ঢাকা, বুধবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

রাশিয়া

যারা হাল ধরবেন রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০০৪ ঘণ্টা, মে ৩১, ২০১৬
যারা হাল ধরবেন রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

মস্কো (রাশিয়া) থেকে: একদিকে রূপপুরে প্রস্তুত হচ্ছে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র, অন্যদিকে একই সঙ্গে কিছু তরুণকে প্রশিক্ষিত করে তোলা হচ্ছে রাশিয়ায়। তারাই দেশে ফিরে পরিচালনার দায়িত্ব বুঝে নেবেন বিদ্যুৎকেন্দ্রটির।

কেমন আছেন তারা, কিভাবে প্রস্তুত হচ্ছেন, আর কতোটুকু প্রস্তুত হচ্ছেন? যাদের চোখ দিয়ে পরমাণু বিদ্যুতের জগতে প্রবেশের স্বপ্ন দেখছে বাংলাদেশ। তাদের মুখ থেকে জানতে চেষ্টা করেছে বাংলানিউজ।

সবার চোখে-মুখেই দৃঢ় প্রত্যয়। কেউতো আবার বলেই ফেললেন, ‘আমরা যেভাবে শিখছি, তাতে এ দায়িত্ব নেওয়াটা বড় কিছু না। কারণ এখানে শিক্ষা পদ্ধতি খুবই কঠিন। পাস নম্বর ৬০ শতাংশ। একেকটি ক্লাস ৫ ঘণ্টা পর্যন্ত স্থায়ী হয়। দশ ঘণ্টা (সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা) বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে হয়। বিরতি পাওয়া যায় সর্বোচ্চ ঘণ্টাখানেক।

বাংলাদেশের প্রাইভেট ইউনির্ভাসিটি থেকে পড়াশোনা করে আসা সাজ্জাদ দেওয়ান দেশের সঙ্গে তুলনা করে বলেন, ‘দেশেও সকাল-সন্ধ্যা বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান করতে হয়। কিন্তু দীর্ঘ সময় ক্লাস না থাকায় আড্ডা দিয়ে সময় কাটে শিক্ষার্থীদের। কিন্তু এখানে পুরোপুরি ভিন্ন। এখানে সারাদিন ক্লাসে থাকতে হয়। আর শিক্ষকরাও খুবই আন্তরিক শেখানোর জন্য’।

নওগাঁ সদর উপজেলার দুবলগাছির ছেলে সাজ্জাদ দেওয়ান বাংলাদেশের ইউনির্ভাসিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকে ট্রিপল-ই বিভাগ থেকে বিএসসি পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স কোসে ভর্তি হয়েছিলেন। সেখান থেকে ২০১৫ সালে স্কলারশিপ নিয়ে মাস্টার্স সমমানের তিন বছর মেয়াদী কোর্স করতে মস্কোতে এসেছেন।

এ ব্যাচের ১২ জন শিক্ষার্থী মস্কো ন্যাশনাল রিসার্চ নিউক্লিয়ার ইউনির্ভাসিটিতে পড়ছেন। নিউক্লিয়ার অ্যানার্জির বিষয়ে রাশিয়ানদের কাছে অভিজাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে খ্যাতি রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টির।

সাজ্জাদ দেওয়ান বলেন, ‘রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র বাংলাদেশের জন্য সৌভাগ্যের দুয়ার উন্মোচন করবে। এটা নিয়ে কোনো বিতর্ক থাকা উচিত নয়। এটা ছাড়া আমাদের কোনো বিকল্পও নেই’।

‘বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে হলে আমাদের অনেক বিদ্যুতের প্রয়োজন। যা কয়লা কিংবা অন্যান্য সোর্স থেকে করা সম্ভব নয়। কয়লা পরিবেশকে দূষিত করে। কিন্তু পরমাণু হচ্ছে পুরোপুরি পরিবেশবান্ধব’।

সাজ্জাদ দেওয়ানের গ্রুপটিকে অংক, পদার্থ বিজ্ঞান, ইনফরমেশন ও রাশিয়ান ভাষা বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। এরপর দেড় বছর থাকবে থিউরিটিক্যাল ক্লাস। শেষ ছয় মাস থাকবে থিসিস ও ইন্টার্নশিপ।

রাশিয়ান ভাষা শিক্ষা দেওয়ার কারণ কি? জবাবে সাজ্জাদ বলেন, যেন দেশে ফিরে রাশিয়ান বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে থেকে কাজ করতে পারেন। ভাষাগত কোনো সমস্যা না হয়।

সালমা আক্তার সুমির কাছে প্রশ্ন ছিল, ‘আপনারা দেশে ফিরে গিয়ে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য কতোটুকু প্রস্তুত হচ্ছেন? আর বিশাল এ দায়িত্ব নেওয়াকে কিভাবে দেখছেন?’

