝুলেছিলো সবগুলো গতি ফিরে পেয়েছে। বলা চলে নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়েছে বর্তমান চেয়ারম্যানের হাত ধরে।
অন্যরা যা বছরের পর বছর চেষ্টা করেও সফল হতে পারেনি। কি করে এতো দ্রুত সম্ভব হলো! এমন প্রশ্ন ছিলো বিপিসি চেয়ারম্যানের কাছে। জবাবে বলেন, আমি মনে করি, ব্যুরোক্রেসি দিয়ে সবকিছু সম্ভব হয় না। প্রয়োজন উন্নয়ন মানসিকতার। আমি চিঠি দিয়ে দায় সারতে জানি না। চিঠি দিয়েছি আবার স্বশরীরে গিয়ে কথা বলেছি। প্রয়োজনে ব্যক্তিগত সম্পর্ককে কাজে লাগিয়েছি। এতেই সব জটিলতা দূর হয়ে গেছে।
উন্নয়ন মানসিকতা, ধারণা সম্পর্কে যদি একটু পরিষ্কার করেন! জবাবে বলেন, বাংলাদেশ বর্তমানে উন্নয়নের মহাসড়কে চলছে। প্রধানমন্ত্রী যে ভিশন দিয়েছেন তার জন্য শুধু ব্যুরোক্রেসি মানসিকতার মধ্যে আটকে থাকলে চলবে না। এখন সময় আপনার দক্ষতা দেখানোর।
আকরাম আল হোসেন বলেন, আমি মনে করি প্রত্যেকটি পয়েন্টে উন্নয়ন মানসিকতার লোক দরকার। তাহলেই সম্ভব সোনার বাংলা গড়া। না হলে আমাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বিলম্ব হতে পারে।
উন্নয়নের মহাসড়কের অন্যতম নিয়ামক শক্তি হচ্ছে জ্বালানি। আর সেই জ্বালানি খাতের প্রধান উইংয়ের দায়িত্বভার এখন তার কাঁধে। তার কাছে প্রশ্ন ছিলো, ভিশন-২০২১ ও ২০৪১ উদযাপনে বিপিসি কতটা সক্ষমতা অর্জন করেছে?
বিপিসি চেয়ারম্যান বলেন, জনবল সংকটসহ নানা কারণে পিছিয়ে পড়া বিপিসিকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ২০০৮-২০০৯ অর্থবছরে ৩৩ লাখ ২৬ হাজার মেট্রিক টন জ্বালানি তেল হ্যান্ডেলিং করতো বিপিসি। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এসে চাহিদা দাঁড়িয়েছে ৮৬ লাখ ৩২ হাজার মেট্রিক টনে। বিশাল বাড়ন্ত চাহিদা হলেও সে তুলনায় বিপিসির লোকবল বাড়ানো হয়নি। যে কারণে সংকট তৈরি হতো।
এখন নতুন অর্গানোগ্রাম তৈরি করা হয়েছে। নতুন অর্গানোগ্রামে জনবল ১৭৮ থেকে ৩১৫ উন্নীত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এটা অনুমোদন হয়ে এলে বিপিসির কর্মক্ষমতা অনেকগুণ বাড়বে বলে মনে করেন তিনি।
বিপিসি চেয়ারম্যান বলেন, একটি দেশের জ্বালানির নিরাপদ মজুদ ধরা হয় ৬০ দিন। আমরা এখনও অনেক দূরে রয়েছি। বর্তমানে ৪৫ দিনের মজুদের সক্ষমতা রয়েছে। এটাকে ৬০ দিনে উন্নীত করতে বেশ কিছু প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।
কথা বলার ফাঁকে ফাঁকেই ফাইলে সই করছিলেন, আবার নানা প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলেন। বললেন, আমরা বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্প হাতে নিয়েছি। এগুলো বাস্তবায়ন হলে বদলে যাবে দেশের জ্বালানি খাতের চেহারা।
উত্তরাঞ্চলে তেল সরবরাহের দু’টি মাধ্যম রয়েছে। সহজ মাধ্যমটি হচ্ছে চট্টগ্রাম থেকে নৌপথে দৌলতপুরে নেওয়া। সেখান থেকে রেলের ওয়াগনে করে রংপুর ডিপোতে নিতে হয়। এই পদ্ধতি অনেক ব্যয়বহুল এবং ঝূঁকিপুর্ণ। দৌলতপুর থেকে সড়ক ও রেলপথে রংপুরে তেল নিতে সময় লাগে সাতদিন।
এর বিকল্প হিসেবে ভারত থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে তেল আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এজন্য ভারতের নুমালিগড় থেকে বাংলাদেশের পার্বতীপুর পর্যন্ত ১৩০ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণ করা হবে। এতে বাংলাদেশ অংশে হবে ১২৫ কিলোমিটার ও আর ভারতের অংশে হবে ৫ কিলোমিটার। এই প্রকল্পের মেজর অংশই ভারত অনুদান হিসেবে দিচ্ছে।
