ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

আনন্দকাহিনী | আবু তাহের সরফরাজ

গল্প ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৩১ ঘণ্টা, অক্টোবর ২০, ২০১৫
আনন্দকাহিনী | আবু তাহের সরফরাজ

রোদ আর ছায়ার ঝিলমিল রঙে ঘেরা একটি ঘর।

জীর্ণ, তবু তা আছে।

ভেঙে এখনো পড়েনি। চৌকির ওপর স্থির বসে থেকে এই ঘরের সংসারী পুরুষ হঠাৎ শোনে, কোথায় যেন ডাকছে ঘুঘু। তার পরপরই কাঠঠোকরা, এবং দোয়েল। এবং ইষ্টিকুটুম। সংসারী দেখল, পাখির ডাক কী রকম যেন ঝলমল ঢেউ তুলে বাতাসে ভেসে যাচ্ছে।

তার ভালো লাগল।

আনন্দ নানা রঙের ঘূর্ণি তুলে নাচতে আরম্ভ করল তার ভেতর। সে ভেসে গেল রঙের ঘূর্ণির সঙ্গে। যেতে যেতে দেখল, খয়েরি রঙের একটি বৃদ্ধ পাতা ঝরে পড়ছে। সে বুঝতে পারল, আজ এই বাঁশপাতার মৃত্যুদিন। সে আরো বুঝতে পারল, পৃথিবীর মৃতপাতাদের মৃত্যুদিন কেউ লিখে রাখে না। মানুষ লিখে রাখে মৃত্যুদিনের আগের মুহূর্তে মৃত্যুদিনের খসড়া। কেবল নিজের, আর কোনো কিছুর নয়। কোনো প্রাণীর নয়।

একটি দীর্ঘশ্বাস চাপা পড়ে গেল তার বুকের ভেতর। বিড়বিড় করে উঠল সে, সবুজ যে উপায়ে খয়েরি হয়ে যায় জীবনও সে উপায়ে মৃত্যু হয়ে যায়।



এই শরীর তবে সে।
তার বউয়ের যে শরীর আছে তা তবে তার।
ছায়াবীথির যে শরীর, তা আসলে ছায়াবীথির।
প্রত্যেক মানুষের যে শরীর আছে তা প্রত্যেক মানুষেরই। শরীর আলাদা তো হৃদয় আলাদা। অনুভূতি আলাদা। একটা মানুষ ভাবল, প্রাণে প্রাণ তাই মেলে না।
খুব নিমগ্ন এখন দুপুর।



ঘরের কোথাও ডেকে উঠল টিকটিকি। তারপর কোনো এক পাখির ডাক। এখানে এত যে পাখি, যেন পাখির সংসার তার। ভাবল একটা মানুষ। পাখির সংসার তার, বেশ তো কথাটা। সে, তার বউ আর ছায়াবীথি। এই নিয়ে তার পাখির সংসার। পাখির ডানায় মমতার যে প্রলেপ থাকে, তার সংসার ঘিরে সে রকম কিছু একটা আছে।

কখনো কখনো তার এ রকম মনে হয়। আর মনে হয়, ছায়াবীথি একটা ফুলের নাম। স্নিগ্ধ আর মায়াবী আবরণ ঘেরা একটি ফুল।

ছায়াবীথি একটা প্রজাপতি। কী যে আশ্চর্য সুন্দর ছায়াবীথির হাসি, মানুষটা মুগ্ধ হয়। যতবার দেখে ততবার ভালোলাগা কী একটা অনুভূতি তাকে মুগ্ধ করে রাখে। ছায়াবীথি যখন আধো আধো উচ্চারণে কথা বলে ওঠে, মনে হয় যেন, তার উচ্চারিত প্রতিটি কথাই এক একটি দৃশ্য। ছায়াবীথির হাসি দৃশ্যগুলোতে রঙ ছড়িয়ে দেয়, আর এভাবেই সংসারী মানুষের চোখের সামনে একটি দৃশ্য তৈরি হয়ে যায়।

সংসারী পুরুষ হাতে তুলে নেয় একটি আয়না। কবে যেন হাত থেকে পড়ে ভেঙে গেছিল, তা আর মনেও পড়ে না। ভেঙে যাওয়া আয়নার অর্ধেকের কম একটি অংশ তার হাতে।