জবাবে সালমা বলেন, ‘অনেক বড় একটা দায়িত্ব নিতে যাচ্ছি। তবে যেভাবে শিখছি, তাতে এ দায়িত্ব নেওয়াটা বড় কিছু না। কারণ, এখানকার শিক্ষা পদ্ধতি খুবই কঠিন। পাস নম্বর ৬০ শতাংশ। আর পরীক্ষা পদ্ধতিও খুবই কঠিন। এখানে ভালোভাবে না শিখলে কারো পক্ষে পাস করা সম্ভব না’।

রূপপুপ পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে জনমনে নানা রকম শঙ্কা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি শঙ্কার কোনো কারণ দেখছি না। বাংলাদেশে উন্নত প্রযুক্তিকেন্দ্র স্থাপন করা হবে। এতে পরিবেশের ক্ষতির সম্ভাবনা জিরো পারসেন্ট’।

বাংলাদেশ সরকার ২০৩০ সালে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে চায়, তা শুধু কয়লার ওপর নির্ভর করে সম্ভব নয় বলেও মন্তব্য করেন সালমা আক্তার।

খুলনার তেরখাদার মেধাবী সন্তান মমিনুল ইসলাম ঢাবির ফলিত পদার্থ বিজ্ঞান ইলেক্ট্রনিক অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগ থেকে অর্নাস শেষ করে মস্কোতে এসেছেন।

তিনি বলেন, ‘রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রে বাড়তি অনেকগুলো বিষয় যুক্ত করা হয়েছে। এখানে কোরক্যাচার থাকছে। যদি কোনো কারণে বিষ্ফোরণ হয়, তাহলে তেজস্ক্রিয়তা মাটির সঙ্গে মিশতে পারবে না’।

বিদ্যুৎকেন্দ্রটিকে ঠাণ্ডা রাখতে পানি যেন কম লাগে, সেজন্য বাতাসের মাধ্যমে ঠাণ্ডা করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে বলেও জানান মমিনুল ইসলাম।

তারা পথপ্রদর্শক হওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন বলেও দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন তিনি।

এতো বিষয় থাকতে পরমাণু বিষয়ে পড়তে আসার কারণ সম্পর্কে মমিনুল জানান, নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় হিরোশিমা-নাগাসাকির ভয়াবহতা নিয়ে পড়তে পড়তে এ বিষয়ে জানার আগ্রহ তৈরি হয়। এরপর অনেক বিতর্ক প্রতিযোগিতায় ‘বিজ্ঞান আশীর্বাদ না-কি অভিশাপ’ বিষয়ে বিতর্ক অংশ নেন। তারই ধারাবাহিকতায় ঢাবিতে পদার্থবিদ্যা বিভাগে ভর্তি হন। এখন তার স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিতে যাচ্ছে বলেও জানান তিনি।

তিনি বলেন, ফুকুশিমায় বিষ্ফোরণের পর প্রটেক্টর গলে গিয়ে মাটিতে মিশে যায়। যে কারণে ক্ষতির পরিমাণ বেড়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের রূপপুরে কোরক্যাপ থাকায় বিষ্ফোরণ হলেও মাটিতে মিশে যাওয়ার কোনো সুযোগ থাকছে না।

নয়জনের আরেকটি গ্রুপ মস্কো ন্যাশনাল রিসার্চ নিউক্লিয়ার ইউনির্ভাসিটিতে সাড়ে ছয় বছর মেয়াদী স্পেশালিস্ট কোর্স করছেন পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, নকশা রক্ষণবেক্ষণ ও প্রকৌশল বিভাগে। এ গ্রুপে ঢাবির ৬ জন, ক্যাডেট কলেজের ২ জন এবং বেসরকারি ইউনির্ভাসিটির ১ জন শিক্ষার্থী রয়েছেন।

স্পেশালিস্ট কোর্সের শিক্ষার্থী হামিদুল হক বাংলানিউজকে বলেন, ‘জাতি হিসেবে নিজেদেরকে অন্যরকম মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করতে দক্ষ ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন প্রয়োজন। আমাদের যে জনশক্তি রয়েছে উপযুক্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে গড়ে তোলার মাধ্যমে সক্ষমতা অর্জন করতে পারবো’।

হামিদুল হক বলেন, ‘মস্কোতে প্রাকটিক্যাল কাজের সুযোগ অনেক বেশি। এখানকার শিক্ষাপ্রযুক্তি নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। যে হারে শিক্ষা গ্রহণের জন্য শিক্ষার্থীদের পাঠানো হচ্ছে, সে হারে পাঠানো অব্যহত থাকলে মনে হয় কোনো সংকট তৈরি হবে না। আমরা নিজেরাই রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের হাল ধরতে পারবো’।

রূপপুরে বিভিন্ন বিভাগে ৮শ’ লোকের প্রয়োজন। কিন্তু চুক্তির আওতায় ১ হাজার ২শ’ জনকে প্রশিক্ষিত করে তুলবে রাশিয়া বলেও জানান হামিদুল হক।

রাশিয়ান ন্যাশনাল রিসার্চ নিউক্লিয়ার ইউনির্ভাসিটির প্রো-ভিসি আলেক ভ্লাদিমির নাগারনভ’র কাছে বাংলাদেশি ছাত্রদের সম্পর্কে মূল্যায়ন জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘তারা অনেক ভালো করছে, অনেক সিনসিয়ার’।

বাংলাদেশ সময়: ২০০০ ঘণ্টা, মে ৩১, ২০১৬
এসআই/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

রাশিয়া এর সর্বশেষ