এই পাইপলাইনের তেল পরিবহন সক্ষমতা হবে ১০ লাখ মেট্রিক টন। প্রথম তিন বছরে আসবে আড়াই লাখ মেট্রিক টন। আর এই তেল আনতে সময় লাগবে মাত্র কয়েক ঘণ্টা। এতে একদিকে যেমন খরচ কমবে, তেমনি ঝুঁকি ও সময় কমে যাবে। ১৮ সেপ্টেম্বর নির্মাণকাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী। এর ৩০ মাসের মাথায় সচল হবে পাইপলাইনটি।
আরেকটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে ইস্টার্ন রিফাইনারি ইউনিট-২ (ইআরএল-২) প্রকল্প। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে ইআরএল’র জ্বালানি তেল পরিশোধন ক্ষমতা ১৫ লাখ মেট্রিক টন থেকে বেড়ে ৪৫ লাখে উন্নীত হবে।
আমরা যদি পরিশোধিত তেল না এনে ক্রডওয়েল এনে পরিশোধ করি তাহলে দেখা যায় প্রতি লিটার ডিজেলে কমপক্ষে ৫ থেকে ৬ টাকা করে সাশ্রয় হবে। তাহলে সহজেই বুঝতে পারছেন এর প্রয়োজনীয়তা। এই প্রকল্পটির ফ্রন্ট ইন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ডিজাইন (এফইইডি) তৈরি করেছে টেকনিপ ফ্রান্স নামের একটি প্রতিষ্ঠান। ইস্টার্ন রিফাইনারির ইউনিট-২ এর পরামর্শক হিসেবে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্ডিয়া লিমিটেড (ইআইএল) এফইইডি ও স্টিমেটেড কস্ট যাচাই করছে।
বর্তমানে তেলবাহী মাদার ভেসেল গভীর সমুদ্রে নোঙ্গর করে। সেখান থেকে লাইটারেজে করে চট্টগ্রামে ডিপোতে আনা হয়। এতে বাড়তি পয়সা এবং সময় অপচয় হয়। অনেক সময় দেখা যায় বৈরী আবহাওয়ার কারণে মাদার ভেসেল থেকে আনলোডে দেরি হলে জরিমানা গুণতে হয়। এজন্য গভীর সমুদ্র থেকে চট্টগ্রামে তেল আনার জন্য পাইপলাইন নির্মাণ করা হচ্ছে। সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে জ্বালানি তেলের আমদানি ব্যয় কমে যাবে।
বিপিসি চেয়ারম্যান বলেন, আমরা চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় তেল আনার জন্য একটি পাইপলাইন স্থাপনের কাজ শুরু করেছি। ৩০৫ কিলোমিটার এই পাইপলাইনের ভূমি অধিগ্রহণের কাজ চলছে। এটা হবে জ্বালানি খাতের আরেকটি মাইলফলক।
বাংলাদেশে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ যাদের মনে করা হয় তাদের মধ্যে অন্যতম মো. আকরাম আল হোসেন। তার চাকরি জীবনের দীর্ঘ সময় কেটেছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় নিয়ে। ঢাকা ও চট্টগ্রাম ওয়াসার মেগা প্রকল্পগুলোর পেছনে তার ভূমিকা অনন্য। বিপিসিকে তেমনি ভিশনারি প্রকল্পের মাধ্যমে ঢেলে সাজানোর কাজ শুরু করেছেন।
তিনি মনে করেন, দেশের ঝড়ো গতির উন্নতিতে শুধু বিপিসির একার পক্ষে জ্বালানি তেল খাত নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। সে কারণে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসতে হবে। বিপিসি রেগুলেটর বডি হিসেবে তাদের সহায়তা করতে চায়। এখানে কাজের মূল্যায়ন করা হবে।
প্রশ্ন ছিলো বিপিসির তেল চুরির একটি বড় দুর্নাম রয়েছে। জবাবে বলেন, এটা এক সময়ে ছিলো, এখন অতীত। দুর্নীতির ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স। মনিটরিং জোরদার করা হয়েছে, প্রমাণ পেলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৫৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০১৮
এসআই/আরআর