ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

সমুত্থান | আলী আহসান

গল্প / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৪৪ ঘণ্টা, মার্চ ১৬, ২০১৫
সমুত্থান | আলী আহসান

আকাশ ভীষণ থমথমে হয়ে আছে। সম্ভবত প্রচণ্ড আক্রোশে বিধাতা কালো কালি দিয়ে মেঘগুলো আজ এঁকেছেন।

তবে এখান থেকে সারি সারি কালো মেঘগুলো দেখতে খুব ভালো লাগছে মিতার কাছে। খোলা বারান্দায় হালকা ঠাণ্ডা একটা বাতাস আসছে দূর থেকে। এত উঁচুতে বাতাসের স্পর্শটা অন্যরকম একটা অনুভূতি দেয়। মিতা এর আগে কখনও এত উঁচুতে ওঠেনি। ছোটবেলায় বাবা তাকে মাঝে মাঝে নিয়ে যেতেন একটা টিলার কাছে। সেই টিলার উপর উঠতে যেয়ে সবসময় বাবার হাত ধরে থাকত সে। খুব ভয় লাগত ওঠার সময় কিন্তু বাবার হাত ধরে টিলার উপর দাঁড়িয়ে থাকার সময় খুব আনন্দ লাগত। বাবা ওকে টিলার উপর দাঁড়িয়ে সূর্য ডুবে যাওয়া দেখাত। টকটকে লাল সূর্যটা খুব মন দিয়ে দেখত মিতা। তারপর বাবা ওর দুই হাতটা এমনভাবে ধরে দিতেন যেন ওর দুই হাতের উপর সূর্যটা বসে আছে। খিল খিল করে হাসত মিতা। কি যে আনন্দ লাগত সূর্যকে হাতের মুঠায় ধরে রাখতে। অসংখ্য স্মৃতির এলোমেলো রাস্তার ভেতর আজও মিতা সেই স্মৃতির পথটা ঠিকই খুঁজে পায় চোখ বন্ধ করে। জীবনে এর চেয়ে বড় সুখের স্মৃতি ওর নেই। হাত দিয়ে এলোমেলো চুলগুলো টেনে একটু পেছনে নিয়ে এলো মিতা।

বারান্দাটা অনেক লম্বা আর খোলামেলা। এদিকে কোনও ট্যুরিস্ট নেই, একদম সুনশান নীরবতা। নিচে একটু দূর দিয়ে হাসতে হাসতে চলে যাচ্ছে নাফ নদী। এখানে নদীটা অনেক ছোট, বারান্দা থেকেই দেখা যায় ওপারের ভিনদেশীদের। কালো মেঘগুলোর বুক চিরে বের হয়ে আসছে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। মৃদু হাওয়ায় নাচতে নাচতে বারান্দার কাছে এসে উঁকি দিয়ে মিতাকে একবার দেখে তারপর তারা হারিয়ে যাচ্ছে দূরে। খুব মজা লাগছে মিতার কাছে বৃষ্টির এই খেলা দেখতে। ঠিক যেমন ছোট বাচ্চারা উঁকি দিয়ে তার মা-কে একবার দেখে তারপর আবার খেলতে থাকে আর খিলখিল করে হাসে। এই বৃষ্টিও মিতাকে ঠিক ওইভাবে দেখছে আর খিলখিল করে হাসতে হাসতে আবার দূরে চলে যাচ্ছে। বাচ্চাটার কথা বার বার মনে হয়। বুকের ভেতরটা তখন নিমেষেই মুচড়ে ওঠে। বৃষ্টির এই খেলা দেখতে দেখতে কখন যে কয়েক ফোঁটা পানি ওর চিবুক বেয়ে নিচে এসে পড়েছে খেয়াল করেনি সে। চোখ মুছে গরম চায়ের মগটা টেনে নেয় মিতা।

