রাজশাহী: কৃষি প্রধান এই দেশের চাষ পদ্ধতি এখনও চলছে সেই সনাতনী নিয়মেই। তবে দেরিতে হলেও কৃষিতে পরিবর্তনের হাওয়া লাগতে শুরু করেছে।
তীব্র খাদ্য চাহিদা ও সংকটের এই যুগে কৃষি ব্যবস্থা নিয়ে শুরু হয়েছে অন্বেষণ। প্রযুক্তির ছোঁয়ায় আবারও আশা জাগানিয়া হয়ে উঠছে দেশীয় কৃষি। মিশ্র চাষের পদাঙ্ক অনুসরণ করে এক জমিতে ফলছে হরেক রকম ফল ও ফসল। 'মিশ্র চাষ পদ্ধতি' তাই কৃষকদের দেখাচ্ছে- নতুন দিনের স্বপ্ন।
খুব বেশি কিছু প্রয়োজন নেই। সফলতা পেতে কেবল আধুনিক কৃষি নিয়ে সচেতনতা ও উদ্ভাবনী ইচ্ছা শক্তিই যথেষ্ট। কারণ 'মিশ্র চাষ পদ্ধতি' এখন আর কেবলই স্বপ্ন নয়, সফল কৃষি গাঁথা। সমন্বিত পদ্ধতিতে মাছ ও হাঁস-মুরগি পালনে সফলতা মিলেছে এরই মধ্যে। এবার মিশ্র ফল ও ফসল চাষ নিয়ে গবেষণা শুরু হয়েছে। আর পূর্ব অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে একসঙ্গে ফল ও ফসল চাষ করে হাতেহাতে লাভের মুখও দেখছেন কৃষকরা।
কম সময়ে একই জমিতে দুই ফসল চাষে একদিকে যেমন খবচ কমছে। তেমনি মিলছে অধিক ফসল। তাই মুনাফাও দ্বিগুণ। লাভের অংক বেশি হওয়ায় হাসি ফুটেছে কৃষকদের মুখে। ফলে অল্প দিনেই দেশের 'শস্যভাণ্ডার' খ্যাত রাজশাহী অঞ্চলে জনপ্রিয়তা পেয়েছে মিশ্র চাষ পদ্ধতি। এক জনের দেখাদেখি উৎসাহিত হচ্ছেন অন্যজন। এভাবে গ্রামের পর গ্রাম ছড়িয়ে পড়ছে নতুন এই মিশ্র চাষ ব্যবস্থা। বিশেষত তরুণ কৃষি উদ্যোক্তারা নিজ নিজ গ্রামে গড়ে তুলেছেন- এই ধরনের একাধিক মিশ্র ফল ও ফসলের বাগান। যেকোনো ফলের সাথে চাষ করছেন শীতকালীন আগাম সবজি। বাজারে চাহিদা থাকায় দামও মিলছে ভালো। চাহিদার তুলনায় মিশ্র সবজির আবাদ বেশি। তাই রাজশাহীর চাহিদা মিটিয়ে তরতাজা আগাম শীতকালীন সবজি ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বাজারে সরাসরি চলে যাচ্ছে ক্ষেত থেকেই।
বর্তমানে নতুন এই মিশ্র চাষ পদ্ধতিতে রাজশাহীর গোদাগাড়ী, পবা, পুঠিয়া, বাঘা ও চারঘাট উপজেলায় সবচেয়ে বেশি ফল ও ফসল হয়েছে। রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী চলতি খরিপ-২ মৌসুমে এই জেলার নয়টি উপজেলার মোট ২ হাজার হেক্টর জমিতে মিশ্র চাষ পদ্ধতিতে ফল ও সবজি হচ্ছে। এর মধ্যে চলতি মৌসুমে আগাম শীতকালীন সবজি যেমন- মুলা, ফুলকপি, বাঁধাকপি, শিম, মরিচ, বেগুন, লাউ, করলা, ঢেঁড়স ছাড়াও পটল ও লালশাক চাষ হয়েছে সবচেয়ে বেশি। একই জমিতে কম খরচে অধিক ফসল উৎপাদনে মিশ্র চাষ পদ্ধতি অনুসরণে উৎসাহিত হচ্ছেন কৃষকরা।
রাজশাহীর পবার বড়গাছি, হুজুরীপাড়া ও দামকুড়া ইউনিয়নের একাধিক কৃষক ও উদ্যোক্তা মিশ্র ফল-সবজির বাগান গড়ে তুলেছেন। এসব বাগানে একইসঙ্গে ড্রাগন ফল, সবুজ (বারি-১) মাল্টা, শসা, পেয়ারা, পেঁপে, লেবু, লালশাক, বাঁধাকপি ও কাঁচামরিচ চাষ করছেন।
পবা উপজেলার হুজুরীপাড়া ইউনিয়নের কৃষি উদ্যোক্তা প্রকৌশলী সারোয়ার জাহান প্রিন্স বাংলানিউজকে জানান, তার বাগানের বয়স দুই বছর ১০ মাস। ১১ লাখ টাকা ব্যয়ে নয় বিঘা জমির ওপর মাল্টা বাগান গড়ে তুলেছেন। বারি-১ জাতের এই মাল্টার সাথে আগাম শীতকালীন সবজিও চাষ করছেন। মাল্টার সাথে ফুলকপি ও বাঁধাকপি ও কাঁচা মরিচের মিশ্রচাষ করেছেন। এরই মধ্যে কাঁচা মরিচ বিক্রি শুরু করেছেন।
