ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

কৃষি

খাদ্যে উদ্বৃত্ত জেলা মেহেরপুরে কমেছে ধানের চাষ

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০৩৫ ঘণ্টা, মে ৮, ২০১৬
খাদ্যে উদ্বৃত্ত জেলা মেহেরপুরে কমেছে ধানের চাষ ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

মেহেরপুর: খাদ্য উদ্বৃত্ত মেহেরপুরে জেলায় এ বছর ধান চাষের লক্ষমাত্রা অর্জিত হয়নি। উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পেলেও ধানের দাম কম পাওয়ায় জেলার কৃষকরা ঝুঁকছেন সবজিসহ হাইব্রিড জাতীয় অন্যান্য ফসল চাষের দিকে।

 

কৃষকরা জানিয়েছেন, কঠোর পরিশ্রম করে গায়ের ঘাম ঝরিয়ে ধান উৎপাদন করলেও লাভ করছে মধ্যস্বত্বভোগী ফড়িয়ারা। জমি প্রস্তুত, চাষ, সেচ, কীটনাশক ও শ্রমিক খরচ বৃদ্ধি পেলেও সেই তুলনায় ধানের দাম পাচ্ছে না কৃষকরা । তাই শুধুমাত্র নিজের খাওয়ার জন্য সামান্য ধান চাষ করছেন জেলার কৃষকরা।

ধান চাষ কমিয়ে এখন তারা ঝুঁকছেন সবজি, গম, ভুট্টা ও মসুর ডাল চাষে। বাণিজ্যিকভাবে চাষ করছেন সবজি।

 

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিস জানিয়েছে, মেহেরপুর জেলায় এ বছর ২২ হাজার ৮৪০ হেক্টর জমিতে ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও ধান চাষ হয়েছে ১৭ হাজার ১৫০ হেক্টর জমিতে। এ বছর অবহাওয়া ভালো থাকায় জেলায় ৭৫ হাজার ৬৬৮ মেট্রিক টন ধান উৎপাদন হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

গত বছরও জেলায় প্রায় ২৪ হাজার ২৩০ হেক্টর জমিতে ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও শেষ অবধি চাষ হয়েছিল ২১ হাজার ৯৭০ হেক্টর জমিতে। গত বছর ধান উৎপাদন হয়েছিলো ৯৯ হাজার ১০৮ মেট্রিক টন।

মেহেরপুর সদর উপজেলার পিরোজপুর গ্রামের কৃষক আনোয়ার আলী বলেন, প্রতি বছর ২০ থেকে ২২ বিঘা জমিতে ধানের চাষ করতাম। গত কয়েক বছর বীজ, কীটনাশক, সেচসহ অন্যান্য খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। অথচ ধানের দাম কম পাওয়ায় উৎপাদন খরচ ওঠেনি। উৎপাদন খরচ না ওঠায় ধান চাষ কমিয়ে দিয়েছি। এখন, ওই সব জমিতে গম, মসুর, ভুট্টাসহ অন্যান্য খাদ্য শস্যের চাষ করছি। এসব ফসলে সেচ ও কীটনাশক, সার কম লাগে। আবার দামও ভালো পাওয়া যায়।

সদর উপজেলার বুড়িপোতা গ্রামের ধানচাষী ফরজ আলী বলেন, এক বিঘা জমিতে লাঙল ও মই দিতে ১৩শ‘ টাকা, ৪ কেজি বীজ ক্রয় করতে ১৭০ টাকা, সেচ খরচ বাবদ আড়াই হাজার থেকে ৩ হাজার টাকা, ইউরিয়া সার বাবদ ৮০০ টাকা, বালাই নাশক বাবদ ৩০০ টাকা, আগাছা নাশক (নিড়ানি খরচ) বাবদ ১৫শ‘ টাকা ও শ্রমিক খরচ বাবদ আড়াই হাজার টাকা খরচ হয়ে থাকে। বিঘা প্রতি প্রায় ২৫ থেকে ৩০ মন ধান হয়ে থাকে। বর্তমানে যে বাজার দর তাতে উৎপাদন খরচই ওঠে না।

