ঢাকা: আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার সারাদেশে বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। এখন মৌসুম বোরো ধান ঘরে তোলার।
দেশজুড়ে ফলন ভালো হলেও শ্রমিকের পারিশ্রমিক বেশি ও মণ প্রতি ধানের দাম কম হওয়ায় হতাশ কৃষক। এদিকে, এবার বৈশাখের শুরু থেকেই হালকা, মাঝারি ও ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। বেশিরভাগ এলাকার ধান বৃষ্টি শুরুর আগেই গোলায় উঠলেও কিছু স্থানে এখনো বাকি রয়েছে।
ধান কাটা ও ঘরে তোলার মৌসুমের শুরু ও শেষের দিকে অতিবৃষ্টি ও শিলাবৃষ্টিতে বেশ কিছু এলাকার কৃষক বেকায়দায় পড়েছে। কিছু কিছু এলাকায় অতিবৃষ্টিতে ধান গাছ নুয়ে পড়েছে; আবার কোথাও ভেসে গেছে, শিলার আঘাতে ঝরে গেছে ধান। তিন থেকে চারদিন ক্ষেতে পানি জমে থাকায় কাঁচা ধান গাছের গোড়া পচে নষ্ট হয়ে গেছে। ভারী বৃষ্টিতে মাটির সঙ্গে মিশে গেছে পাকা ধান।
বৃষ্টি শুরুর আগেই যাদের ধান কাটা শেষ হয়েছে তাদের অনেকেই ধান শুকাতে পারেনি। ফলে গন্ধ হয়ে গেছে ধানে। বৃষ্টি ভেজা ধান ও গাছে আক্রমণ করেছে ছত্রাক।
শুকাতে না পারায় কিছু ভেজা ধান থেকে অঙ্কুর (অঙ্কুরোদগম) বেরিয়েছে। ফলে ওই ধান গবাদি পশুকে খাওয়ানো ছাড়া আর কোনো কাজে আসছে না কৃষকের।
এদিকে, বৃষ্টির কারণে ধান ভিজে গেলে সেই ধান আর গোলায় রাখা যায় না। সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধ করে চাল করতে হয়। এমন ধানের চালের রংও কিছুটা লালচে হয়। নষ্ট হয়ে যায় স্বাদও।
বাংলানিউজের দিনাজপুরের স্টাফ করেসপন্ডেন্ট মাহিদুল ইসলাম রিপন জানান, গেল কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে দিনাজপুর সদর, কাহারোল, বিরল, চিরিরবন্দর, পার্বতীপুর ও ফুলবাড়ি উপজেলার অধিকাংশ ধানের জমি তলিয়ে গেছে। জমির পানি এখনো শুকায়নি। তাছাড়া রয়েছে শ্রমিক সংকট। সব মিলিয়ে ধান ঘরে তুলতে পারছে না চাষিরা। এরই মধ্যে দেশের অন্যান্য জেলার ধান কাটা প্রায় শেষ হলেও উল্লেখিত সমস্যার কারণে দিনাজপুরে চার ভাগের তিন ভাগ জমির ধান এখনো কাটা সম্ভব হয়নি।
স্থানীয় কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে তিনি আরো জানান, পানিতে তলিয়ে থাকা ধান থেকে বীজ করা কঠিন। ফলে বীজ সংরক্ষণও হুমকির মুখে পড়েছে।
গাইবান্ধা থেকে জাহিদুল ইসলাম জাহিদ জানান, বৃষ্টিতে গাইবান্ধার ফুলছড়ি পয়েন্টে যমুনা নদীর পানি বেড়ে তলিয়ে গেছে বালাসি ঘাট এলাকার প্রায় ২২ হেক্টর জমির বোরো ধান। ডুবে যাওয়া কাঁচা ধান কাটতে বাধ্য হয়েছে স্থানীয় অনেক কৃষক। আবার সময়মতো দিনমজুর না পাওয়ায় অনেকে তলিয়ে যাওয়া ধান কাটতেও পারেনি। ক্ষেত মজুরের খরচসহ অন্যান্য খরচ মিটিয়ে লোকসান গুণতে হতো বলে অনেকে কাঁচা ও আধাপাকা ধান কাটেনি। মাঠেই পচে গেছে সেই ধান।
কৃষকরা জানান, অনেকেই তলিয়ে যাওয়া ধান কেটে গরুকে খাইয়েছে।
ফুলছড়ি উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা তাহাজুল ইসলাম বাংলানিউজকে জানান, ফুলছড়ি উপজেলায় ৭০টি চর রয়েছে। যার পরিমাণ ১৪ হাজার ৭৭০ হেক্টর। যমুনা-ব্রহ্মপুত্র বেষ্টিত হওয়ায় বোরো ধানের চাষ করার উপযোগী প্রায় ৩৮০ হেক্টর জমি।
