নাটোর: প্রথম দফার বন্যায় আউশ-আমন ধানের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে রোপা আমনের চারা রোপণ করেছিলেন নাটোরের কৃষকরা। ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্নে বিভোর ছিলেন তারা।
কৃষি বিভাগ জানিয়েছেন, প্রথম দফার বন্যায় ৫৭১ হেক্টর জমির আউশ ধান পানিতে নিমজ্জিত হওয়ায় কৃষকরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে তারা রোপণ করেছিলেন রোপা আমনের চারা। দ্বিতীয় দফার বন্যায় মাত্র দুই দিনের ব্যবধানে সম্পূর্ণভাবে পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে কৃষকদের সদ্য রোপণ করা ৩ হাজার ৪৭০ হেক্টর রোপা আমনের চারা। এবার সেই ক্ষতিটুকু পুষিয়ে নিতে বন্যার পানি নেমে গেলেই সেখানে আগাম ও উচ্চ ফলনশীল জাতের সরিষার আবাদ করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে কৃষকদের।
কৃষি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলতি মৌসুমে নাটোর জেলায় বন্যার কারণে রোপা আমনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না।
সরেজমিনে বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ও কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আউশ আমন ধান কেটে শেষ করতে না করতেই জেলার বিভিন্ন উপজেলায় চাষ করেন রোপা আমন ধান। যেসব জমিতে আউশ আমন ধান পানিতে নিমজ্জিত হয়ে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। সেখানে তারা রোপা আমনের চারা রোপণ করেছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় দফার বন্যার কারণে বিশেষ করে নিচু এলাকায় সেই রোপা আমনের চারাও পানিতে তলিয়ে গেছে। আর উঁচু এলাকার কোথাও কোথাও বৃষ্টিপাতে সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় রোপা আমনের চারা ডুবে গেছে। পানি সরে গেলেও বন্যায় আক্রান্ত এইসব রোপা আমনের চারা বাঁচানো সম্ভব হয়নি। ফলে কৃষকরা এসব ক্ষতিগ্রস্ত ফসলি জমির এসব ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বিকল্প ফসল চাষাবাদের চিন্তা ভাবনা করছেন বলে জানিয়েছে কৃষি বিভাগ।
এদিকে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, কোনো কোনো এলাকায় রোপা আমন ধান কাটা শুরু হয়েছে। সে সমস্ত জমিতে প্রতি বিঘায় ধানের ফলন হয়েছে ১৬ থেকে ১৮ মণ। কোনো কোনো এলাকায় ধানে সবেমাত্র ফুল এসেছে। আবার যেসব এলাকায় বন্যার কারণে দেরিতে চারা রোপণ করেছিলেন, সেসব এলাকায় সবুজ হয়ে উঠছে ধানের গাছ। তবে সে সমস্ত এলাকায় রোপা আমনের ধান গাছে পোকার আক্রমণ দেখা দিয়েছে। এছাড়া ধানের পাতা মোড়ানো ও ব্লাস্ট রোগ দেখা দিয়েছে। কৃষকরা ফসল বাঁচাতে কৃষি বিভাগের পরামর্শ নিয়ে কীটনাশক স্প্রে করছেন।
নাটোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে নাটোর জেলার সাতটি উপজেলায় ৭৬ হাজার ৭৫০ হেক্টর জমিতে রোপা আমন চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ৩৪০ হেক্টর, নলডাঙ্গায় ৩১০ হেক্টর, সিংড়ায় ২ হাজার ৯৬০ হেক্টর, গুরুদাসপুরে ১ হাজার ৯৮০ হেক্টর, লালপুরে ৩৬৬ হেক্টর ও বড়াইগ্রামে ২ হাজার ৫৬০ হেক্টর।
সেখানে বর্তমানে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে ৬৭ হাজার ৭৮৫ হেক্টর। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ১০ হাজার ৭২০ হেক্টর, নলডাঙ্গায় ২ হাজার ৬১০ হেক্টর, সিংড়ায় ২১ হাজার ৫০০ হেক্টর, গুরুদাসপুরে ৫ হাজার ৭০০ হেক্টর, বড়াইগ্রামে ১৪ হাজার ৭৫৫ হেক্টর, লালপুরে ৭ হাজার ৮২০ হেক্টর ও বাগাতিপাড়া উপজেলায় ৪ হাজার ৬৮০ হেক্টর।
