বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘ফণী’ শস্য ভাণ্ডারখ্যাত বগুড়ার ১২টি উপজেলায় আঘাত হানায় উঠতি বোরো ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। প্রত্যেক উপজেলায় কমবেশি ক্ষেতের উঠতি ধান গাছগুলো শুয়ে গাছের মাথা মাটির সঙ্গে মিশে গেছে।
কারণ ‘ফণী’র প্রভাবে গত শুক্রবার (৩ মে) ও শনিবার (৪ মে) কখনো থেমে থেমে আবার অবিরাম মাঝারি ও ভারী বর্ষণ হয়। সঙ্গে বইতে থাকে দমকা ও ঝড়ো হাওয়া। আর তাতেই ঘটে যায় কৃষকের এমন সর্বনাশ। ‘ফণী’র প্রভাবে মাত্র দু’দিনেই কৃষকের সব স্বপ্ন লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। জেলার বিভিন্ন উপজেলার ভুক্তভোগী একাধিক বোরো চাষির সঙ্গে কথা হলে এমনই তথ্য ওঠে আসে।
তবে ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে কৃষি বিভাগের সংশ্লিষ্টরা কৃষকদের দেওয়া তথ্যের সঙ্গে অনেকটা ভিন্নমত পোষণ করেন। কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, মাত্র এক হাজার ৩১০ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা কৃষি বিভাগের এমন তথ্য মানতে নারাজ।
ক্ষতির হিসেব বর্ণনা করতে গিয়ে কৃষক নজরুল ইসলাম বাংলানিউজকে জানান, প্রায় ১৫ বিঘা জমিতে ধান লাগিয়েছেন তিনি। এরমধ্যে পাঁচ বিঘা জমিতে বিআর-২৮ ও বাকি জমিতে জিরাশাইল ধান রয়েছে। পুরো জমির ফসল পানিতে নিমজ্জিত। বিআর-২৮ জাতের কিছু ধান কেটেছেন এ কৃষক। এরপরও এ জাতের ধানসহ পুরো ১০ বিঘা জমির জিরাশাইল ধান পানিতে পড়ে রয়েছে।
এ কৃষকের ভাষ্য, ‘জিরাশাইল ধান পানিতে সপ্তাহখানেক থাকলে জমিতেই সে ধান থেকে বীজ গজায়। তাই কাটা মাড়াইয়ের পর এসব ধান থেকে কি ফলন আশা করা যায়। একমাত্র বিআর-২৮ জাতের ধান ছাড়া বর্তমানে কোনো জাতের ধান কাটার উপযোগী না। এছাড়া সিংহভাগ কৃষকের ধান জমিতে পড়ে রয়েছে। এভাবে হিসেব কষলেই আসল ক্ষতি বেরিয়ে আসবে। কিন্তু তারা (কৃষি বিভাগ) এটা করবে না। ’
রেজাউল করিম বাবলু নামে আরেক কৃষক বাংলানিউজকে জানান, তিনি প্রায় ১০ বিঘা জমিতে ধান লাগিয়েছেন। ভালো দাম পাওয়ার আশায় কাটারিভোগ জাতের ধান লাগিয়েছেন। কিন্তু ‘ফণী’র প্রভাবে কমবেশি পুরো জমির ধান মাটিতে শুয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় ধান কবে পাকবে। কবে কাটার সময় হবে। তা চিন্তা করতেই চোখে জল এসে যায়।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, চলতি বোরো মৌসুমে এ জেলায় এক লাখ ৮৮ হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন জাতের ধান লাগানো হয়েছে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে সাত লাখ ৫৪ হাজার ৪০ মেট্রিকটন।
এদিকে, ‘ফণী’র আগে তীব্র তাপদাহের কারণে নেক ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হয় জেলায় প্রায় ১৭ হেক্টর জমির ধানক্ষেত। এসব ক্ষেতের সিংহভাগ ধানই চিটাই পরিণত হয়েছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালকের কার্যালয়ের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা ফরিদুর রহমান বাংলানিউজকে জানান, ‘ফণী’র প্রভাবে জেলার এক হাজার ৩১০ হেক্টর জমির ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ হিসেবে সাত হেক্টর জমির ফসল পুরো মাত্রায় ক্ষতি হবে। সোমবার (৬ মে) পর্যন্ত জেলার মাত্র ২০ ভাগ জমির ধান কাটা হয়েছে।
তিনি আরো জানান, এ জেলায় বিআর-২৮, ৫৮, ৮১, কাটারিভোগ, সুবললতা, কাজললতা, জিরাশাইলসহ বেশ কয়েকটি জাতের ধান লাগিয়েছেন কৃষকরা। এরমধ্যে বিআর-২৮ জাতের ধান কাটা চলছে। বাকি জাতের ধান কাটতে জাতভেদে আরো এক সপ্তাহ থেকে প্রায় মাস খানেক সময় লাগবে। এ সময়ের মধ্যে আবহাওয়া প্রতিকূলে গেলে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বেন কৃষকরা। তবে তার আগেই অনেক জমির ধান কাটা মাড়াইয়ের কাজ শেষ হবে।
কৃষি কর্মকর্তা ফরিদুর রহমান জানান, আবহাওয়ার কারণে কৃষকরা আধাপাকা ধানই কেটে ঘরে তুলছেন। এছাড়া শতকরা ৮০ ভাগ পাকা ধান কাটলে ফলনেও কোনো ঘাটতি হবে না। এ কারণে শ্রমিক পাওয়া নিয়ে একটা চাপ আছে। তবে সঙ্কট নেই। হয়তো শ্রমিকরা স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বাড়তি মজুরি নিচ্ছেন।
শ্রমিক সঙ্কট না হওয়ার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, কৃষক ইচ্ছে করলেই সব জাতের ধান কাটতে পারবেন না। কারণ ধান তো পাকতে হবে। একেবারে কাঁচা ধান কোনো কৃষকই কাটবেন না। জাতভেদে ধান পাকবে। সে অনুযায়ী কৃষককে ধান কাটতে হবে। তাই শ্রমিক সঙ্কটের কোনো কারণ দেখছেন না এ উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা।
বাংলাদেশ সময়: ১৫০৯ ঘণ্টা, মে ০৭, ২০১৯
এমবিএইচ/আরবি/