জেমস আর্থার বাল্ডউইন (২ আগস্ট, ১৯২৪-পহেলা ডিসেম্বর, ১৯৮৭) একাধারে একজন আমেরিকান ছোট গল্পকার, ঔপন্যাসিক, প্রবন্ধকার, নাট্যকার, কবি এবং সমাজ সমালোচক। তার প্রবন্ধ সংগ্রহ ‘নোট অব আ নেটিভ সন’ (১৯৫৫)-এ তিনি বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়কার আমেরিকার পশ্চিমা সমাজে বিদ্যমান এবং তখনও আলোচিত হয়নি এমন সাম্প্রদায়িক, যৌন এবং নানা ধরনের শ্রেণী বিভেদ এবং এই সংক্রান্ত অনেক অপরিহার্য সমস্যা নিয়ে কথা বলেছেন।
বাল্ডউইনের উপন্যাস এবং নাটক সমূহে কৃষ্ণাঙ্গসহ সমকামী এবং উভকামী পুরুষদের মৌলিক ব্যক্তিগত অনেক প্রশ্ন এবং জটিল সব সামাজিক ও মানসিক পীড়ন এবং ন্যায়সঙ্গত চাওয়া পাওয়া কাহিনী হিসেবে চিত্রিত হয়েছে। একই সঙ্গে এধরনের ব্যক্তিত্বের গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নে বেশ কিছু আভ্যন্তরীণ বাঁধা বিঘ্নও বর্ণিত হয়েছে। সমকামীদের অধিকারের বিষয়টি আমেরিকা জুড়ে ব্যাপকভাবে সমর্থন পাবার আগেই এসম্পর্কে বল্ডউইন তার বিখ্যাত উপন্যাস, গিওভানি’স রুম (১৯৫৬) লেখেন, এটি তার দ্বিতীয় উপন্যাস। তার প্রথম উপন্যাস, গো টেল ইট ওন দ্য মাউন্টেইন, তার সবচেয়ে বিখ্যাত সাহিত্যকর্ম।
সনি’স ব্লুজ গল্পটি বল্ডউইনের সবচেয়ে বিখ্যাত এবং নির্বাচিত গল্পগুলির একটি। এটি ১৯৫৭ সালে প্রথম ছাপা হয়, পরে গোয়িং টু মিট দ্য ম্যান (১৯৬৫) গল্প সংগ্রহে ঠাঁই পায়। - অনুবাদক
তৃতীয় কিস্তি পড়তে ক্লিক করুন
দুদিন পর আমি বিয়ে করি, এবং এরপর চলে আসি। আর আমার মনের ভেতর তখন ভারি একটা বোঝা এবং বিশেষ ছুটিতে জাহাজে করে তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় বাড়ি ফেরার আগপর্যন্ত মায়ের কাছে দেয়া প্রতিশ্রুতিটা ভুলে থাকি। আর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পর, আমি আর সনি শূন্য রান্না ঘরটায় বসে থাকার সময়, ওর খোঁজ খবর নিতে চেষ্টা করি।
“তুমি কী করতে চাও?” আমি জিজ্ঞেস করি।
“আমি একজন মিউজিসিয়ান হতে চাই”—সে বলে।
এরই মধ্যে ওর গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন হয়ে যাওয়ায়, আমার দূরে থাকার সময়, জুক বক্সের তালে নেচে কে কোনটা বাজাচ্ছে এবং সেটা দিয়ে তারা আর কী করছে তার খোঁজ নিতে থাকে, আর আপনা থেকেই একটা ড্রাম সেট যোগাড় করে ফেলে।
“বলতে চাইছো, তুমি একজন ড্রামার হতে চাও?” কোনোভাবে আমার ভেতরে এমন একটা অনুভূতি কাজ করছিল অন্য কারো জন্য ড্রামার হওয়াটা ঠিক আছে তবে সেটা আমার ভাই সনির জন্য নয়।
“আমার মনে হয় না”—খুব গম্ভীরভাবে আমার দিকে তাকিয়ে, ও বলে, “যে কখনোই আমি ভালো ড্রামার হতে পারব। তবে আমার মনে হয় আমি একটা পিয়ানো বাজাতে পারব। ”
মিনিট খানেক ধরে ও রান্নাঘরে পায়চারি করে। ও আমার সমান লম্বা। সবে দাঁড়ি কামাতে শুরু করেছে। হঠাৎই আমার মনে হতে থাকে আমি আদৌ ওকে চিনি না।
ও টেবিলের সামনে এসে থামে এবং আমার সিগারেটের প্যাকেটটা তুলে নেয়। আমার দিকে উপহাসের দৃষ্টিতে তাকায়, সকৌতুক উপেক্ষার ভঙ্গিতে, একটা ঠোঁটে পুরে দেয়। “কিছু মনে করবে?”
