ঢাকা, শনিবার, ২১ আষাঢ় ১৪৩১, ০৬ জুলাই ২০২৪, ২৮ জিলহজ ১৪৪৫

প্রবাসে বাংলাদেশ

বিভেদ ভেঙে ভ্রাতৃত্বের জয়ে বার্লিন প্রাচীরের পতন

জাহিদুর রহমান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩০০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৩, ২০১৬
বিভেদ ভেঙে ভ্রাতৃত্বের জয়ে বার্লিন প্রাচীরের পতন

বার্লিন, জার্মানি থেকে: দিনটি ছিলো ১৯৬১ সালের ১৩ আগস্ট। অনেকটা বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতোই আলাদা হলো একই সম্পর্ক আর বন্ধনের।

জার্মানির শহর- বার্লিনে পূর্ব জার্মানি আর পশ্চিম জার্মানির মাঝে সীমানা প্রাচীর তৈরি করা হলো। আলাদা করে ফেলা হলো দুই জার্মানিকে। যে প্রাচীর পারস্পরিক সম্পর্কের রেখায় তুলে দিল দাড়ি। প্রাচীরের কারণে যে বহু পরিবার বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন পরস্পর থেকে। পশ্চিম বার্লিন পরিণত হলো পূর্ব জার্মানির একটি ছিটমহলে।
 
কিন্তু নদীর স্রোতকে কি এভাবে কাটা যায় কখনও? ভাগ করা যায় জলরাশিকে! যায় না বলেই টেকেওনি সম্পর্কের বন্ধনে তুলে দেওয়া সেই দেয়াল। ২৮ বছর পর ১৯৮৯ সালে ভেঙে ফেলা হয় সেই প্রাচীর। এক হলো দুই জার্মানি।

ফেরা যাক সেই দিনগুলোতে।

উন্নত জীবনের আশায় পূর্ব জার্মানি থেকে আসা শরণার্থীদের স্রোত তখন পশ্চিমে। উদ্দেশ্য, যে করেই হোক সেই স্রোতে বাধা দিতে হবে। ১২ আগস্ট, ১৯৬১। পূর্ব জার্মানির নেতারা ডলসি উদ্যানে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলেন দু’দেশের সীমারেখা টানতে প্রাচীর নির্মাণ করা হবে। যেই কথা সেই কাজ। পরের দিন থেকেই শুরু হলো কাজ। পূর্ব এবং পশ্চিম জার্মানির মাঝে প্রকৃত সীমারেখা বরাবর কাঁটাতারের বেড়, কোথাও দেয়াল, কোথাওবা মাইনক্ষেত্র , কোথাও আবার অন্যান্য স্থাপনা দিয়ে আলাদা করে দেওয়া হলো।

মানুষে মানুষে সম্পর্কে দাঁড়িয়ে গেলো আরেকটি উঁচু প্রাচীর। যদিও এই প্রাচীরের নেপথ্যে ছিলো কিছু ভূ-রাজনৈতিক কারণও।

পশ্চিম বার্লিনের চারপাশে ১৫৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এ দেয়ালের ৪৩ কিলোমিটার সরাসরি দু’অংশকে পৃথক করে ফেলে। প্রাচীরের নির্মাণের কাজের সময় কেউ কেউ পশ্চিমাংশে চলে যেতে পারে; এই আশঙ্কায় পূর্ব জার্মানির সেনাবাহিনী এবং আধাসামরিক বাহিনী দেয়ালের সামনে সশস্ত্র অবস্থান নেয়। পশ্চিম বার্লিনের কোনো অংশ যেন পূর্বাংশের মধ্যে চলে না আসে, সেজন্য পূর্ব বার্লিনের খানিকটা ভেতরেই এই প্রাচীর তৈরি করা হয়।

জার্মান নাগরিক গ্রাব্রিয়েল ফ্রাংক যেমনটি বলছিলেন বাংলানিউজকে। তিনি জানান, সীমানা প্রাচীরটি ঘিরে পূর্ব জার্মানির ১০০ গজ ভেতরে থাকা বাড়িঘর এবং স্থাপনা ধ্বংস করে একটি ‘নোম্যান্সল্যান্ড’ তৈরি করা হয়। সেসব অধিবাসী হন বাস্তচ্যুত। তাদের সরিয়ে নেওয়া হয় অন্যত্র। এই ‘নো ম্যান্স ল্যান্ড’ সবার কাছে পরিচিত ছিল সাক্ষা‍ৎ ‘মৃত্যুফাঁদ’ হিসেবে। তবে পূর্ব এবং পশ্চিম বার্লিনের মাঝে যাতায়াতের জন্য ৮টি ‘আনুষ্ঠানিক পথ’ অবশ্য রাখা হয়।

তা সত্ত্বেও পূর্ব জার্মানির মানুষ পালিয়ে আসতো পশ্চিম জার্মানিতে। ১৫ আগস্ট ১৯৬১ প্রাচীর নির্মাণে তদারকিতে নিয়োজিত কনার্ড শুম্যান নামে পূর্ব জার্মানির এক প্রহরী কাঁটাতারের বেড়ার ওপর দিয়ে লাফিয়ে পশ্চিম বার্লিনে চলে আসেন। পরবর্তীতে মাটির নিচে টানেল খুঁড়ে যাবার-ও ইতিহাস রয়েছে অনেক।