প্রায় আট বছর হয়ে গেছে এই পৃথিবীতে মিতা একদম একা। নাফ নদীর পাড়ের এই নির্জনতার সাথে তার একাকীত্বের আশ্চর্য একটা মিল খুঁজে পায় সে। বাতাসের মৃদু সঙ্গীতে বাঁশির মত একটা সুর আছে। মনে হচ্ছে কে যেন খুব মন দিয়ে শিস দিয়ে গান গাইছে। মিতার জীবনের ভীষণ একাকীত্বের সাথে এই সুর দারুণ মিলে গেছে। সুমনের জন্য অপেক্ষার এই সময়টা অন্যরকম লাগছে মিতার কাছে। খুব বেশিদিন হয়নি সুমনকে সে চেনে। অথচ কী অবলীলায় চলে এসেছে ওর সাথে এতটা দূরে। এটা কি পাগলামী? কি জানি! প্রথম যেদিন সুমনের সাথে পরিচয় সেদিনের কথা খুব মনে আছে মিতার।

আজকাল ফেসবুকেই তার অনেকটা সময় চলে যায়। যদিও তেমন কিছুই করার থাকে না ফেসবুকে। কিন্তু সবার হাশিখুশি ছবিগুলো দেখতে ওর খুব ভালো লাগে। ও নিজে না হয় হাসতে ভুলে গেছে, কিন্তু ওরা তো হাসছে। এটাই মিতার সুখ। এক একটা ছবি কত রকম গল্প বলে। মন দিয়ে মিতা সবার মন্তব্যগুলো পড়ে। অবাক হয়ে অনুভব করে মানুষের ভিন্নতাগুলো। এক একটা মানুষ যেন এক একটা ভিন্ন দেশ। গানের প্রতি বরাবরই মিতার অন্যরকম একটা আকর্ষণ। কারও প্রোফাইলে গান পেলেই শুনবে সে। সুমনের সাথে পরিচয়টা এভাবেই। অদ্ভুত সুন্দর কিছু গান ছেলেটার প্রোফাইলে পেয়েছে মিতা। প্রাইভেসি সেটিং পাবলিক থাকার কারণে বন্ধু লিস্টে না এসেও গান শুনেছে সে দিনের পর দিন। আর প্রতিবারই অবাক হয়ে ভেবেছে এই যুগের হয়েও ছেলেটা সেই পুরনো দিনের মনকাড়া গানগুলো শুনছে।

কাঠের সিঁড়িতে পায়ের শব্দে মিতার ভাবনায় ছন্দপতন হলো। হাতে ক্যামেরা নিয়ে সুমন দাঁড়িয়ে আছে। এই বাংলোটা কাঠের দোতলা। উপরে মিতার থাকার ব্যবস্থা আর নিচের তলায় সুমন থাকছে। অদ্ভুত এক সম্পর্ক দুজনের মধ্যে। জাগতিক সম্পর্কের বাইরের কিছু? কিন্তু কী সেটা? সুমনকে যত দেখছে ততই অবাক হচ্ছে মিতা। নিজের ভাবনা থেকে ফিরে এসে মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে উঠে পড়ে ও। কাল রাতে এসেই যে যার মত ঘুমিয়ে পড়েছে। পথেও তেমন কথা হয়নি দুজনের। সুমন একটানা গাড়ি চালিয়েছে চুপ করেই। একের পর এক অসম্ভব সুন্দর কিছু গান বেজেছে ওর গাড়ির সিডি প্লেয়ারে। অজানা, অচেনা, তাও এত অল্প বয়স্ক একটা ছেলের সাথে চলে এসেছে হুট করে এতটা দূর। কিন্তু ভাবনাটা ওর একবারও বেশিক্ষণ থাকেনি। কেন সেটা ও নিজেও জানে না। শুধু জানে, কিছু একটা ভাঙতে হবে। চুরমার করে দিতে হবে তার অন্ধকারকে। কিভাবে চুরমার করতে হবে জানে না সে। যখনই হাতের কাছে কিছু পেয়েছে সেটা দিয়ে চেষ্টা করেছে কিন্তু আবার ফিরে গেছে অন্ধকারে। সুমনের প্রস্তাবটা পাবার পর অনুভব করেছে এই একটা সুযোগ সবকিছু চুরমার করে দেয়ার মত। অন্ধকারকে চুরমার করে দেয়ার। নিজের অজান্তেই নিয়মের বাইরের কিছু একটা করে ফেলার অদম্য এক নেশা অনুভব করেছে।

