ময়মনসিংহ: সেচ সংকটের কারণে ভালো নেই ময়মনসিংহের কৃষকরা। চলতি মৌসুমে আমন রোপণ নিয়ে তাদের কপালে পড়েছে চিন্তার ভাঁজ।
জানা গেছে, জৈষ্ঠ্যের তাপদাহ পেরিয়ে শ্রাবণে বৃষ্টি শুরু হলে কাদা-জলের মধ্যে করা হয় আমন রোপণের কাজ। জমি উঁচু-নিচু ভেদে তা চলে ভাদ্র মাস পর্যন্ত। এর আগে চলে জমি চাষাবাদ ও বীজতলা তৈরির কাজ।
ময়মনসিংহের কৃষকরা সেই পরিকল্পনা নিয়ে করছিলেন অপেক্ষা। তাদের প্রত্যাশা ছিল এবারের আষাঢ়ে তেমন বৃষ্টি না হলেও শ্রাবণে বৃষ্টি হবে। আর তখনই তারা আমন রোপণের কাজ সেরে ফেলতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু এবারে সেই চিরচেনা বাংলার রূপ ছিল অনেকটাই অচেনা। আবহাওয়ার বৈরী আচরণের মধ্যে দিয়ে বৃষ্টি না হয়ে বরং তীব্র খরার মধ্যে বিদায় নিয়েছে শ্রাবণ। আর যেটুকু বৃষ্টি হয়েছে তা ছিল কৃষকদের প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম।
এমন পরিস্থিতির মধ্যে জমি ও বীজতলা প্রস্তুত রেখেও অনাবৃষ্টি আর তাপদাহের কারণে শুষ্ক মাটিতে আমন রোপণ করতে পারছেন না কৃষকরা। অনেকে সেচ যন্ত্রের মাধ্যমে আমনের চারা রোপণ শুরু করেছেন। কিন্তু লাগামহীন লোডশেডিংয়ের কারণে সেটিও ঠিকমতো করা সম্ভব হচ্ছে না।
ময়মনসিংহ সদর উপজেলাসহ গৌরীপুর উপজেলার ভাংনামারী, ডৌহাখলা, ঈশ্বরগঞ্জের মরিচার চর, রাজীবপুর ও তারুন্দিয়া ইউনিয়নের বিভিন্ন ক্ষেত ঘুরে দেখা গেছে এমন চিত্র।
সেসব এলাকার কৃষকরা জানান, সম্প্রতি সরকারের ঘোষণায় বেড়েছে সার ও ডিজেলের দাম। এ জন্য সেচ ও জমি চাষাবাদে খরচ বেড়ে গেছে।
যন্ত্রনির্ভর কৃষিতে এখন আর গরু-লাঙল-জোয়ালের সনাতন পদ্ধতিতে চাষাবাদ হয় না। সময়ের ব্যবধানে এখন কৃষিকাজে আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার বেড়েছে। আর এর মধ্যে বিদ্যুৎ ও ডিজেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় এসব যন্ত্র দিয়ে সেচ খরচও বেড়েছে।
গৌরীপুর উপজেলার ভাংনামারী ইউনিয়নের ভোলার আলগী গ্রামের কৃষক মো. হাফিজ উদ্দিন আকন্দ (৫৬) বলেন, শ্রাবণ ও ভাদ্র মাস হচ্ছে আমন রোপণের সময়। কিন্তু বৃষ্টি না থাকায় জমির মাটি শুকনো হয়ে আছে। ফলে জমি ও বীজতলা প্রস্তুত থাকলেও আমনের চারা রোপণ করতে পারছি না।
একই মাঠে কথা হলে মো. নিরব মিয়া ও অনিক মিয়া নামে দুইজন ট্রাক্টর চালক বলেন, সকালে জমি চাষ করতে ক্ষেতে আইছি। কিন্তু একটু পরে পরে কারেন্ট যাইতাছে গা। এর লাইগ্যা ক্ষেতে পানি দিতা পারতাছি না। ট্রাক্টর বন্ধ কইরা খাড়াইয়া রইছি।
তারা আরও জানান, এক কাঠা জমি চাষ করতে ট্রাক্টর খরচ লাগে ১৫০ টাকা। ধান রোপণ হলে ক্ষেত চাষ করতে হয় পাঁচটা। এতে খরচ হয় ৭৫০ টাকা। আর মোটর সেচ খরচ আগে ৩০০ টাকা থাকলেও তা এখন বেড়ে ৪০০ টাকা হয়েছে। এর পর ক্ষেত লাগাতে জন প্রতি শ্রমিকে খরচ হয় ৪০০-৫০০ টাকা। এর বাইরে সার-বীজ আর ক্ষেত নিড়ানির খরচ তো আছেই। কিন্তু বৃষ্টি হলে খরচটা কম লাগতো।