সূত্র আরও জানায়, গত মৌসুমে নাটোর জেলায় রোপা আমনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৫৯ হাজার ৮২০ হেক্টর। সেখানে অর্জিত হয়েছিল ৬৯ হাজার ২৯০ হেক্টর। মোট ধান উৎপাদন হয়েছিল ২ লাখ ২৫০ মেট্রিক টন।
ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা জানান, বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর সময় মতো এসব জমিতে ফসল ফলাতে না পারলে আর্থিকভাবে তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তবে বন্যার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সরকারি কৃষি প্রণোদনার পাশাপাশি কৃষিঋণ সুবিধা পেলে তারা অনেকটা কাটিয়ে উঠতে পারবেন বলে দাবি করেন।
সিংড়া উপজেলার রামনগর গ্রামের কৃষক মো. চাঁদ আলী জানান, এবারের বন্যায় তার ১০ বিঘা জমির রোপা আমন ক্ষেত পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। এতে তিনি অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। সেই ক্ষেতের পানি নেমে গেলে তিনি বোরো ধানের আগেই আগাম জাতের সরিষার চাষ করবেন। একই উপজেলার শালমারা গ্রামের কৃষক মোখলেসুর রহমান জানান, বন্যার কারণে তার ৮ বিঘা জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে তাকে অনেক বেগ পেতে হবে।
একই কথা জানালেন, নলডাঙ্গা উপজেলার কাশিয়াবাড়ী গ্রামের কৃষক সুভাষ চন্দ্র সরকার, সুমন আলীসহ আরো অনেকে।
তারা বলেন, বন্যায় এই রোপা আমন ধান পানিতে নিমজ্জিত হওয়ায় অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এখন বিকল্প ফসল চাষের মাধ্যমে উত্তরণ ছাড়া কোনো পথ নেই। তাই সরকারিভাবে সার ও বীজ সহায়তা প্রয়োজন। তবে তারা আসন্ন বোরো মৌসুমের আগেই ক্ষতিগ্রস্ত জমিতে আগাম জাতের ও স্বল্পমেয়াদী সরিষার আবাদ করবেন। এ ব্যাপারে কৃষি বিভাগও তাদের একই পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন তারা।
নাটোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সুব্রত কুমার সরকার বাংলানিউজকে জানান, রোপা আমনের ধান রোপণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হলেও বন্যার কারণে ৩ হাজার ৪৭০ হেক্টর জমির ধান পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। যা কোনোভাবেই রিকভারি করা সম্ভব নয় বলে জানান তিনি। তবে ওই জমিতে বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কৃষকদের আগাম জাতের এবং উচ্চফলনশীল জাতের সরিষা আবাদ করার জন্য পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। পরে সরিষা তুলে বোরোর আবাদ করা যাবে ওই জমিতে।
তিনি বলেন, বন্যার পানিতে নিমজ্জিত হওয়ার পর যেটুকু ফসল রক্ষা পেয়েছে। তাতে আর কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে রোপা আমনের বাম্পার ফলন হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, বন্যায় ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এবং রবি মৌসুমে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকার নাটোর জেলার ৩৬ হাজার কৃষককে পুনর্বাসন কর্মসূচির আওতায় বিভিন্ন ফসলের বীজ ও সার প্রদান করবে। ইতোমধ্যে কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে এ সংক্রান্ত একটি চিঠি পেয়েছেন তারা। আগামী সপ্তাহে জেলা কৃষি পুনর্বাসন বাস্তবায়ন কমিটির মাধ্যমে তা উপজেলা পর্যায়ে বিভাজন করে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করার ব্যবস্থা করা হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১১৩৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৫, ২০২০
আরএ