তৈরি হয়েই ছিল মিতা। আজ সে সবুজ শাড়িটা পরেছে। এটা তার খুব প্রিয় একটা শাড়ি। কপালে অনেক বড় একটা সবুজ টিপও পরেছে। বহুবছর পর এভাবে সেজেছে সে।   বরাবরই ওর ঘুম খুব ভোরে ভেঙে যায়। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আগে থেকে কী পরবে এমন কিছু ঠিক করেনি সে। অনেকটা নিজের অজান্তেই শাড়িটা পরেছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অনেক্ষণ নিজেকে খুঁটিয়ে দেখেছে সে। আনমনেই মৃদু একটু হাসি পায় ওর। কাল রাতেই ঠিক করে রেখেছিল আজ বাইরে কোথাও নাস্তা খেয়ে নেবে। এদিকে নাকি কয়েকটা ভালো পাহাড়ি রেস্টুরেন্ট আছে। দারুণ মজাদার নাস্তা পাওয়া যায় সেখানে। কিন্তু মেঘ, বৃষ্টি আর বাতাসের খেলা দেখে মনে হচ্ছে এখন বের হওয়া যাবে না। সুমন বলছিল পাহাড়ি বৃষ্টি আর মেঘ নাকি বেশিক্ষণ থাকে না। তাই ভাবছে, যতক্ষণ সূর্য দেখা না যায়, ততক্ষণ বরং বারান্দায় বসে গল্প করেই কাটিয়ে দেয়া যায়। এখানেই বেশ লাগছে।

সুমন! এখানে বসেই কিন্তু বেশ কাটিয়ে দেয়া যায় দিনটা। অন্তত যতক্ষণ বৃষ্টি আছে! তুমি কী বলো?

একটু ভেবে বাইরের কালো মেঘ আর ঝিরি ঝিরি বৃষ্টিকে দেখে নিয়ে সুমন মাথা নেড়ে সায় দিল। সুমন খুব কম কথা বলে। বেশিরভাগ প্রশ্নের উত্তর হু কিংবা মাথা নেড়ে দেয়। জ্বী, আপনি যা বলেন।

বাবুর্চিকে ডেকে নাস্তা বানাতে বলল মিতা। তার আগে দুই মগ চা পাঠিয়ে দিতে বলল।

সিঁড়ির কাছ থেকে সরে আসলো সুমন। তারপর কাঠের বারান্দার রেলিং ঘেঁষে দাঁড়াল। বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাইরের বৃষ্টি দেখল মুগ্ধ হয়ে। সকাল থেকেই ওর খুব ইচ্ছা হচ্ছে বিশেষ একটা গান শুনতে কিন্তু এখানে নেটওয়ার্ক খারাপ। ঘুম ভাঙার পর থেকেই গানটা মাথা খারাপ করে দিচ্ছে। সুমনের মস্তিষ্কের সমস্ত অণু পরমাণু একই সুর তোলপাড় করছে মাথার ভেতর কিন্তু গানটা শোনার উপায় নেই। অনেক চেষ্টা করেও মোবাইলে নেটওয়ার্ক পায়নি। ভেবেছিল গাড়িতে উঠেই গানটা ছাড়বে কিন্তু এখন মনে হচ্ছে অপেক্ষা করতে হবে গানটা শোনার জন্য। এমন সময়গুলোতে খুব অস্থির লাগে ওর।

সুমনকে চুপ করে থাকতে দেখে জানতে চাইল মিতা, কিছু ভাবছো সুমন?
একটা গান খুব বিরক্ত করছে। মাথার ভেতর গুনগুন করছে মৌমাছির মত কিন্তু এখন শোনার উপায় নেই। খুব অস্থির লাগছে, এটাই ভাবছিলাম।
ভাবার দরকার কী? ইউটিউব থেকে খুঁজে বের করে চালিয়ে দাও। আমিও শুনি। এই পরিবেশটা গান শোনার জন্য অন্যরকম সুন্দর।
হেসে ফেললো সুমন। গানটা ইউটিউবে আছে, কিন্তু এখানে নেটওয়ার্ক নেই। অনেক চেষ্টা করে মাঝে মাঝে নেটওয়ার্ক সামান্য পাওয়া যায় কিন্তু আবার হাওয়া হয়ে যায়। সম্ভবত সূর্যের মত সেও আড়াল নিয়ে আছে।
সুমনের হাসিটা খুব নিস্পাপ! যতবার দেখে ততবার মুগ্ধ হয় মিতা। একজন মানুষ কিভাবে এত নিস্পাপ হাসি দেয়? ওর ভীষণ ইচ্ছা হয় জানার। কিন্তু আপাতত মিতা জানতে চাইল, কোন গানটা শুনতে মন চাইছে তোমার?