গেল সপ্তাহে শুধু ৪৫ হাজার টাকার কাঁচা মরিচই বিক্রি করেছেন। এছাড়া এখনও তার জমিতে শীতকালীন ফুলকপি ও বাঁধাকপি রয়েছে। এছাড়াও প্রায় ৬০ হাজার টাকার মাল্টা বিক্রি করেছেন। ফুলকপি ও বাঁধাকপি বিক্রি শেষ হলে একই জমিতে মিষ্টি কুমড়া ও শসা লাগাবেন।
একজন প্রকৌশলী হয়েও চাকরির পাশাপাশি এভাবেই প্রায় তিন বছর থেকে মিশ্র চাষ পদ্ধতিতে ফল ও ফসল চাষ করছেন। লাভবানও হচ্ছেন বলে জানান এই সফল কৃষি উদ্যোক্তা। রাজশাহীর পবা উপজেলার বারনই নদীর তীরে থাকা পূর্ব পুঠিয়াপাড়া গ্রামের এমন আরেক সফল কৃষকের নাম মোফাক্কার হোসেন।
তিনি একজন মাদ্রাসা শিক্ষক হয়েও আদি পেশা ছাড়েননি। নিজ গ্রামেই থাকা মোট তিন বিঘা জমিতে একই সঙ্গে ড্রাগন এবং বাঁধাকপি চাষ করেছেন।
তার জমিতে গিয়ে দেখা যায়, আধুনিক এই চাষবাদ পদ্ধতি। সিমেন্টের রিংয়ের ওপর ড্রাগন ফল এবং নিচের মাটিতে চাষ করছেন-শীতকালীন ফুলকপি ও বাঁধাকপি। এটি চাষ পদ্ধতি খুবই ফলপ্রসু বলে বাংলানিউজকে জানালেন মোফাক্কার হোসেন।
এই পদ্ধতিতে তিনি অল্প সময়ে ছোট্ট ড্রাগন ফল বাগান এবং শীতকালীন সবজির ক্ষেত প্রতিষ্ঠা করেছেন। এরই মধ্য ফল দিতে শুরু করেছে ড্রাগন গাছ।
শিক্ষক মোফাক্কার হোসেনের ড্রাগন বাগান ঘুরে দেখা গেছে, নানান গুণ সমৃদ্ধ ড্রাগন ফলের বাণিজ্যিক চাষ হচ্ছে। পাশাপাশি অন্য সবজি চাষেও পেয়েছেন সফলতা। তার ড্রাগন বাগানের ফাঁকা জমিতে এখন বাঁধাকপির চাষ শুরু করেছেন। এর আগে সেখানে বেগুন ও আলু চাষ করেছিলেন বলে জানালেন।
রোগ-বালাই কম হওয়া, চাষ পদ্ধতি সহজ হওয়া এবং বাজারে ভালো চাহিদা থাকায় ভিনদেশী এই ফল চাষে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন আশপাশের কৃষকরাও।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. মোজদার হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, কেবল পবা নয়, রাজশাহীর নয় উপজেলাতেই এখন মিশ্র চাষ পদ্ধতিতে ফল ও ফসল হচ্ছে। একই জমিতে কম সময়ে অধিক ফল ও ফসন হওয়ায় কৃষি উদ্যোক্তা ও তৃণমূল কৃষকরা এই পদ্ধতিতে বেশি আগ্রহী হয়ে উঠছেন। বেশি মুনাফা হওয়ার কারণে এরই মধ্যে জেলার সবজি চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। জানতে চাইলে ডিডি মোজদার হোসেন বলেন, চলতি খরিপ-২ মৌসুমে প্রায় দুই হাজার হেক্টর জমিতে মিশ্র চাষ পদ্ধতিতে ফল ও সবজি চাষ হয়েছে। কৃষি বিভাগ থেকে মিশ্র চাষের ব্যাপারে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।
রোগবালাই সম্পর্কে মাঠ পর্যায়ের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তারা প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিচ্ছেন। একাধিক ফসল চাষে কৃষকের যেমন বেশি মুনাফা হয়। তেমনি জমির উর্বরতা শক্তিও বাড়ে। বেশি লাভ হওয়ায় কৃষকদের মধ্যে মিশ্র চাষ পদ্ধতি খুব কম সময়েই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
বাজারে সবজির চাহিদা ও দর ভালে থাকায় চলতি মৌসুমে এখানকার কৃষকরা অধিক লাভবান হচ্ছেন বলেও উল্লেখ করেন ওই ঊর্ধ্বতন কৃষি কর্মকর্তা।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৪৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৩, ২০২২
এসএস/এএটি