ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

ধারাবাহিক উপন্যাস

মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-৬

আলম শাইন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০০৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২২, ২০২৩
মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-৬

পাকা তেলাকুচা খাওয়ার পর অর্পিতার শারীরিক দুর্বলতা সামান্য কেটেছে। তবে পিপাসা মেটেনি।

এই মুহূর্তে পানির খুব প্রয়োজন। পানি খেতে না পারলে খুব সমস্যায় পড়বে। নির্জন দ্বীপে ডিহাইড্রেশন শুরু হলে পরিত্রাণের উপায় নেই। এখানে সাহায্য করার মতো কেউ নেইও। এদিকে ডিহাইড্রেশনের প্রাথমিক লক্ষণও ওর শরীরে দেখা যাচ্ছে। জিভ শুকিয়ে ভারী হয়ে এসেছে, মাথা ঘুরছে, ক্লান্ত লাগছে। যেভাবে হোক পানির উৎস খুঁজতে হবে আগে। দ্বীপে খাবার পানির উৎস আছে, সে নিশ্চিতও হয়েছে। কিছুক্ষণ আগেই দেখেছে দ্বীপবাসীর পদচারণা। কয়েকজন কালো কুচকুচে মানুষকে সৈকতে পড়ে থাকা একটা লোককে বেঁধে ঝুলিয়ে নিতে দেখেছে। বেঁধে নেওয়া লোকটাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে অর্পিতার কলজে কেঁপে উঠল তিয়াস ভেবে। কিন্তু দূর থেকে লোকটার চেহারা চেনা যাচ্ছে না। লোকটাকে চেনা খুবই প্রয়োজন, তাই ঘাড় ফিরিয়ে ভালোমতো দেখল তিয়াস কি না। দেখে যতটা নিশ্চিত হলো তিয়াস নয়। তিয়াস আরও ফর্সা, উচ্চতা সাড়ে পাঁচ ফুট ছাড়িয়ে। এই লোকটা ততটা ফর্সা না হলেও উচ্চতায় তিয়াসের চেয়ে বেশি বৈ কম নয়। তাছাড়া তিয়াসের পরনে ছিল ধূসর-সবুজ জিন্সপ্যান্ট, এই লোকটার পরনের প্যান্টের কালার ভিন্ন। শার্টের রংটা বোঝা যায়নি, গায়ে লাইফ জ্যাকেট থাকায়। আহত লোকটাকে সাহায্য করার ইচ্ছে থাকলেও পারেনি কালো মানুষগুলোর ভয়ে। যে কারণে নিজকে লুকিয়ে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগল অর্পিতা।

কয়েক মিনিট আগেও অর্পিতা বালির ঢিবির উপর শুয়ে ছিল। কালো মানুষগুলোর ঘোৎ ঘোৎ আওয়াজ আর উল্লাসে ওর ঘুম ভেঙে গেছে। চোখ মেলতেই দেখতে পেল বুনো ধরনের কিছু মানুষ তীর-ধনুক হাতে নিয়ে নেচে নেচে উল্লাস করছে। মানুষগুলোর অঙ্গভঙ্গি দেখে অর্পিতা বুঝে ফেলেছে ওরা হিংস্র প্রকৃতির। সভ্য নয়; সভ্য হলে অন্তত শরীর অনাবৃত থাকত না। তাছাড়া বিপদগ্রস্ত কাউকে এভাবে কষ্ট দিয়ে বেঁধে ঝুলিয়ে নিতে পারত না। কী উদ্দেশ্যে তাকে বেঁধে নিয়েছে, তা অবশ্য অর্পিতার জানা নেই। তবে মানুষগুলোর উদ্দেশ্য যে মোটেও ভালো নয়, তা-ও বুঝতে পেরেছে নারকীয় উল্লাস দেখে। ওদের বীভৎস নাচানাচিতে অর্পিতা ভীষণ ভয় পেয়েছে। আচরণ দেখেই অর্পিতার মনে সন্দেহ ঢুকেছে। ওরা মানুষখোকো আদিবাসী কি না? যেমন চেহারা, তেমনি আচরণের দিকটা মানুষখেকোদের মতোই।