কথা বলতে বলতে পাশাপাশি কয়েকটা বেতের চেয়ারের একদম কোণার একটায় গিয়ে বসেছে সুমন। এরই মধ্যে বাবুর্চি এসে গরম চা দিয়ে গেছে ওদের জন্য। সম্ভবত চুলায় গরম পানি আগে থেকেই ছিল। তা-না হলে এত তাড়াতাড়ি চা দেয়ার কথা না। চায়ের মগটাকে মনে হচ্ছে ধূমায়িত একরাশ উষ্ণ আনন্দ। সুমনের জীবনে মিতার উপস্থিতির মত, চায়ের দিকে তাকিয়ে সুমন ভাবছিল। মিতার কথায় বাস্তবে ফিরে এলো সে। তারপর নিজের অজান্তেই ভরাট গলায় গেয়ে উঠল,
যদি আবার জন্ম নেই বৃষ্টি হয়ে
ঝরব তোমার বুকে এসে
তোমাকেই যাব আমি ভালোবেসে।
যদি আবার জন্ম হয় আলো হয়ে
পড়ব তোমার মুখে হেসে  
তোমাকেই যাব আমি ভালোবেসে...

খুব সামান্য একটু সময়ের জন্য হলেও মিতার মনে হয়েছিল সুমন কথাগুলো ওকেই বলছে। কিন্তু পরক্ষণেই ওর ভুল বুঝতে পেরে একটু স্বস্তি পেল। গানের এই কয়েকটা লাইন গেয়েই থেমে গেল সুমন। বাহ! গানের কথাগুলো দারুণ তো! আর তোমার গলা এতো ভরাট আর সুন্দর!

আবার সেই নিস্পাপ হাসিটা ফিরিয়ে দিল সুমন। শুনেছেন এই গানটা আগে কোথাও?
অনেক আগে সম্ভবত শুনেছি, সুরটা পরিচিত মনে হচ্ছে কিন্তু কার গান এটা জানি না।
আনমনে মাথা নেড়ে সুমন বলল, এটা অজয় চক্রবর্তীর গান।

কিছুক্ষণের জন্য দুজনেই চুপ হয়ে গেল। শুধু বৃষ্টির ঝিরি ঝিরি গান আর সাথে বাতাসের শোঁ শোঁ বাঁশি। আচ্ছা সুমন! তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, বলতে যেয়েও থেমে গেল মিতা। মিতার মনে হলো অপার্থিব এক সুর এসে ভর করেছে সুমনের গলায়। ভরাট অথচ অপূর্ব রকম সুরেলা। কোথা থেকে পেল ছেলেটা এই কণ্ঠ? আগে কখনও বলেনি যে ও গাইতে পারে। আশ্চর্য এক মানুষ এই সুমন। যত দেখছে ওকে ততই অবাক হচ্ছে সে।
ঢেউ হয়ে আসি যদি দোলাবো তোমায়
সুর হলে দেব পাড়ি গানেরও খেয়ায়
যদি আবার জন্ম নেই বৃষ্টি হয়ে...
সম্ভবত বাতাসের সুর লজ্জা পেয়েছে সুমনের কণ্ঠ শুনে। সবকিছু মুহূর্তের জন্য মনে হলো থমকে গেল। এত ভালো লাগছে এই মুহূর্তকে মিতার কাছে! সুমনের গলা দিয়ে অপার্থিব সুরের ডানায় ভর করে গানের কথাগুলো এখন বারান্দায় ভাসছে। মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনছে মিতা। সুমনের গাওয়া থামতেই, মিতা জানতে চাইল ‘কোথা থেকে পেলে তুমি এত সুন্দর গলা? তুমি টিভিতে গাও না কেন? কার কাছে শিখেছো এত সুন্দর করে গাইতে?’