স্থানীয় কৃষক মো. শাফিকুর রহমান শবি মিয়া (৫৫) বলেন, জমি ও বীজতলা তৈরি, রোপণ, নিয়মতি সেচ, কীটনাশক প্রয়োগ, দুইবার আগাছা বাছাই, সার দেওয়া থেকে ধান মাড়াই পর্যন্ত এক কাঠা জমিতে মোট খরচ হয় প্রায় তিন হাজার ৫০০ টাকা। এর পর প্রতি কাঠা জমিতে ধান উৎপাদন হতে পারে সর্বোচ্চ ৩ থেকে ৪ মণ। যার বাজার মূল্য তিন হাজার ২০০ থেকে চার হাজার টাকা। তাই লাভের আশা ছেড়ে দিয়ে শুধু ঘরের ভাত খাওয়ার আশায় আমন চাষ করছি। চড়া বাজারে চাল কিনে খাওয়ার মতো সামর্থ্য আরও অনেক কৃষকেরই নেই।
তিনি আরও বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতেও সরকার যদি কৃষকের চাষাবাদ খরচ ও ধানের দামে সমন্বয় না করে তাহলে কৃষক সমাজ ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়বে।
কৃষকদের এ ধরনের মন্তব্যের সঙ্গে এক মত দিয়েছেন গৌরীপুর উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা লুৎফুন নাহার। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, আমন চাষ সাধারণ বৃষ্টি নির্ভর হয়ে থাকে। কিন্তু এবার বৃষ্টি কম হওয়ায় কিছুটা সেচ সংকট সৃষ্টি হয়েছে। ফলে অনেক ক্ষেত্রে সেচ নির্ভর হয়ে গেছে আমন রোপণের কাজ।
তিনি আরও বলেন, ডিজেল ও সারের দাম বৃদ্ধির পরে কৃষকদের উৎপাদন খরচ আরও বেড়ে গেছে। তারপরেও তারা যদি ধানের ন্যায্য মূল্য না পান, তাহলে ক্ষতির মুখে পড়ে কৃষকরা আমন রোপণে আগ্রহই হারিয়ে ফেলবেন। এতে করে দেশের খাদ্য উৎপাদনও ব্যাহত হবে। আশা করছি সরকার ধানের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করবে।
কৃষি কর্মকর্তা আরও বলেন, চলতি মৌসুমে গৌরীপুর উপজেলায় আমনের লক্ষ্যমাত্র রয়েছে ২০ হাজার ৮৩৫ হেক্টর জমিতে। ইতোমধ্যে এ লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ৮০ ভাগ রোপণ হয়ে গেছে। বাকিগুলোর রোপণ কাজ ভাদ্রের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে শেষ হয়ে যেতে পারে।
এদিকে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. মতিউজ্জামান জানান, অনাবৃষ্টির কারণে এ মৌসুমে সেচ সংকট দেখা দিয়েছে। বিকল্প হিসেবে কৃষকদের পাম্প ও ফিতা পাইপের মাধ্যমে সেচ কাজের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। চলতি মৌসুমে জেলায় দুই লাখ ৬৮ হাজার ৩২০ হেক্টর জমিতে আমন রোপণ করা হবে। এ লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ৬০ ভাগ ইতোমধ্যে রোপণ হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৫৩ ঘণ্টা, আগস্ট ২০, ২০২২
এফআর