“তুমি কি এরইমধ্যে ধূমপান শুরু করে দিয়েছো?”
ও সিগারেটটা ধরায় আর মাথা নেড়ে, ধোঁয়ার ভেতর দিয়ে আমাকে দেখতে থাকে। “আমি কেবল দেখতে চাইছি তোমার সামনে সিগারেট খাবার সাহস আমার আছে কিনা। ” দেঁতো হাসি হেসে ও ছাদ বরাবর বিশাল একটা ধোঁয়ার কুণ্ডুলি ছাড়ে। “কাজটা খুবই সোজা। ”
আমি সেটা অনুমোদন করি না। এতটা গুরুতরভাবে কখনোই আমি বড় ভাইয়ের ভূমিকা পালন করিনি, কখনোই এতটা বিরলভাবে, তাই সানির কাছে অন্য কিছু জানতে চাই। আমি এমন কিছু একটার উপস্থিতি টের পাচ্ছিলাম সেটা কিভাবে মোকাবেলা করতে হবে তা আমার জানা ছিল না, বুঝতে পারছিলাম না আমার কী করা উচিত। তাই খানিকটা ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করি: “তুমি কি ধরনের মিউজিসিয়ান হতে চাও?”
সে দাঁত বের করে হাসে। “তোমার ধারণা কত ধরনের হতে পারে?”
“একটু সিরিয়াস হও”—আমি বলি।
মাথাটা পেছনে ছুঁড়ে দিয়ে, সে হেসে ওঠে, এবং আমার দিকে চেয়ে থাকে।
“আমি সিরিয়াস। ”
“ঠিক আছে, তাহলে যীশুর দিব্যি, ছেলেমানুষী বন্ধ করো এবং একটা সিরিয়াস প্রশ্নের জবাব দাও। বলতে চাইছি, তুমি কি কনসার্ট পিয়ানিস্ট হতে চাও, তুমি কি ক্লাসিক্যাল মিউজিক করতে চাও নাকি সবই, নাকি—বা কোনটা তাহলে?” আমার কথা শেষ হবার অনেক আগে থেকেই ও আবারও হাসতে থাকে। “যীশুর দোহাই, সনি!”