হেসে ফেললো সুমন। এতগুলো প্রশ্ন একসাথে? হেসে মাথা নেড়ে বলল সে অনেক কথা।
বলো, আমি শুনব। চায়ের মগ থেকে উষ্ণ চা গলায় ঢেলে জানতে চাইল মিতা।
আমার মা খুব সুন্দর গাইতে পারতেন। তিনিই আমাকে গান শেখান। কিন্তু বহুদিন আমি গাইনি।
পারতেন মানে কী? এখন পারেন না?
আমার মা অন্য ভুবনে চলে গেছেন। মনে হলো সুমনের কণ্ঠের আরও গভীর থেকে উঠে এলো কথাটা।
আমি সরি। না জেনেই প্রশ্নটা করে ফেলেছি। মিতা সত্যিই খুব লজ্জা পেল।
আপনার সাথে শেয়ার করতে পারি। আমার মা আত্মহত্যা করেছিলেন। কেন জানেন?

মিতা চুপ করে থাকল। কিছুই বলতে পারল না সুমনকে। ভাষা হারিয়ে শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল সে। ওর মনের  অলিতে গলিতে অসংখ্য কান্নার স্রোতের অস্তিত্ব টের পেল।

আমার বাবা খুব ভালো একজন মানুষ। মা কেন এমন করলেন, আমি ঠিক জানি না পুরো ব্যাপারটা। তাই সবটুকু হয়ত বলতে পারব না আপনাকে। শুধু জানুন, জীবনের দীর্ঘ একটা সময় আমার মা ভীষণ কষ্টে ছিলেন। অনেকেই বলেছে মা নাকি চাইলেই তার এই কষ্ট থেকে বের হতে পারেন। তিনি চেষ্টা করতেন কিন্তু পারেন নি। সবাই সবকিছু পারে না। সেই ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা সবাইকে হয়ত দেন নি। তারপর একসময় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন তিনি। আমি তখন মাত্র কলেজে ঢুকেছি। সেদিন স্যারের বাসায় পড়া ছিল। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। বাসায় ফিরে দেখি ঘর অন্ধকার। বাবা মূর্তির মতো বসে আছেন বসার ঘরে।

জানতে চাইলাম ঘর অন্ধকার কেন? মা কোথায়? তিনি কোনও উত্তর দিতে পারেন নি। ঘরের আলো জ্বালতেই দেখলাম বাবা ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে বসে আছেন। পাশের ঘরের দরজাটা খোলা। আলো যেয়ে পড়েছে বিছানার উপর। সামনে ভয়ঙ্কর দৃশ্য। বিছানায় পড়ে আছেন মা, তার সমস্ত মুখে সমুদ্রের ঢেউয়ের মত সাদা ধবধবে ফেনা।

কী বলবে মিতা? গায়ের সমস্ত লোম দাঁড়িয়ে গেল তার। মনে হলো সুমনের হাতটা ধরে, ওকে সান্ত্বনা দেয়। কিন্তু সমস্ত শক্তি মনে হলো চলে গেছে। বোকার মত শুধু তাঁকিয়ে থাকল সুমনের দিকে। চোখের সামনে দৃশ্যটা ভেসে উঠল ওর। মনে হলো কে যেন ওকে আবার অন্ধকার একটা ঘরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিচ্ছে। মিতা আবার ডুবে যাচ্ছে অন্ধকারের ভেতর। সেখানে কোনও তল নেই। শুধুই পতন আছে। সম্বিত ফিরল সুমনের কথায়।