অর্পিতার মনে পড়ছে ন্যাশনাল জিওগ্রাফি চ্যানেলে পাপুয়া নিউগিনির একটা দ্বীপের নরখাদকদের সম্পর্কে এই ধরনের প্রামাণ্য চিত্র দেখেছিল কয়েক বছর আগে। সংবাদপত্রের মাধ্যমেও জানতে পেরেছিল নির্জন দ্বীপাঞ্চলে আদিম মানুষের অস্তিত্ব এখনো রয়েছে। যারা সুযোগ পেলেই মানুষের মাংসের স্বাদ নেয়। ন্যাশনাল জিওগ্রাফি চ্যানেলের প্রতিবেদনে দেখানো সেই মানুষগুলোর চেহারার সঙ্গে এদের যথেষ্ট মিলও আছে। ওদের মতোই কালো আর খর্বাকৃতির এই দ্বীপের মানুষগুলো। প্রতিবেদনটার কথা মনে হতেই নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করতে লাগল অর্পিতা। জঙ্গলের দিকে দৌড়ে পালানোর চিন্তাও করল একবার। কিন্তু তাতে বিপদ বেড়ে যাবে বুঝতে পারল। দৌড়াতে দেখলে কালো মানুষগুলোও পিছু নেবে। তখন দৌড়ে ওদের সঙ্গে পেরে উঠবে না। এমনিই তো দুর্বল শরীর, তার ওপর এই দ্বীপের পরিবেশও অচেনা। আবার দ্বীপের অবস্থান নিয়েও সংশয়ে আছে। বন্য মানুষগুলোকে দেখে নিশ্চিত হয়েছে যে, দ্বীপের অবস্থান বাংলাদেশে নয়। বাংলাদেশের কোনো দ্বীপাঞ্চলে আদিম মানুষের বসতি নেই। বসতি থাকলে এতদিনে তা জানাজানি হয়ে যেত। অনুমান করছে দ্বীপটার অবস্থান উপমহাদেশীয় অঞ্চলেই হবে; নিশ্চিত সে। কেননা দ্বীপের গাছ-গাছালি, ফলমূল, পাখ-পাখালি আবহাওয়া বেশ পরিচিত লাগছে। অনেকটাই বাংলাদেশ-পশ্চিমবঙ্গের জীববৈচিত্র্যের সঙ্গে মিল আছে। মিল থাকলেও এখানে পালিয়ে থাকা সম্ভব নয় বিধায় সিদ্ধান্তটা পাল্টে ফেলল। মুহূর্তেই মাথায় বুদ্ধি এলো শরীর বালি দিয়ে ঢেকে দেবে কবরের মতো করে। তাহলে আদিবাসীরা ওকে দূর থেকে দেখতে পাবে না। বিষয়টা যদিও রিস্কের, তথাপিও আর কোন বুদ্ধি মাথায় আসছে না। এই বুদ্ধিটাই উত্তম মনে হচ্ছে। এই কৌশলটা অবলম্বন করে ওকে আড়াল হতে হবে, নচেৎ দেখে ফেলবে কালোরা।

সৈকতে প্রচুর বালির ঢিবি। ঢিবিগুলো খুব উঁচু না হলেও দুই ঢিবির মধ্যখানে ড্রেনের মতো ফাঁকা জায়গা প্রচুর। বালির ড্রেনগুলোতে একজন মানুষ শুয়ে থাকলে দূর থেকে কারো নজরে পড়ার কথা নয়। তেমনি একটা ড্রেনের পাশে উঁচু বালির ঢিবির উপর শুয়ে আছে অর্পিতা। ঢিবিটার ওপর থেকে নিচে গড়িয়ে পড়তে হবে এখনই। তাহলে মোটামুটি নিরাপদ থাকতে পারবে। দাঁড়ালে দ্বীপবাসীরা দেখে ফেলবে। তাই বুদ্ধি করে অর্পিতা ঝটপট বালির ঢিবির উপর থেকে নিচে গড়িয়ে পড়ল। তাতে শব্দও হয়নি, দেখেনিও কেউ। মনে হচ্ছে আবর্জনা ছাড়া শুকনো কোনো নর্দমায় পড়েছে। এবার খুব দ্রুত দু’পাশ থেকে বালি টেনে নিজের গায়ের উপর এনে কবরের মতো করে ঢেকে দিলো। এমনভাবে ঢেকে দিলো, কাছ থেকে কেউ দেখলেও চট করে মানুষের উপস্থিতি টের পাবে না। একমাত্র গায়ের উপর দিয়ে কেউ হেঁটে না যাওয়া পর্যন্ত নিরাপদ। শুধু নাক আর চোখের অংশটুকু পরিষ্কার রাখল কালো মানুষগুলোর কীর্তিকাণ্ড দেখার জন্য। নিজেকে বালি দিয়ে ঢেকে বার বার সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করতে লাগল অর্পিতা। তিনি যেন এই ঘোর বিপদ থেকে রক্ষা করেন। যেমন রক্ষা করেছেন মহাদুযোর্গ থেকে। অর্পিতা বাঁচতে চায়, তিয়াস আর বাবা-মায়ের জন্য ওকে বেঁচে থাকতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত না নিশ্চিত হবে তারা কেউ জীবিত নেই, ততক্ষণ টিকে থাকার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাবে।