এসব জমিতে শুকনো মৌসুমে পানি শুকানোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে বোরো ধান লাগায় কৃষকরা। কিন্তু এসব জমির ফসলের কোনো নিশ্চয়তা নেই। আগাম বন্যা বা অতিবৃষ্টিতে যে কোনো মুহূর্তে এসব জমির ফসল তলিয়ে যেতে পারে। এবার হঠাৎ পানি বেড়ে অনেকের ধান তলিয়ে গেছে বলে আমি শুনেছি। তবে এর পরিমাণ সঠিকভাবে জানা যায়নি।
জয়পুরহাট ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট শহিদুল ইসলাম সবুজ জানান, কয়েকদিনের ঝড়-বৃষ্টির পানি জমে যায় জয়পুরহাটের বিভিন্ন এলাকার পাকা ও আধাপাকা ধানক্ষেতে। সেই সঙ্গে হেক্টরের পর হেক্টর জমির ধান হেলে পড়ে। কাদা বা পানি জমে থাকা ক্ষেত থেকে ধান কাটতে চাচ্ছে না বেশিরভাগ শ্রমিক। কেউ রাজি হলেও পারিশ্রমিক বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে বেকায়দায় পড়েছে কৃষক। এমন জমি থেকে ধান কাটতে শ্রমিকদেরও কম ঝক্কি পোহাতে হয় না।
উত্তরাঞ্চলের নীলফামারী থেকে ধান কাটতে আসা আবদুস ছাত্তার, মানিক হোসেন, আলতাফ, আবদুল জব্বার, দুলু মিয়াসহ অনেক দিনমজুর জানান, ধান গাছ ভিজে যাওয়ায় সেগুলো কাটতে ও বহন করতে খুব সমস্যা হচ্ছে। আগে যেখানে শুকনো ধান এক সঙ্গে ২০ গণ্ডা বহন করা সম্ভব হতো, সেখানে ভেজা ধান নেওয়া সম্ভব ১২/১৩ গণ্ডা। এতে সময় ও শারীরিক পরিশ্রম দুই-ই বেড়ে গেছে। তাই শ্রমের দামও বেড়েছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এ বছর জয়পুরহাটের পাঁচটি উপজেলায় ৭২ হাজার ৩১৩ হেক্টর জমিতে ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। যেখানে চাষ হয়েছে ৭২ হাজার ৩১০ হেক্টর জমিতে। এসব জমিতে চাষ করা হয় মিনিকেট, জিরা শাইল, আটাশ, ষোল ও হাইব্রিড মোটাসহ বিভিন্ন ধরনের ধান।
জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলার তিলাবদুল মধ্যপাড়ার কৃষক তোফাজ্জল হোসেন, সদরের আওলাদ হোসেন, আক্কেলপুরের শামীম মণ্ডল, পাঁচবিবির উজ্জ্বল ও কালাইয়ের সোহেল রানা বাংলানিউজকে বলেন, বৃষ্টির আগে প্রতি বিঘা ধান কাটতে দিন মজুররা নিতো দুই হাজার টাকা। বৃষ্টির কারণে তা বেড়ে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা হয়েছে।
জয়পুরহাট জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, আবহাওয়া খারাপ থাকায় কৃষকরা মাঠ থেকে ধান তুলতে দেরি করছে। তবে আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনুযায়ী মঙ্গলবার (১৭ মে) থেকে আকাশ অনেকটাই স্বাভাবিক হচ্ছে। এখন দ্রুত মাঠের বাকি ধান ঘরে তুলতে কৃষক কোমর বেঁধে নামবে।
নওগাঁ ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট শফিক ছোটন জানান, নওগাঁ জেলার ১১টি উপজেলায় এবার বোরো মৌসুমে প্রায় এক লাখ ৯০ হাজার হেক্টর জমিতে ধান চাষ করা হয়। বৈশাখেই পাকা ধান ঘরে তুলেছে চাষিরা।
তবে ধান ঘরে তুললেও প্রখর রোদ, ভ্যাপসা গরম আর মাঝে মধ্যে ঝড়-বৃষ্টির কারণে ধান সিদ্ধ করে শুকানো ও খড় শুকিয়ে সংরক্ষণ করতে কষ্ট হচ্ছে কৃষকের।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা সত্যব্রত সাহা জানান, ২৫ বৈশাখের মধ্যেই জেলার বোরো ফসল শত ভাগ কাটা ও মাড়াই শেষ হয়েছে।
ময়মনসিংহের স্টাফ করেসপন্ডেন্ট আবদুল্লাহ আল মামুন খান জানান, তার জেলার নান্দাইল, গফরগাঁও, ঈশ্বরগঞ্জ ও সদর উপজেলার ৩০ ভাগ ধান বৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