জানেন! মা বাবা দুজনেই দুজনকে অসম্ভব ভালোবাসত। মা কেন এমন করলেন জানি না। কিন্তু টের পেতাম, কিছু ব্যাপারে বাবা মায়ের মধ্যে বিশাল এক সাগরের মত পার্থক্য। যেটা দিনে দিনে শুধুই বেড়েছে। এই দূরত্বই তার আত্মহত্যার কারণ ছিল কি-না জানি না। মাঝে মাঝে মাকে খুব স্বার্থপর মনে হয়। কিন্তু মা তো! তাই আবার ক্ষমা করে দেই। তিনি চেয়েছিলেন তার কষ্ট থেকে বের হতে, কিন্তু পারেননি। মা দীর্ঘদিন ধরে ভয়ঙ্কর বিষণ্নতায় ভুগছিলেন।

এই প্রথম সুমন এক নাগাড়ে এত কথা বলছে মিতার সাথে। এই গানটা মা খুব সুন্দর করে গাইতেন। আজ আপনাকে এখানে এই পরিবেশে পেয়ে খুব মনে পড়ল মায়ের কথা। আমি আমাদের যুগের ছেলেমেয়েদের সাথে মিশতে পারি না। এদের মনে আমি কোনও গভীরতা পাই না। ফেসবুকে যে আপনার মত একজনের সাথে পরিচয় হবে এটা কখনও ভাবিনি। আর এক কথায় এভাবে আমার প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাবেন এখানে আসতে এটা তো কল্পনাতীত!

মিতা মৃদু হেসে বলল, আমি নিজেও অবাক হয়েছি সুমন। তুমি যখন হঠাৎ করেই বললে যাবেন আমার সাথে টেকনাফের দিকে! আমি জানি তুমি এমনিই বলেছো। আমি রাজি হয়ে যাব তুমি ভাবোনি, তাই না?

একদমই না। আমি শুধু বলার জন্য বলেছিলাম আপনাকে। সম্ভবত আপনার মন ভালো করার জন্য বলা। আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না যে আপনি আমার সামনে বসে আছেন। বলেই হেসে ফেলল সুমন।

আসলে কী জানো? আমার বাচ্চাটা মারা যাওয়ার পর থেকে দিনের পর দিন আমি অন্ধকারের পথ হেঁটেছি। তোমাকে কখনও বলা হয়নি আমার সেই দিনগুলোর কথা। প্রতিটা দিন, রাত আমি পার করেছি অন্ধকার পথ। প্রতিটা মুহূর্ত আমার মনে হয়েছে চারিদিকে শুধু অন্ধকার। বারবার তলিয়ে গেছি সেই অন্ধকারে।   যারা প্যারাগ্লাইড করে আকাশ থেকে ঝাঁপ দিয়ে নিচে পড়ে ওদের কেমন লাগে আমি জানি না। কিন্তু আমার সবসময় মনে হতো আমি ঠিক ওই রকমভাবেই নিচে নামছি তো নামছি। চারিদিকে কিছুই নেই। কখন দিন আর রাত হয়েছে আমি জানি না সুমন। বারবার আমি সামান্য একটু আলো খুঁজেছি। কিন্তু পাইনি।

আপনি কি জানেন আমি আপনাকে এখানে কেন নিয়ে আসতে চেয়েছি?
না! আমি জানতে চাইনি তোমার কাছে। তুমিও বলোনি। আমার কাছে শুধু মনে হয়েছে একটা হাত আমার সামনে। অন্ধকার থেকে আমি সেই হাত ধরে উঠতে পারি।
আপনি যখন রাজি হয়ে গেলেন তখন খুব অবাক হয়েছিলাম। আমার এক বন্ধুর বাংলো এটা। আগে দুই একবার এখানে এসেছি। অনেক সময় একা থেকেও আরও অনেক একাকীত্বের কাছে চলে আসলে খুব হালকা লাগে নিজেকে। এটা সেইরকম একটা জায়গা। সুনশান নিরবতায় আপনার একাকীত্ব হারিয়ে যাবে।
বাহ! দারুণ বললে তো। আমি কখনও এভাবে ভাবিনি কিংবা বলতে পারো ভাবতে চেয়েছি কিন্তু পারিনি। সত্যি বলতে কি জীবনের কাছে আমার কিছুই আর চাওয়ার নেই। পিয়ন্তির বাবার সাথে আমার ছাড়াছাড়ি হয়েছে অনেক দিন হয়ে গেছে। আমার মত নিথর পাথরের সাথে বসবাস করবে কে বল? ধীরে ধীরে সবকিছু থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছি আমি। কিন্তু তুমি তোমার বয়সের ছেলেদের তুলনায় একদম অন্যরকম।