ও ধাতস্থ হয়, তবে খানিকটা অবাধ্যের মতন। “আমি দুঃখিত। কিন্তু তোমাকে মনে হচ্ছে খুবই—ভীত!” এবং আবারও ও চুপ মেরে যায়।
“ভালো, তুমি হয়ত একে এখন মজা বলে মনে করতে পারো, সোনা, কিন্তু যখন এটা দিয়ে জীবন চালাতে হবে তখন এটাকে আদৌ ততটা মজার বলে মনে হবে না, আমাকে সেকথা বলতে দাও। ” আমি ক্ষেপে গিয়েছিলাম কারণ আমি জানতাম ও আমাকে নিয়ে হাসছে আর এটা জানতাম না কেন ও হাসছে।
“না”—ও বলে, এবার সে খুবই শান্ত, এবং ভীত, সম্ভবত, এই জন্য যে এরই মধ্যে ও আমাকে যথেষ্ট আঘাত দিয়ে ফেলেছে, “আমি ক্লাসিক্যাল পিয়ানিস্ট হতে চাই না। ওতে আমার কোনো আগ্রহ নেই। আমি বোঝাতে চাইছি”—ও থামে, শক্ত করে আমার দিকে তাকিয়ে, যেন ওর চোখ দুটা আমাকে তা বোঝাতে সাহায্য করছে, এবং এরপর অসহায়ের মতো ইশারা করে, যেন সম্ভবত তার হাত দুটা আমাকে বুঝতে সাহায্য করবে—“আমি বোঝাতে চাইছি, আমার এখনো অনেক কিছু শেখা বাকি, আর আমাকে সব কিছুই শিখতে হবে, তবে, আমি বোঝাতে চাইছি, আমি জ্যাজ বাজাতে চাই”—সে বলে।
ভালো, কথাটা আগের মতো অতটা ভারি বা বাস্তব বলে মনে হয় না, সন্ধ্যেবেলায় সনির মুখে যেমনটা শুনতে পেয়েছিলাম। আমি শুধু ওর দিকে তাকিয়ে থাকি আর খুব সম্ভবত তখন আমার ভ্রুযুগল সত্যি সত্যি কুঁচকে আসে। আমার মাথায় আসছিল না লোকেরা যখন ডান্স ফ্লোরে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে নাচবে তখন ও কেন ক্লাউনের মতো নাইটক্লাবের মঞ্চে সময় কাটাতে চাইছে। কোননা কোনোভাবে—এ কাজে ওকে অযোগ্য বলেই মনে হচ্ছিল। আমি আগে কখনোই এ নিয়ে ভাবিনি, এ কাজে ওকে কেউ বাধ্যও করেনি, তবে আমার মনে আছে একটা ক্লাসে সবসময় আমি জ্যাজ মিউজিসিয়ানদের রাখতাম যাকে ড্যাডি বলতেন, ‘সু সময়ের জনতা’।
“তুমি সিরিয়াস?”
“দোযখ, হ্যাঁ, আমি সিরিয়াস। ”
ওকে আগের যেকোন সময়ের চেয়ে বেশি অসহায়, বিরক্ত এবং আশাহত দেখায়।
আমি উপকারীর মতো, পরামর্শের ভঙ্গিতে বলি: “মানে—লুইস আমর্সস্টংয়ের মতো?” ওর চেহারাটা দেখতে এমন হয়ে আসে যেন আমি ওকে কষে একটা ঘুষি মেরেছি। “না, আমি সেরকম পুরাতন বাজে কারো কথা বলছি না। ”
“ভালো, দেখো, সনি, আমি দুঃখিত, পাগল হয়ে যেও না। আমি কোনো কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। এমন কারো নাম বলো—যাকে তুমি জানো, এমন একজন জ্যাজ মিউজিসিয়ান যাকে তুমি শ্রদ্ধা করো। ”
“বার্ড। ”
“কে ?”
“বার্ড ! চার্লি পার্কার! ওরা কি তোমাকে ছাইয়ের আর্মিতে কিছু শেখায়নি?”
আমি একটা সিগারেট ধরাই। আমি অবাক হই আর তারপর এটা বুঝতে পেরে খানিকটা মজাও পাই যে আমি তখন মৃদু কাঁপছিলাম। “আমি এর থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলাম”—আমি বলি। “আমাকে ধৈর্যের সঙ্গে বোঝাতে হবে। এবার বলো দেখি। এই পার্কার লোকটা কে?”
“তিনি বর্তমানের বিখ্যাত জ্যাজ মিউজিসিয়ানদের একজন”—চাপা ক্রোধে ফুসে উঠে সনি বলে, ওর হাতদুটো তখন পকেটে, আর আমার দিকে পেছন ফিরে ছিল। “বোধ হয় বিখ্যাত বলেই”—তেতো স্বরে আরো বলতে থাকে, “সম্ভবত তুমি কখনোই তার কথা শোননি। ”
“ঠিক আছে”—আমি বলি, “আমি মূর্খ। এই জন্য দুঃখ হচ্ছে। আমি বাইরে যাচ্ছি আর এখনই বিড়ালটার সব রেকর্ড কিনে আনছি, তাহলে হবে?”