১৯৬২ সালের ১৭ আগস্ট। প্রাচীর অতিক্রম করতে গিয়ে পিটার ফ্লেচার নামে ১৮ বছরের টগবগে এক তরুণ গুলিবিদ্ধ হয়ে দীর্ঘ সময় পড়েছিলেন পশ্চিমাংশে। সেখানকার  মিডিয়াকর্মীদের উপস্থিতিতেই রক্তক্ষরণের কারণে ধীরে ধীরে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি।

আর এই প্রাচীর সর্বশেষ জীবন কেড়ে নেয় ১৯৮৯ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি। এভাবে ঝরে পড়ে ১৩৩টি তরতাজা প্রাণ। যদিও বেসরকারি হিসাবে সংখ্যাটি দুইশ’ বলে ধারণা করা হয়।

এভাবেই কেটে যায় দীর্ঘ ২৮টি বছর। বাড়তে থাকে রক্ত আর সম্পর্কের বিভাজনের দেয়াল ঘিরে মানসিক অস্থিরতা।

১৯৮৯ সালে ১৮ অক্টোবর। পদত্যাগ করলেন পূর্ব জার্মানির শাসক এরিক হোনেকার। তার স্থলাভিষিক্ত হলেন এগোন ক্রেনজ।

সেপ্টেম্বর মাসে শুরু হলো বিক্ষোভ। প্রথমে স্লোগান ছিল, আমরা বাইরে (পশ্চিম জার্মানি) যেতে চাই। পরে স্লোগান পাল্টে হলো - ‘আমরা এখানেই থাকবো’।

শুরু হলো দুই জার্মানির ঐক্যের পক্ষে আন্দোলন। ৪ নভেম্বর পূর্ব বার্লিনের আলেকজান্দারপ্লাত্জ এ সমবেত হলেন ১০ লাখ বিক্ষোভকারী।

ক্রেনজ সরকারের সহনশীল নীতি এবং কমিউনিস্ট চেকোস্লাভ সরকারের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী পূর্ব জার্মানির শরণার্থীরা চেকোস্লাভাকিয়া হয়ে পশ্চিম জার্মানি যাওয়ার সুযোগ পায়। ক্রমবর্ধমান শরণার্থীর চাপ ঠেকাতে ১৯৮৯ সালের ৯ নভেম্বর ক্রেনজের নেতৃত্বে পার্টির পলিটব্যুরো সিদ্ধান্ত নেয়, পূর্ব এবং পশ্চিম জার্মানির মধ্যে সীমান্ত চৌকি দিয়ে সরাসরি শরণার্থীদের যাবার অনুমতি দেওয়া হবে।

পূর্ব জার্মানির সীমান্তরক্ষীদের সিদ্ধান্তটি জানানোর জন্য ১ দিন সময় নিয়ে ১০ নভেম্বর থেকে এটি কার্যকর করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পূর্ব জার্মানির প্রচারমন্ত্রী গুন্টার সাবোয়স্কিকে আনুষ্ঠানিক ঘোষণাটির দায়িত্ব দেওয়া হয়। ৯ নভেম্বরের আগে থেকে সাবোয়স্কি ছুটিতে থাকায় এ সিদ্ধান্ত সম্পর্কে তিনি জানতেন না।

একই দিনে একটি সংবাদ সম্মেলনের আগ মুহূর্তে তাকে ঘোষণাপত্রটি ধরিয়ে দেওয়া হয়। তবে কবে এটি কার্যকর করা হবে, সে বিষয়ে ছিলও না কোনো দিক-নির্দেশনা। সাংবাদিকরা তাকে প্রশ্ন করেন, কবে থেকে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে? তিনি বলেন, ‘যতদূর জানি, এই মুহূর্ত থেকেই কার্যকর হবে। ’

তার এই উত্তরের অপেক্ষায়ই ছিল যেন দুই জার্মানির মানুষ। মুহূর্তের মধ্যে হাজার হাজার পূর্ব জার্মানিবাসী প্রাচীরের কাছে সমবেত হয়ে পশ্চিম জার্মানিতে যেতে দেওয়ার দাবি জানাতে থাকে। এ অবস্থায় গণদাবির মুখে সীমান্তরক্ষীরা দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়। অপর পাশে হাজার হাজার পশ্চিম জার্মানিবাসী উৎসবমুখর পরিবেশে তাদের স্বাগত জানায় ।

এভাবেই অনানুষ্ঠানিকভাবে পতন হয় এ প্রাচীরের। আর ২৩ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয় দুই জার্মানির মধ্যে ভিসামুক্ত চলাচল। ভেঙে ফেলা হয় বার্লিন প্রাচীর। আবার এক হয়ে যায় দুই জার্মানি।

যে প্রাচীর দেখতে দূর দূরান্ত থেকে বহু মানুষ এখানো ছুটে আসেন এখানে।

বাংলাদেশ সময়: ০২৫২ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৩, ২০১৬
এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।