কিশোরগঞ্জের ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট টিটু দাস জানান, বৃষ্টিতে হাওরের নিচু জায়গায় দুই হাজার হেক্টর ধানের জমি জলাবদ্ধ হয়ে যায়। ওই অবস্থায়ই ধান কাটতে হয় কৃষকদের। এতে তারা একর প্রতি ১০/১২ মণ ধান কম পেয়েছে। এদিকে, শিলাবৃষ্টিতে তেমন কোনো ক্ষতি না হলেও ধান শুকাতে সমস্যা হয়েছে। এছাড়া বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়ায় কিছু ধান ছত্রাক আক্রান্ত হয়ে নষ্ট হয়ে গেছে।
জেলা কৃষি অফিস ও স্থানীয় কৃষকদের বরাত দিয়ে বরিশালের স্টাফ করেসপন্ডেন্ট মুশফিক সৌরভ জানান, এবার যে পরিমাণ বৃষ্টি বরিশালে হয়েছে; তাতে বোরো ধানের তেমন কোনো ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কারণ বেশিরভাগ ধানই কাটা হয়ে গেছে। আর এখানে রাতে বৃষ্টি হওয়ায় ধান শুকানোর ওপরেও বৃষ্টির কোনো প্রভাব পড়েনি।
রংপুরের স্টাফ করেসপন্ডেন্ট নজরুল ইসলাম জানান, বৃষ্টির আগেই তার জেলার ৭৫ ভাগ ধান ঘরে উঠেছে। বাকি ২৫ ভাগ ধানের গোড়া ডুবে গেছে বৃষ্টির পানিতে। আবার বৃষ্টির কারণে শুকাতেও হিমশিম খাচ্ছে কৃষক।
হবিগঞ্জ ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট জিয়া উদ্দিন দুলাল জানান, এবার হবিগঞ্জে মোট এক লাখ ১৩ হাজার ২০ হেক্টর জমিতে ধান চাষ করা হয়। এর মধ্যে তিন হাজার ২৫০ হেক্টর জমির ধান বৃষ্টিতে নষ্ট হয়ে গেছে। উজান থেকে নেমে আসা ঢল ও শিলাবৃষ্টিতে ধানের শীষ ঝড়ে গেছে, কিছু ধান পানিতে ডুবে গেছে। এতে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১৭ কোটি টাকা।
এদিকে, সিরাজগঞ্জ ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট স্বপন চন্দ্র দাস জানান, সম্প্রতি থেমে থেমে বৃষ্টি হলেও ধান ঘরে তুলতে সমস্যা হচ্ছে না সিরাজগঞ্জের কৃষকদের। কারণ এ ব্যাপারে আগে থেকেই প্রস্তুতি ছিল তাদের।
সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার হামকুড়িয়া গ্রামের আক্তার, শিবনাথপুরের নজমুদ্দিন, তাড়াশের বিনাসড়া এলাকার সোহেল রানা, আবু তালেবসহ অনেক কৃষক জানান, প্রায় ২০/২৫ দিন আগে সিরাজগঞ্জে ধান কাটা শুরু হয়। তখন ভালোভাবেই সম্পন্ন হয় কাটা ও মাড়াই। অধিকাংশ কৃষকের ধান ঘরে তুলতে কোনো সমস্যা হয়নি। তবে শেষভাগে এসে থেমে থেমে হওয়া বৃষ্টিতে সাময়িক সমস্যা হলেও তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। কারণ ধান মাড়াইয়ের সময় কৃষকেরা বড় বড় পলিথিন কাছেই রাখতো। বৃষ্টি শুরুর আগেই তারা পলিথিন দিয়ে সেগুলো ঢেকে রাখায় কারো কোনো ক্ষতি হয়নি।
সম্প্রতি সিরাজগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. ওমর আলী জানান, এরই মধ্যে সিরাজগঞ্জের প্রায় ৮০ ভাগ জমির ধান কাটা ও মাড়াই শেষ। এবারের বৃষ্টিতে কৃষকের আর্থিক ক্ষতির তেমন সম্ভাবনা নেই। তবে দ্রুত ধান ঘরে তুলতে বাড়তি শ্রম দিতে হচ্ছে তাদের।
নাটোর ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট মামুনুর রশিদ জানান, দিন ১৫ আগেই নাটোরের চলনবিল ও হালতিবিলের বোরো ধান কাটা ও মাড়াই শেষ হয়েছে। দুই/একটি জায়গায় কিছু ধান কাটা বাকি থাকলেও তাতে বৃষ্টিপাতের কোনো প্রভাব পড়েনি।
জেলার বিভিন্ন এলাকার কৃষকদের পাশাপাশি জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. আহমেদ বাংলানিউজকে এই তথ্য জানিয়েছেন।
সার্বিকভাবে সারাদেশের বোরো ধানের ওপর বৃষ্টির খুব একটা প্রভাব পড়েনি বলে জানিয়েছে কৃষি কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশ সময়: ১১৪৭ ঘণ্টা, মে ২২, ২০১৬
এসআই