“এতে আমার কিছু যাবে আসবে না”—সনি বলে, “তুমি কী শুনবে তাতে আমার কী। আমাকে বাধা দিতে এসো না। ”
আমি বুঝতে শুরু করি ওকে আগে কখনো এরচেয়ে বেশি বিচলিত দেখিনি। মনে অন্য একটা অংশ দিয়ে আমি ভাবছিলাম যে এমনটা আসলে বাচ্চা ছেলেদের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে আর তা খুব জোরে আঘাত হানার মতো গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি না, আমার মনে হয় না এটা জিজ্ঞেস করলে কোনো ক্ষতি হবে: “এতে কি অনেক সময় লাগবে না? তুমি কি এটা করে চলতে পারবে?”
ও আমার দিকে ফিরে এবং রান্না ঘরের টেবিলের ওপর, আধাআধি বসে, আধাআধি ঝুঁকে আসে। “সব কিছুতেই সময় লাগে”—ও বলে, “আর—আমি নিশ্চিত, এর সাহায্যে আমি খুব ভালোভাবেই চলতে পারব। তবে মনে হচ্ছে আমি তোমাকে বোঝাতে পারছি না যে এই একটা জিনিসই আমি করতে চাই। ”
“ঠিক আছে, সনি”—আমি নম্রভাবে বলি, “তুমি জানো সবাই যা করতে চায় সব সময় সেটা করতে পারে না—”
“না, আমার সেটা জানা নেই”—আমাকে অবাক করে সনি বলে ওঠে। “আমার মনে হয় সবাই যা চায় সেটাই তার করা উচিত, না হলে ওরা সবাই কেন বেঁচে আছে?”
“তোমাকে অনেক বড় হতে হবে”—আমি হতাশার সঙ্গে বলি, “এখন তোমার ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাববার সময়। ”
“আমি আমার ভবিষ্যৎ নিয়েই ভাবছি”—কঠোর স্বরে সনি বলে। “সব সময়ই আমি এটা নিয়ে ভাবি। ”
আমি এ নিয়ে কথা বলা বাদ দেই। সিদ্ধান্ত নেই, ও যদি মত না বদলায় তাহলে এ নিয়ে পরেও কথা বলা যাবে। “এই ফাঁকে”—আমি বলি, “তোমাকে স্কুল শেষ করতে হবে। ” আমরা এরই মধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছি ও ইসাবেল এবং তার আত্মীয় স্বজনদের কাছে গিয়ে থাকবে। আমি জানি এটা ওর জন্য খুব একটা ভালো ব্যবস্থা হবে না কারণ ইসাবেলের আত্মীয়েরা খানিকটা নাকউঁচু স্বভাবের এবং বিশেষত তাদের কেউই চায়নি ইসাবেল আমাকে বিয়ে করুক। তবে এছাড়া আর কী করা যেতে পারে সেটা আমার মাথায় আসছিল না। “এবং ইসাবেলের কাছে তোমাকে রেখে আসতে এখন আমাদের সেখানে যেতে হবে। ”
তারপর একটা দীর্ঘ নীরবতা নেমে আসে। ও রান্না ঘরের টেবিল থেকে উঠে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। “এটা একটা ভয়ানক চিন্তা। তুমি নিজেই সেটা জানো। ”
“এর চেয়ে ভালো কোন বুদ্ধি কি তোমার মাথায় আছে ?”
মিনিট খানেক ধরে ও রান্নাঘরে পায়চারি করে। ও আমার সমান লম্বা। সবে দাঁড়ি কামাতে শুরু করেছে। হঠাৎই আমার মনে হতে থাকে আমি আদৌ ওকে চিনি না।
ও টেবিলের সামনে এসে থামে এবং আমার সিগারেটের প্যাকেটটা তুলে নেয়। আমার দিকে উপহাসের দৃষ্টিতে তাকায়, সকৌতুক উপেক্ষার ভঙ্গিতে, একটা ঠোঁটে পুরে দেয়। “কিছু মনে করবে?”
“তুমি কি এরইমধ্যে ধূমপান শুরু করে দিয়েছো?”
