ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১০ অক্টোবর ২০২৪, ০৬ রবিউস সানি ১৪৪৬

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি

দ্বিতীয় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ৫ স্থান চিহ্নিত

শামীম খান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৩৪ ঘণ্টা, মার্চ ২, ২০২২
দ্বিতীয় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ৫ স্থান চিহ্নিত রূপপুরে দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে

ঢাকা: দেশে দ্বিতীয় পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য স্থান নির্বাচনের কাজ অনেক দূর এগিয়েছে। প্রথম পারমাণিক বিদ্যুৎকেন্দ্র রূপপুর প্রকল্প উৎপাদনে যাওয়ার পর ২০২৫ সালে দ্বিতীয় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণ কাজ শুরুর প্রস্তুতি চলছে।

এরই মধ্যে এ প্রকল্পের জন্য বিভিন্ন পর্যায়ে সমীক্ষা চালিয়ে দক্ষিণাঞ্চলে ৫টি স্থান প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুই ইউনিটের পর আগামী ২০৪১ সালের মধ্যে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের আরও চারটি ইউনিট নির্মাণের কার্যক্রম হাতে নিয়েছে সরকার। এর মধ্যে ২০৩০-২০৩১ সালের মধ্যে দুটি ইউনিট এবং ২০৪০-২০৪১ সালে মধ্যে আরও দুইটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ইউনিট নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে দেশের দক্ষিণ-পাশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে সরকার সমীক্ষার কাজ করছে। প্রাথমিকভাবে ১৫টি জেলায় স্থান নির্বাচনের কার্যক্রম চালিয়ে ৮টি স্থান চিহ্নিত করা হয়। এর মধ্য থেকে ৫টি স্থান বাছাই করা হয়েছে বলে জানা গেছে। রাশিয়ার প্রযুক্তি, অর্থায়ন ও সার্বিক তত্ত্বাবধানে নির্মাণাধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ইউনিট রয়েছে দুইটি। দেশটির পারমাণবিক শক্তি করপোরেশন-রোসাটম এই প্রকল্পটি নির্মাণ করছে। যার প্রথম ইউনিট ২০২৩ সালে এবং দ্বিতীয় ইউনিট ২০২৪ সালে উৎপাদনে যাওয়ার কথা রয়েছে। এর পর সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী আরও চারটি ইউনিট নির্মাণ হলে ২০৪১ সালে দেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ইউনিট দাঁড়াবে ৬টিতে।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সংশ্লিষ্ট সুত্রগুলো জানায়, পরমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রযুক্তি বিদ্যুৎ উৎপাদনে একটি পরিবেশবান্ধব, সাশ্রয়ী ও নিরাপদ প্রযুক্তি হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে আন্তর্জাতিকভাবে বিবেচিত হয়ে আসছে। আগামী ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করতে এই সময়ে ৯৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া কার্বণমুক্ত পরিবেশের জন্য বিশ্ব নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপর অত্যাধিক গুরুত্ব দিচ্ছে। এ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রার একটি বড় অংশ এই প্রযুক্তি থেকে অর্জনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে দ্বিতীয় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য দক্ষিণাঞ্চলে সম্ভাব্য স্থান নির্বাচনে সমীক্ষা চালানো হচ্ছে। এ সমীক্ষার বিভিন্ন পর্যায় পার করে এ প্রকল্পের জন্য প্রাথমিকভাবে পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলার ৫টি স্থান চিহ্নিত করা হয়েছে। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য নির্ধারিত সব মানদণ্ডের ওপর ভিত্তি করে এ স্থানগুলোতে চালানো সব ধরনের পরীক্ষা-নিরিক্ষার ফলাফলে বরগুনার তালতলী উপজেলার নিশানবাড়ি (পূর্ব) এক নম্বর অবস্থানে রয়েছে। তবে এই সমীক্ষা কার্যক্রম সম্পর্কে সংশ্লিষ্টরা এখনই প্রকাশ্যে কিছু জানাতে চান না। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের স্থান নির্বাচনের বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকারত। তাই চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত কোনো কিছু নির্দিষ্ট করে বলা যায় না বলে তারা জানান।

বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান বাংলানিউজকে বলেন, গত বছর নভেস্বরে অনুষ্ঠিত জলবায়ু সম্মেলনে (কপ ২৬) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় করণীয় সম্পর্কে বিশ্ব নেতাদের সামনে গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব তুলে ধরেছেন। এতে তিনি বিশ্ব নেতাদের কাছে অত্যন্ত প্রসংশিত হয়েছেন। তিনি কার্বণ নিঃসরণ ব্যাপকভাবে কমিয়ে আনার প্রস্তাব করেছেন। নিশ্চয়ই তিনি তার কথা অনুযায়ী সেভাবে কাজও করবেন। বিদ্যুৎ উৎপাদনে আমরা পরিবেশবান্ধব ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপর গুরুত্ব দিয়েছি। সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে দ্বিতীয় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। রূপপুর প্রকল্পের কাজ সম্পন্নের পর দ্বিতীয়টি নিয়ে কাজ শুরু হবে। প্রাথমিকভাবে কতগুলি জায়গা সার্ভের কাজ চলছে।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ও পরমাণু শক্তি কমিশনের সুত্রগুলো থেকে জানা যায়, এই দ্বিতীয় পারমাণবিক বিদ্যুকেন্দ্র নির্মাণের লক্ষ্যে স্থান নির্বাচনের জন্য গঠিত কারিগরি কমিটি বিভিন্নভাবে সম্ভাব্যতা যাচাই-বাছাইয়ের পর প্রাথমিকভাবে যে ৫টি স্থান চিহ্নিত করেছে সেগুলো হলো- বরগুনার তালতলী উপজেলার বড়বগি ইউনিয়নের নিশানবাড়ি (পূর্ব) ও নিশানবাড়ি (পশ্চিম), সদর উপজেলার কুমিরমারা, পটুয়াখালির রাঙ্গাবালি উপজেলার মৌডুবি, এবং চর মোনতাজ এলাকা। কারিগরি কমিটির সেন্টার ফর ইনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনস্টিটিউশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস) স্ট্যাডি, হাইড্রোলজিক্যাল, সিসমোলজিক্যাল ও টেকনিক্যাল এবং ভূ-তাত্বিক ও ভূ-পদার্থিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর পটুয়াখালি ও বরগুনার এই ৫টি স্থান চিহ্নিত করা হয়েছে। এই স্থানগুলোর মধ্যে সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার মানদণ্ডে নিশানবাড়ি (পূর্ব) স্থানটি এক নম্বরে রয়েছে।