আধ ঘণ্টার মধ্যে কালো মানুষগুলো আহত লোকটাকে বেঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে চলে গেছে। ওরা যাওয়ার পর অর্পিতা বালি সরিয়ে গা ঝাড়া দিয়ে নিচ থেকে উঠে বসল। ভয়ে ওর হাত-পা থরথর করে কাঁপছে। ঠাণ্ডার মধ্যেও ঘামে শরীর ভিজে গেছে। ধবধবে ফর্সা মুখমণ্ডল রক্তিমাভ দেখাচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে ভয়ের চোটে ওর ক্ষুধা-তৃষ্ণা উধাও হয়ে গেছে। সমস্ত বিষয়টাই দুঃস্বপ্নের মতো লাগছে অর্পিতার কাছে। তাছাড়া জলে ভাসতে ভাসতে দ্বীপে আশ্রয় পাওয়াটাও অলৌকিক ঘটনা মনে হচ্ছে।

আহত লোকটার গায়ে লাইফ জ্যাকেট পরা দেখে অর্পিতা অনুমান করেছে সেও দুর্যোগের শিকার। জলস্রোত তাকেও টেনে এনেছে এই ভয়ংকর দ্বীপে। মনে মনে ভাবছে তিয়াসকেও যদি জলস্রোত এখানে আছড়ে ফেলে যেতো, তাহলে বেশ হতো। বুদ্ধিসুদ্ধি করে দু’জন পালিয়ে থাকতে পারত। দ্বীপ থেকে লোকালয়ে ফিরে যাওয়ার উপায়ও খুঁজত দু’জন মিলেমিশে।

আহত লোকটার জন্য অর্পিতার ভীষণ মায়া হচ্ছে। যদি মিনিট দশেক আগেও ঘুম ভেঙে যেত, তাহলেও লোকটাকে ওখান থেকে উদ্ধার করে আড়ালে সরিয়ে নিয়ে আসতে পারত। এখন আর করার কিছু নেই। তারপরও অর্পিতার দেখার ইচ্ছে লোকটাকে ওরা কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, উদ্দেশ্যই বা কী? সমস্যা হচ্ছে, ওদের পেছন পেছন হাঁটা যাবে না, দূর থেকে অনুসরণ করতে হবে। কাজটা ঝুঁকিপূর্ণ হলেও করতে হবে। বেঁচে থাকতে হলে এদের অবস্থান জানার প্রয়োজন আছে। আসলেই ওরা মানুষখেকো কি না তা-ও নিশ্চিত হতে হবে। অহেতুক সন্দেহ করলে উল্টো সে বিপদে পড়বে। বাসস্থান, খাদ্য-পানি এসবের জন্য হলেও দ্বীপবাসীর সাহায্য নিতে হবে। কারণ জঙ্গলে পালিয়ে থাকা ওর পক্ষে অসম্ভব। তাছাড়া কয়দিনই বা পালিয়ে থাকবে। বিশেষ করে রাতের আঁধার নেমে এলে ভয়াবহ বিপদে পড়বে। সুতরাং উপায় একটাই ওদের বাসস্থান খুঁজে বের করা।

অর্পিতা একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল কালো মানুষগুলোর গন্তব্য দেখার উদ্দেশ্যে। মিনিট দশেক তাকিয়ে থাকতেই দেখল সৈকতের শেষ প্রান্তে গিয়ে ওরা দিক পরিবর্তন করেছে, তারপর আর দেখা যায়নি। অর্পিতা সিদ্ধান্ত নিয়েছে ওদের অনুসরণ করবে, মোড় পর্যন্ত গেলে বাসস্থান সম্পর্কে জানতে পারবে। তবে সৈকত ধরে হাঁটা যাবে না, বনের কিনার ধরে হাঁটতে হবে।