ও সিগারেটটা ধরায় আর মাথা নেড়ে, ধোঁয়ার ভেতর দিয়ে আমাকে দেখতে থাকে। “আমি কেবল দেখতে চাইছি তোমার সামনে সিগারেট খাবার সাহস আমার আছে কিনা। ” দেঁতো হাসি হেসে ও ছাদ বরাবর বিশাল একটা ধোঁয়ার কুণ্ডুলি ছাড়ে। “কাজটা খুবই সোজা। ” ও আমার চেহারার দিকে তাকায়। “এবার, এসো। আমি বাজি ধরতে পারি তুমি আমার বয়সেই সিগারেট ধরেছিলে, সত্যি করে বলো। ”
আমি কিছুই বলিনি কিন্তু সত্যটা আমার চেহারাই বলে দিচ্ছিল, আর তাতেই ও হেসে ওঠে। কিন্তু ওর এবারের হাসিতে খুব আঁটসাঁট কেমন যেন একটা ভাব ছিল। “নিশ্চয়। আর আমি বাজি ধরতে পারি তুমি আমাকে পুরোপুরি অনুসরণ করোনি। ”
ও আমাকে খানিকটা ভয় পাইয়ে দিয়েছিল। “সে যাক”—আমি বলি। “আমরা এরই মধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছি তুমি ইসাবেলের কাছে যাবে এবং সেখানেই থাকবে। এখন হঠাৎ করে আবার কী হলো?”
“সিদ্ধান্তটা তুমি নিয়েছো”—ও যুক্তি দেখায়। “আমি কোনো সিদ্ধান্ত নেইনি। ”
ও আমার সামনে এসে থামে, স্টোভের দিকে ঝুঁকে, আলতো করে হাত ভাঁজ করে। “দেখো, ভাই। আমি আর হারলেমে থাকতে চাই না, সত্যিই চাই না। ” খুবই স্থির স্বরে কথাটা বলে। আমার দিকে তাকায়, তারপর আবারও জানালার দিকে যায়। ওর চোখে কিছু একটা ছিল যা আগে কখনোই দেখা হয়ে ওঠেনি, কোনো চিন্তাবিষ্টতা, ওর নিজস্ব কোনো দুশ্চিন্তা। ও একহাতের পেশী ঘষে। “এখান থেকে আমার চলে যাবার সময় হয়েছে। ”
“তুমি কোথায় যেতে চাও সনি?”
“আমি আর্মিতে যোগ দিতে চাই। বা নেভিতে। যেকোন একটা কিছু হলেই চলবে। আমি যদি বলি আমার যথেষ্ট বয়স হয়েছে, ওরা সবাই তাহলে আমার কথা বিশ্বাস করবে। ”
তখন নিজেকে পাগল বলে মনে হতে থাকে। খুব বেশি ভড়কে গিয়েছিলাম বলেই এমনটা মনে হচ্ছিল। “তোমার বোধবুদ্ধি লোপ পেয়েছে। আস্ত একটা বোকা, তুমি কেন আর্মিতে যেতে চাইছো?”
“এইমাত্রই তো তোমাকে বললাম। হারলেম থেকে বের হবার জন্য। ”
“সনি এখনো তুমি স্কুল শেষ করোনি। আর সত্যিই যদি তুমি একজন মিউজিসিয়ান হতে চাও, তাহলে কিভাবে আশা করতে পারো আর্মিতে গিয়ে সেটা শিখতে পারবে?”