এ সূত্রগুলো থেকে আরও জানা যায়, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের স্থান নির্ণয়ের ক্ষেত্রে স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ যেসব বিষয় রয়েছে সেগুলো হলো- মানুষ ও পরিবেশের নিরাপত্তা, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নিরাপত্তা ও ব্যয়- যা স্থান চিহ্নিতকরণের ওপর নির্ভর করে। মাটির অবস্থা, পরিবেশ, আবহাওয়া, জলবায়ু অর্থাৎ বন্যা, ঘুর্ণিঝড়, সুনামি এই বিষয়গুলোর ইতিহাস পর্যালোচনা করা হয়। এ প্রকল্পের স্থান নির্ধারণের ক্ষেত্রে ‘আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) নির্দেশনা অনুসরণ করা হয়। পাশাপাশি ‘বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (বিএইআরএ), ‘বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদপ্তর (ডিওই) ও দেশীয় অন্যান্য নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানের বিধিনিষেধ শতভাগ মেনে চলতে হয়। সব সংস্থা নির্দেশনা অনুসরণ করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে কারিগরি কমিটি এই স্থানগুলো প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করেছে।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, প্রাধানমন্ত্রীর নির্দেশে ২০১৫ সালে একটি ‘কোর কমিটি’ গঠন করা হয়। পাশাপাশি পরমাণু শক্তি কমিশন এবং জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে দক্ষিণাঞ্চলে প্রাথমিক পর্যায়ে কিছু স্থান চিহ্নিত করতে পৃথক দুইটি কমিটিও গঠন করা হয়। কমিটিগুলো সমীক্ষা চালিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের ৫ জেলায় ৮টি স্থান চিহ্নিত করেছে। এগুলো হলো-পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার পক্ষিয়ার চর, বরগুনার তালতলী উপজেলার খোট্টার চর, একই উপজেলার নিদ্রার চর, পাথরঘাটা উপজেলার টেংরার চর, আমতলী উপজেলার  আলিসার মোড়, খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার  চর হালিয়া, নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার বয়ার চর এবং ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার মহুরীর চর। এরপর কমিটি বরিশাল, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, বাগেরহাট, খুলনা, ভোলা, ফেনী, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, মাদারীপুর ও সাতক্ষীরাসহ ১৫টি জেলায় জমির অনুসন্ধান চালায়। তারা ১০ জেলার চিহ্নিত স্থানগুলোর ওপর সাইট সার্ভে পর্যায়ের সিসমোলজিক্যাল, হাইড্রোজিওলজিক্যাল ও মেটিওরোলজিক্যাল সার্ভেসহ  ভূমির পরিমাণ, ভূমির ধরন ও গঠন, ব্যবহার ও স্থায়িত্ব, জনসংখ্যা, জনবসতি, শিল্প কল-কারখানা, বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থের মজুত, বিষাক্ত গ্যাসের নিঃসরণ, বিস্ফোরক পদার্থের মজুত, সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও সামরিক স্থাপনা, বিমানবন্দরের অবস্থান, যোগাযোগ ব্যবস্থা, পরিবহন ব্যবস্থা, পরিবেশগত বিষয়ে আইনগত বিধি, লোড সেন্টার, বৈদ্যুতিক ট্রান্সমিশন, ডিস্ট্রিবিউশন ও পাওয়ার গ্রিডের অবস্থানের তথ্য সংগ্রহ করে। প্যারামিটারসহ বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, বাতাসের গতি, ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোন, বন্যা ও সারফেস ওয়াটারের গুণগত মান সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর পটুয়াখালী ও বরগুনার এই ৫টি স্থানকে সর্বশেষ পর্যায়ে চিহ্নিত করা হয়। এখান থেকে পরবর্তীতে একটি স্থান চূড়ান্ত করা হবে। যে স্থানে নির্মিত হবে চার ইউনিট বিশিষ্ট দ্বিতীয় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। এখানে ২০২৫ সাল নাগাদ দুই ইউনিটের নির্মাণ কাজ শুরু হতে পারে। আবার এখানে দুই ইউনিট করে রূপপুরে আরও দুই ইউনিট করা হতে পারে। রূপপুরে আরও দুই ইউনিট করার মতো জায়গা এবং প্রস্তুতি রাখা হয়েছে। সেটা হলে দক্ষিণ অঞ্চলের দ্বিতীয় প্রকল্পের স্থানে ২০৪১ সালের পর আরও দুইটি ইউনিট স্থাপন করা যাবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।

বাংলাদেশ সময়: ১০৩৩ ঘণ্টা, ২ মার্চ, ২০২২
এসকে/এমএমজেড

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।