সৈকতে আর নিজকে নিরাপদ মনে করছে না অর্পিতা। কারণ দ্বীপে এই কয়জন নয়, আরও কালো মানুষ আছে, ওরাও আসতে পারে এদিকে। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে অর্পিতা জঙ্গলের দিকে পা বাড়াল। বনে যদি হিংস্র প্রাণীর বিচরণ থাকে, তাহলে চেষ্টা করেও বেঁচে থাকতে পারবে না। তা জেনেও বনে ঢুকছে। কারণ অর্পিতার প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে, পিপাসায়ও কাতর। ডিহাইড্রেশন ঠেকাতে হলে পানি খেতে হবে। তাই ভোরের মতো আবারও বনে ঢুকল ফলমূল আর পানির সন্ধানে। বনের ভেতরে যত অগ্রসর হচ্ছে, ততই অন্ধকার অনুভব করছে অর্পিতা। সে কল্পনাও করেনি বন-জঙ্গল এতটা আঁধার হতে পারে। ভেতরে যত অগ্রসর হচ্ছে, ততই ভয় পাচ্ছে। তাই পুনরায় পেছন ফিরে বনের কিনার ধরে হাঁটছে। বনের কিনার ততটা দুর্ভেদ্য নয়। তবে হাঁটতে সমস্যা হচ্ছে পায়ে জুতা না থাকায়। কাঁকর-বালি মিশ্রিত বনের মাটি, ফলে পায়ের তালুতে বিঁধছে কাঁকরগুলো, তাই হাঁটতেও খুব কষ্ট হচ্ছে।

অর্পিতা সামনে অগ্রসর হচ্ছে আর চারপাশে তাকিয়ে খুঁজছে ফলমূল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পরখ করছে সব। কয়েক মিনিট হেঁটেছে সামনে, অমনি পেয়ে গেলো কয়েকটা জাম্বুরা গাছের সন্ধান। খুব খুশি হলো গাছগুলো দেখে। গাছগুলোর নিচে প্রচুর জাম্বুরা পচে আছে। অল্পকটা আছে ভালো। তার মানে এখন জাম্বুরার মৌসুম শেষের দিকে। উপরে তাকিয়ে দেখলো অল্প কিছু জাম্বুরা ঝুলছে গাছে। কিন্তু তা পেড়ে খাওয়ার সাধ্য অর্পিতার নেই। নিচে পড়ে থাকা জাম্বুরাগুলোই এখন ভরসা।

পানির পিপাসা দূর করতে হলে এই মুহূর্তে জাম্বুরার বিকল্প নেই। জাম্বুরা থেঁতলে জুসের মতো রস খেতে পারলে কিছুটা পানির চাহিদা পূরণ হবে। চিন্তাভাবনা করে ধারালো পাথরকুচি খুঁজতে লাগল অর্পিতা। বনের যত্রতত্রে বিভিন্ন আকৃতির প্রবাল পাথর ছড়িয়ে আছে। বলা যায়, সমস্ত দ্বীপজুড়েই প্রবালের রাজত্ব। খোসা ছাড়াতে তাই একটা ধারালো পাথর সংগ্রহ করল আগে। তারপর বড় সাইজের একটা জাম্বুরা হাতে নিয়ে গাছের শেকড়ের উপর বসে জটপট জাম্বুরার খোসাটা ছাড়িয়ে ফেলল। এবার কোষগুলো আলগা করে মুখে চিপে দিলো। মিষ্টি রস, খেতে বেশ লাগছে। পেট ভরে জাম্বুরার রস খেল। অনেকটাই পানির চাহিদা মিটেছে। দ্বীপে খাদ্য, পানির সমস্যা হবে না বুঝতে পেরেছে সে। খুঁজলে আরও ফলমূল পাবে। এখানকার জলবায়ু, ভূখণ্ড বাংলাদেশের মতো হওয়ায় জঙ্গলে অনেক পরিচিত দেশি ফলমূল পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। খুঁজলে খাদ্য পানি সবই মিলবে দ্বীপে; নিশ্চিত মোটামুটি। এখন প্রয়োজন নিরাপদ বাসস্থানের। হিংস্র প্রাণী আর দ্বীপবাসীর দৃষ্টি ফাঁকি দিয়ে বেঁচে থাকতে হবে। সেটা কীভাবে সম্ভব তা ওর মাথায় ঢুকছে না। বিশেষ করে রাতের বাসস্থান নিয়ে খুব চিন্তিত অর্পিতা। মনে মনে ভাবছে সভ্য মানুষের সন্ধান না পেলে অথবা নিরাপদ বাসস্থান খুঁজে না পেলে রাতে বালি ঘরের মধ্যেই ঘুমাতে হবে। তাতে নিরাপদে থাকার পাশাপাশি শীতের প্রকোপ থেকেও রক্ষা পাবে।