ও আমার দিকে তাকায়, কথার ফাঁদে পড়ে ফুসতে থাকে। “কোন একটা উপায় নিশ্চয় হবে। কোনো না কোনোভাবে আমি কাজটা করতে পারব। যেভাবেই হোক, বেরিয়ে আসার পর আমি জি.আই. বিল অবশ্যই পাব। ”
“যদি আদৌ বেরিয়ে আসতে পারো। ” আমরা একে অপরের দিকে তাকাই। “সনি, দয়া করে একটু বুঝতে চেষ্টা করো। আমি জানি পরিস্থিতি মোটেই অনুকূল নয়। তবে আমারা আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করব। ”
“স্কুলে আমি কিছুই শিখব না”—সে বলে। “এমনকি যখন সেখানে যেতাম তখনও। ” সে আমার কাছ থেকে সরে যায় এবং জানালাটা খোলে আর সিগারেটটা সরু গলির দিকে ছুঁড়ে মারে। আমি ওর পেছনটা দেখি। “অন্তত, আমি কিছু না শিখলেও, তুমি আমাকে শেখাতে চাইছো। ” সে জানালাটা এতটাই সজোরে বন্ধ করে যে আমার মনে হচ্ছিল ওর কাচগুলো উড়ে এসে আমার গায়ে পড়বে। “আর আমি এইসব কটু গন্ধওয়ালা ময়লা ক্যানের কারণে অসুস্থ !”
“সনি”—আমি বলি, “আমি জানি তোমার কেমন লাগছে। তবে এখনই যদি স্কুল শেষ না করো তাহলে ভবিষ্যতে এর জন্য তোমাকে দুঃখ পেতে হবে। ” আমি ওর কাঁধ আঁকড়ে ধরি। “আর তুমি কেবল আরো একটা বছর পাবে। এটা খুব একটা খারাপ হবে না। আর আমি ফিরে আসছি আর দিব্যি দিয়ে বলছি তুমি যা করতে চাও তার জন্য তোমাকে সাহায্য করব। কেবল আমার ফিরে আসা পর্যন্ত লেগে থাকতে চেষ্টা করো। দয়া করে তুমি কি সেটা করবে? আমার জন্যে?”
সে এর কোনো জবাব দেয় না আর আমার দিকেও তাকায় না।
“সনি। তুমি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছো?”
ও সরে যায়। “আমি তোমার কথা শুনেছি। কিন্তু আমার কোনো কথা তুমি কখনোই শোননি। ”
এর জবাবে কী বলতে হবে আমার জানা ছিল না। সে জানালার বাইরে তাকায় এবং তারপর আমার দিকে। “ঠিক আছে”—কথাটা বলে ও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। “আমি চেষ্টা করব। ”
তারপর ওকে সামান্য উৎসাহ দিতে, আমি বলি, “ইসাবেলের ওখানে ওদের একটা পিয়ানো আছে। তুমি সেটাতে চর্চা করতে পারবে। ”
আর সত্যি সত্যি কথাটা ওকে কয়েক মিনিটের মধ্যেই উল্লাসিত করে।
“ঠিকই তো”—ও বলে, নিজেকে বলে। আমি তো এটা ভুলেই গিয়েছিলাম। ” ওর চেহারা খানিকটা শিথিল হয়। কিন্তু সেখানে তখনও চিন্তা খেলা করছিল, যেভাবে আগুনের সামনে তাতে আলো ছায়া খেলা করে।
কিন্তু আমি ভেবেছিলাম ওর পিয়ানো বাজাবার কথা কখনোই শুনতে পাব না। প্রথম দিকে, ইসাবেল আমাকে লিখে, জানায় সনি তার মিউজিক নিয়ে কতটা একনিষ্ঠ আর কত আগেভাগে সে স্কুল থেকে চলে আসে, বা স্কুলের সময়টাতে আর যেখানেই থাকুক না কেন বাড়ি ফিরে এসে সোজা পিয়ানোর সামনে গিয়ে বসে আর রাতের খাবার সময় হবার আগ পর্যন্ত সেখানে থাকে। আর, রাতের খাবারের পর, আবারও সে পিয়ানোর কাছে ফিরে যায় তারপর সবাই বিছানায় যাওয়া পর্যন্ত সেখানে থাকে। শনিবার আর রোববার সারাদিন সে পিয়ানোর কাছে থাকে। তারপর সে একটা রেকর্ড প্লেয়ার কিনে এনে সেটাতে গান শুনতে শুরু করে। সে একটা রেকর্ডই বারবার শুনতে থাকে, কখনো কখনো দিনভর, আর পিয়ানোতে সেই সুরটা তোলে। অথবা সে রেকর্ডের কর্ড, বাঁক, বা ধীর লয়ের কোনো একটা অংশ বাজায়, তারপর সেটা পিয়ানোতে তোলে। তারপর আবারও রেকর্ডে ফিরে যায়। তারপর পিয়ানোতে।