হেসে ফেলল সুমন। কেমন?
এই যে, আমাদের যুগে এসে বাস করছো! তোমার চিন্তা-ভাবনা অনেক সুন্দর। অনেক গুছিয়ে ভাবতে পারো তুমি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হচ্ছে তুমি চরিত্রবান একটা ছেলে। আজকালকার ছেলেদের ভেতর এই জিনিস নেই।
তাই মনে হয় আপনার? কি জানি, আমি এভাবে কখনও দেখিনি আমাদের যুগের ছেলেদেরকে।

তোমাকে একটা মজার কথা বলি। আমি আমার বন্ধুদের কারও প্রোফাইলে যদি কোথাও কোনও মন্তব্য করেছি কিংবা কিছুতে লাইক দিয়েছি, তাহলে কম করে হলেও দশ পনেরোটা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এসে হাজির হবে কয়েক সেকেন্ডের ভেতর। কী বিরক্তিকর বলো? কোনও বিষয়ে কারও সাথে কথা লেখালেখির মাধ্যমে আলাপচারিতা হলে একটা কথা থাকে, কিন্তু কোনও পূর্ব আলাপ ছাড়াই? এরপর থেকে আমি কোনও কিছুতে আর কিছু লিখি না।
হয়ত ঠিকই বলেছেন। সম্ভবত এরা ফেসবুকটা বন্ধু বানানোর যন্ত্র হিসাবে নেয়, এই জন্য অপব্যবহার করে? ফেসবুকটা মনে হয় এদের কাছে বন্ধু বানানোর যন্ত্র। আমি নিজেও বুঝি না।

ঠিক। এরপর থেকেই আমি কোনও কিছুতেই কিছু লিখতাম না, লাইক দিতাম না। কিন্তু প্রথমদিকে তোমার প্রোফাইলের গানগুলো শুনতাম আর প্রত্যেক গানেই কিছু না কিছু লিখতাম। এই বন্ধু অনুরোধের বন্যার হাত থেকে বাঁচার জন্য সেটাও বন্ধ করে দেই। তোমার কাছে স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, তোমার প্রোফাইলের গানগুলো আমাকে খুব টানত। কিন্তু তুমি কখনওই আমাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাওনি। এটাই আমার খুব ভালো লেগেছিল।

হেসে ফেলল সুমন। পাঠাতাম, কিন্তু খেয়াল করে দেখলাম আপনি শুধু আমার গান শুনতেই আসেন। আর গানের পোস্টগুলো আমি পাবলিক রাখি, যেন যে কেউ শুনতে পারে। এজন্য আর রিকোয়েস্ট পাঠাইনি।

মিতাও হেসে ফেলল। আসলে কী জানো? পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ থাকলে ফেসবুকটা অনেক আনন্দের। কিন্তু এটাই তো আজকাল পাই না। যে যার ইচ্ছা মত অন্যকে ছোট করে, গালিগালাজ করে স্টেটাস লিখছে, মন্তব্য করছে। আমি এদের একদমই বুঝি না।

বাবুর্চি এসে জানিয়ে গেল নাস্তা তৈরি হয়ে গেছে। মিতা তাকে জানালো বারান্দার টেবিলে নাস্তা দিয়ে যেতে। মাথা নেড়ে চলে গেল বাবুর্চি।

আজ একটা অন্যরকম দিন মিতার জন্য। পিয়ন্তির মৃত্যুর পর এই প্রথম জীবনে সে অন্যরকম একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কী হবে, হতে পারে, কে কী ভাববে, কোনও কিছুই তার মনে হয়নি। শুধু মনে হয়েছে তার অন্ধকার জীবন থেকে একবারের জন্য হলেও তাকে বের হতে হবে। সবকিছু ভাঙতে হবে তাকে। সুমন তার কাছে শুধুমাত্র সেই ভাঙনের একটা মাধ্যম।