অর্পিতার এবারের মিশন দ্বীপবাসীদের বাসস্থান খুঁজে বের করা। বাসস্থানের খোঁজ পেলে খাদ্য, পানির সমস্যা দূর হবে। নিশ্চয়ই বাসস্থানের আশপাশে মিলবে পানির উৎসস্থল। তাদের বাসস্থানের কাছাকাছি যাওয়া যেমন ঝুঁকির, তেমনি ওদের প্রয়োজনও আছে অর্পিতার। কারণ মানুষজন ছাড়া এখানে বেঁচে থাকা কঠিন হবে। যার জন্যই আগে ভালোমন্দ বিচার করতে চায়। তবে সে যতটা অনুমান করতে পেরেছে, তা হচ্ছে দ্বীপে সভ্য মানুষের আনাগোনা নেই। থাকলে কেউ না কেউ এতক্ষণে নজরে পড়ত।

অর্পিতা দ্বীপবাসীদের বাসস্থানের কাছাকাছি গিয়ে বিস্তারিত বোঝার চেষ্টা করবে আগে। তাই পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক বনের পাশ ঘেঁষে হাঁটছে সে। সুবিধার কথা হচ্ছে, দ্বীপের এই দিকের বন-জঙ্গল অতটা গভীর নয়। সৈকত বরাবর সোজা চলে গেছে বন। যেখানে সৈকত শেষ, সেখানে বনেরও শেষ প্রান্তর। কালো মানুষদের বাসস্থান সামনের মোড় পেরুলেই সম্ভবত দেখা যেতে পারে। অর্পিতা দূর থেকে দেখেছিল যে, মানুষগুলো সামনের মোড়ে হারিয়ে গিয়েছে। তার মানে মোড়ের আশেপাশে ওদের বাসস্থান হবে হয়তো।

হাতে গাছের একটা শুকনো ডাল। আপাতত নিরাপত্তার কবজ এই ডালটাই। ছুরি-চাকু জাতীয় কিছু থাকলে মনে খানিকটা সাহস পেতো। ওই ধরনের কিছুই নেই ওর সঙ্গে। হিংস্র জানোয়ারের আক্রমণ ঠেকাতে এই ডালটা কোনো কাজেই আসবে না। তথাপিও মনের জোরে এগিয়ে যাচ্ছে। তবে সাপখোপ তাড়াতে হলেও ডালটার প্রয়োজন আছে। যদিও এখনো জীবজন্তু বা সাপখোপ নজরে পড়েনি।

ধীরে ধীরে সামনে অগ্রসর হচ্ছে অর্পিতা। একসঙ্গে দুটি কাজ করছে। দ্বীপবাসীদের ডেরা-কুটির খোঁজার পাশাপাশি পানি আর ফলমূলের সন্ধানও করছে। বনের ভেতর উঁচু উঁচু গাছ-গাছালি থাকলেও এদিকে জঙ্গল তত দুর্ভেদ্য নয়। হাঁটতে তেমন সমস্যা হচ্ছে না। তবে অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকায় গা ছমছম করছে। এই বুঝি ভূতপ্রেত ঘাড় মটকে দিলো। অথবা হিংস্র জানোয়ার সামনে লাফিয়ে পড়ল। আবার মনে হচ্ছে বুঝি আদিবাসীরা ওকে দেখে ফেলছে। সেকথা মনে হতেই খুব সাবধানে পা ফেলছে অর্পিতা। হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর চলে এসেছে। আর কয়েক মিনিট হাঁটলেই সৈকতের মোড় শেষ। ওখান থেকে বনের অপরপ্রান্ত দিয়ে সরু একটা রাস্তা সোজা চলে গেছে। সাবধান হলো অর্পিতা। অনুমান করছে আশপাশেই আদিবাসীদের ডেরা-কুটির। আরও সামনে এগোতে হবে। পা কাঁপছে। ভাবছে নিজের বিপদ নিজেই ডেকে আনেনি তো! আসলে এতটা অনুসন্ধানী হওয়া ঠিক হয়নি। অবশ্য এছাড়া উপায়ও ছিল না। এমতাবস্থায় পেছনে না কি সামনে এগোবে সেটাই ভাবছে অর্পিতা। চলবে...

মানুষখেকোর দ্বীপ। পর্ব-১
মানুষখেকোর দ্বীপ। পর্ব-২
মানুষখেকোর দ্বীপ। পর্ব-৩
মানুষখেকোর দ্বীপ। পর্ব-৪
মানুষখেকোর দ্বীপ। পর্ব-৫

আলম শাইন: কথাসাহিত্যিক, পরিবেশ ও জলবায়ুবিষয়ক কলামিস্ট

বাংলাদেশ সময়: ০৯৫৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০২৩
এমজেএফ/আরএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।