গাংনী উপজেলার জোড়পুকুরিয়া গ্রামের কৃষক ফজলুল হক ও কাষ্টদহ গ্রামের সিরাজুল ইসলাম জানান, আমাদের এলাকার চোখতোলার মাঠটি এই অঞ্চলের মধ্যে বৃহত্তম মাঠ। এ মাঠে যুগ যুগ ধরে ধান চাষ হয়ে আসছে। এলাকায় ধান চাষকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিলো প্রায় ২০/২৫ টি ধানের চাতাল (ছোট রাইস মিল)। কিন্তু বর্তমানে ধান চাষ না হওয়ার কারণে ইতোমধ্যে অনেকগুলো চাতাল বন্ধ হয়ে গেছে।

জুগিরগোফা গ্রামের চাতাল মালিক খলিলুর রহমান জানান, আগে এ অঞ্চলে যে পরিমাণ ধান চাষ হতো এখন আর তা হচ্ছে না। তাই ধান না পেলে তো চাতাল মিল চালানো সম্ভব হয় না। শ্রমিকদের মজুরি দিতে পারি না। তাই চাতাল মিল বন্ধ করে দিয়েছি। আমার মত অনেকেই একই কারণে চাতাল মিল বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে।

ভরাট গ্রামের কৃষক জামিরুল ইসলাম ও নিয়ামত আলী জানান, এখানকার কৃষক ও বর্গাচাষিরা উৎপাদিত ধানের দাম পাবে কি করে ? ধান ঘরে উঠার আগেই ফড়িয়াদের কাছে ধান বিক্রি করে ফেলছেন তারা। আগেই টাকা পয়সা দিয়ে ফঁড়িয়ারা অল্প দামে কৃষকদের কাছ থেকে ধান কিনে নিচ্ছে।

তেরাইল গ্রামের হবিবর রহমান এ বছর ৫ বিঘা, আযাদুর রহমান ২ বিঘা, জিন্নাত মুন্সী ১২ বিঘা, ছের আলী হাজী ১০ বিঘা ও জামাল হোসেন ৭ বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছিলেন।

এ সব কৃষকরা জানান, ধানের দাম ভালো না। তাই যেভাবে লাভের আশা করেছিলাম সেভাবে হবে না।

তারা জানান, বিঘা প্রতি ধান চাষ করতে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। কিন্তু ধানের দাম ভালো না হওয়ায় এখন লাভ তো দূরের কথা আসলটাই ফেরাতে কষ্ট হয়ে যাবে। ধানের দাম সরকার ৮ থেকে সাড়ে ৮ শ টাকা নির্ধারণ করলে চাষিরা আবারো ধান চাষের দিকে ফিরে আসবে বলে উল্লেখ করেন তারা।
 
একই উপজেলার সাহারবাটি গ্রামের কৃষক মহসিন আলী, আব্দুল গফুর, সাহারুল ইসলাম জানান, এখানকার মাঠে উৎপাদিত ধান জেলার চাহিদা মিটিয়ে জেলার বাইরে বিভিন্ন স্থানে যেত। সেখানে আর ধান চাষ হয় না। এখন এলাকার কৃষকরা বিভিন্ন সবজির চাষ করছেন।

কৃষক আজাদুল ইসলাম জানান, ধান চাষে প্রতিবারই লোকসান গুনতে হয়। কিন্তু সবজি চাষে লোকসান হয় না। তাই লাভের মুখ দেখতেই সবজি চাষের দিকে ঝুঁকছেন এলাকার কৃষকরা।

বাওট গ্রামের ফঁড়িয়া ব্যবসায়ী শুকুর আলী, তুফান আলী জানান, ‘এখন হাইব্রিড ধান কিনছি (ক্রয় ) সাড়ে ৪শ’ টাকা মণ, ২৮ জাতের ধান কিনছি সাড়ে ৫শ’ থেকে ৫শ’৮০ টাকা পর্যন্ত। কৃষকরা মাঠে ধান থাকা অবস্থায় আমাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে থাকেন। আমরা তো লাভের জন্যই ব্যবসা করে থাকি।

জেলা কৃষি সম্প্র্রসারণ অফিসের উপ পরিচালক এসএম মোস্তাফিজুর রহমান বাংলানিউজকে জানান, উৎপাদন খরচ বেশি। সেই তুলনায় কৃষকরা ধানের মূল্য পাচ্ছে না। এছাড়া জেলার মাটি উর্বর হওয়ায় সকল ফসলেরই ভালো ফলন হয়। তাই শুধু ধান নয়, কৃষকরা হাইব্রিড জাতীয় বিভিন্ন ফসলের চাষ করে থাকেন।

বাংলাদেশ সময়: ০০৩৩ ঘণ্টা, মে ০৮, ২০১৬
আরআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।