বহুবছর পর সুমনের জন্যও আজ অন্যরকম একটা দিন। একজন মানুষ বিষণ্নতায় ভুগে আত্মহত্যা করতে পারে এটা একসময় তার কাছে হাস্যকর মনে হতো। মুক্তার কথা মনে হলো ওর। কলেজে পড়ার সময় মুক্তাকে নিয়ে সে নিজেই অনেক হাসাহাসি করেছে বন্ধুদের সাথে। একসময় মুক্তা কলেজে আসা বন্ধ করে দেয়। মুক্তার বাবা সরকারি চাকরি করেন। তাই ভেবেছে হয়ত অন্য শহরে চলে গেছে ওরা। কিন্তু ওর সমস্ত পৃথিবী ওলট পালট হয়ে গেছে শুধুমাত্র একটা ঘটনায়। তার জানা সবকিছু ভুল প্রমাণিত হয়েছে ওর মা আত্মহত্যা করার পর। এখন সে জানে বিষণ্নতা ব্যাপারটা কতটা ভয়ঙ্কর। মানুষের মনের অন্ধকার জগৎটা কেমন। মিতা নামের এই মানুষটা এমনই এক অন্ধকার মনের জগতে বসে থাকেন সারাক্ষণ। তার বন্ধু বান্ধব সবাই ভাবতেন চাইলেই তিনি বের হয়ে আসতে পারেন। কিন্তু সুমন জানে, এটা সহজ নয়। সে চায়নি ওর মায়ের মত আর কেউ ওই ভয়ঙ্কর মৃত্যু বেছে নিক। মিতাকে সে বুঝতে পারে। মিতার অন্ধকারময় জীবনে যদি সামান্য একটু আলো নিয়ে আসতে পারে, এতেই তার আনন্দ। তার মায়ের জন্য সে এমন কোনও আলো নিয়ে আসতে পারেনি।

ওরা দুজনেই জানে ওদের ভেতর অন্য কোনও সম্পর্ক নেই, হতে পারে না। এটা শুধুই মানবতার সম্পর্ক। একজন মানুষের অন্ধকার জীবনে এক টুকরা আলো। বহুবছর পর আজ মিতা পরিতৃপ্তির সাথে একটা দিন কাটাবে। টেবিলে বড় বড় গলদা চিংড়ি ভুনা, সাথে ধনে পাতা আর ছোট আলু দেয়া ঘন ডালের একটা ঝোল জাতীয় কিছু আর গরম পরোটা। বৃষ্টির ঝিরিঝিরি নৃত্য থেমে গেছে। বাতাসের বাঁশির সুরটাও বাজছে না এখন। মিতা শুধু জীবনের অন্যরকম সুন্দর একটা সুর শুনতে পাচ্ছে। এই সুর বাতাসের সুরের মত থেমে যাবে কিনা সে জানে না। শুধু জানে সে ভাঙতে পেরেছে। ভয়ঙ্কর অন্ধকার থেকে বের হতে পেরেছে। সে আজ মন খুলে হাসতে পারছে। তার আনন্দের অনুভুতিগুলো এখনও মরে যায়নি। টিলার উপর দাঁড়িয়ে বাবার হাত ধরে সূর্যোদয় দেখার আনন্দের মত মনে হচ্ছে ওর কাছে। এই মুহূর্তটা, চারিপাশের এই ছিমছাম সৌন্দর্য্য ওর কাছে সেই লাল টকটকে সূর্যের মত। মিতা এই আনন্দ মন ভরে উপভোগ করবে আজ।

মিতাকে হাসতে দেখে সুমন অবাক হলো। মিতা হাসছেন মন খুলে। কি অপূর্ব সেই হাসি। মানুষের হাসি এত মায়াবী হয়? মুগ্ধ হয়ে সুমন বলল, আপনার হাসিটা খুব সুন্দর। এভাবেই হাসবেন সারাজীবন। বাইরে তাকিয়ে দেখুন, আপনার হাসি দেখে কালো মেঘগুলো সরে গেছে। সূর্যের সাথে সাথে প্রকৃতিও এখন হাসছে।



বাংলাদেশ সময়: ১৩৪৫ ঘণ্টা, মার্চ ১৬, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।