ভালো, তবে আমি জানি না ওরা সবাই ব্যাপারটাকে কিভাবে নিচ্ছে। শেষে ইসাবেল স্বীকার করে এটা আসলে কারো সঙ্গে থাকা নয় বরং শব্দের সঙ্গে বসবাস করা। আর ওর কাছে এইসব শব্দের কোনো মানে নেই, ওদের কারো কাছেই—স্বভাবতই। তাই ওদের বাড়িতে থাকা সেই উপস্থিতি ওদের বড় বেশি যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। হতে পারে সনি কোনো দেবতা বা দানব। সে এমন একটা পরিবেশে গিয়েছে, যা তার সঙ্গে আদৌ খাপ খায় না। ওরা তাকে খাওয়ায়, আর সে খায়, নিজে থেকেই গোসল করে, ওদের দরজা দিয়ে হেঁটে বেরিয়ে আসে আবার ভেতরে ঢোকে; অবশ্যই সে মোটেই নোংরা, অস্বস্তিকর বা অভদ্র নয়, সনি এসবের কোনোটাই নয়; তবে সে কোনো একটা ধোঁয়াশা, কোনো একটা আগুনের পরতে মোড়া, এই দৃষ্টিভঙ্গির পুরোটাই তার নিজস্ব; আর তার কাছে পৌঁছাবার কোনো পথই কারো জন্যে খোলা ছিল না।
সেই সঙ্গে তখনও সে প্রাপ্ত বয়স্ক হয়ে ওঠেনি, তখনও সে একটা শিশু, এবং ওরা তার জন্য সব ধরনের উপায় খুঁজে বেড়াতে থাকে। অবশ্যই ওরা তাকে ছুড়ে ফেলে দিতে পারে না। এমনকি ওরা পিয়ানোর বোদ্ধাও হয়ে উঠতে পারে না কারণ এ ব্যাপারে ওদের জ্ঞানের পরিসর খুবই সীমিত, যেমনটা হাজার মাইল দূর থেকে, আমি বুঝতে পারছিলাম, যে সনি তার জীবনের খাতিরেই সেই পিয়ানোটা বাজাচ্ছিল।
কিন্তু সে স্কুলে যেত না। একদিন স্কুল বোর্ড থেকে একটা চিঠি আসে আর ইসাবেলের মা সেটা পায়—ওরকম আরো বেশ কয়েকটা চিঠি এর আগেও এসেছিল, যার সবগুলোই সনি ছিঁড়ে ফেলে। সেদিন, সনি যখন বাড়ি ফিরে আসে, ইসাবেলের মা তাকে চিঠিটা দেখায় এবং জিজ্ঞেস করে সারা দিন সে কোথায় থাকে। এবং সবশেষে তিনি জানতে পারেন সে গ্রিনউইজ ভিলেজে গিয়ে শ্বেতাঙ্গ একটা মেয়ের ফ্ল্যাটে, মিউজিসিয়ান এবং অন্যান্যদের সঙ্গে সময় কাটায়। এবং এটা তাকে আতঙ্কিত করে আর তাতে করে তিনি ওর সঙ্গে চিৎকার চেঁচামেচি করতে শুরু করে দেন আর এর ফলে, একসময়—যদিও সেদিন থেকে তিনি তা মানতে অস্বীকার করেন—সনির জন্য তারা যে ত্যাগ স্বীকার করে তাকে একটা উপযুক্ত ঘর উপহার দিলেও সে মোটেই তা বুঝে উঠতে পারেনি।
পঞ্চম কিস্তি পড়তে ক্লিক করুন
বাংলাদেশ সময়: ১৬৪৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ৭, ২০১৫
শিল্প-সাহিত্য
সনির ব্লুজ (৪) | জেমস আর্থার বাল্ডউইন | অনুবাদ: সোহরাব সুমন
অনুবাদ গল্প ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।