সংসারী পুরুষ দেখতে থাকে তার মুখ।

একটি শরীর তার। এক রকম আকৃতি আছে, যা মানুষের। এই যে নাক, ঠোঁট, চোখ, চোখের ওপর কপাল, এসব মিলিয়ে তার মুখ, এই মুখের এক রকম ভাষা আছে। ইঙ্গিত আছে।

এই শরীর তবে সে।

তার বউয়ের যে শরীর আছে তা তবে তার।

ছায়াবীথির যে শরীর, তা আসলে ছায়াবীথির।

প্রত্যেক মানুষের যে শরীর আছে তা প্রত্যেক মানুষেরই। শরীর আলাদা তো হৃদয় আলাদা। অনুভূতি আলাদা। একটা মানুষ ভাবল, প্রাণে প্রাণ তাই মেলে না।

খুব নিমগ্ন এখন দুপুর।

তার ভেতর কড়কড়ে স্নিগ্ধ রোদ। ঝিঁঝিপোকার বিরামহীন ডাক, পাখির শিস, গাছের সবুজ পাতায় হাওয়া লেগে মৃদু ঢেউ নিয়ে পাতাদের দুলে ওঠা, ঘাস আর নানা রঙের ফুলের জগতে ডানা ছড়িয়ে উড়ে বেড়ানো প্রজাপতির নিজস্ব পর্যটন, এরকম, এরকম আরো আরো দৃশ্য, রঙ, আর শব্দ নিয়ে দুপুর আছে তার নিজের ভ্রমণে।

নির্জন দুপুর এইখানে স্তব্ধ হয়ে থাকে। এবং ঝিমোয়। তন্দ্রার মতো গভীর আলস্যে একটা মানুষ ঝিমোয়। তারা দুজন। দুপুর আর সংসারী এক মানুষ। এই সম্পর্কে দুজনের মধ্যে গভীরতর এক সাঁকো আছে। নীরবতার গভীরতর বোধ হচ্ছে এই সাঁকো। একটা মানুষ বসে থাকতে থাকতে সাঁকো পেরিয়ে চলে গেল। দুপুর খরচোখে হাসল তাকে দেখতে পেয়ে।

মানুষটা থমকাল।

দুপুর গম্ভীর।

একটা মানুষ দেখল, তাপীয় বাষ্পের একটি আবরণ দুপুরকে ঘিরে। আর তার ভেতর রঙের সে এক অভাবিত জগত। নদী আছে। গাছপালা আছে। পাখি আছে। নদীতে মোহন সুন্দর রোদ এসে পড়েছে। চিকচিক করছে নদীর জল। একটি মাছরাঙা জলের দিকে মুখ নামিয়ে চেয়ে আছে খুঁটির ওপর বসে। ঝিরঝির হাওয়া বয়ে যাচ্ছে গাছপালার ওপর। পাতা কাঁপছে।

আর, কত কত শব্দ একটা দুপুরের ভেতর।

একটা মানুষ বলল, আমি আমার জগৎ থেকে তোমার জগতে যোগাযোগ ঘটিয়েছি। আমি নিশ্চিত, তুমি চেয়েছিলে বলেই আমি ঘটাতে পেরেছি।

দুপুর যেন মেনে নিল, এ রকম ভঙ্গিতে হাসল। তারপর বলল, হ্যাঁ। মানুষের জগত আমাকে কী রকম যেন টানত। সেই টানটাই বুঝি ছুটে গেছে তোমার দিকে। এবং তোমাকে নিয়ে আবার ফিরে এসেছে আমার কাছে। বেশ তো তবে, এসো...

তারপর সখ্য হলো দুজনের।

কথা বলল। অনেক অনেক কথা। গোপন কথা। প্রকাশ্য কথা। কথা বলতে বলতে একসময় একটা মানুষ বলল, চলো গোধূলি দেখে আসি।

দুপুর থমকাল।

একটা মানুষ বলল, তোমাকে সঙ্গে নিয়েই আমি গোধূলি দেখতে চাই।

দুপুর জানতে চাইল, কেন?

যেহেতু এই মুহূর্তে আমার আর তোমার সৌন্দর্যের একটা জগত তৈরি হয়ে গেছে। আমরা মিলে গেছি প্রাণে প্রাণে।

দুপুর বলল, কিন্তু বিকেল টপকে কি আমি যেতে পারব গোধূলির কাছে।

বেশ তো, তবে যোগাযোগ ঘটাও বিকেলের সঙ্গে।

সে কী আর ঘটালেই ঘটানো যায়! যেভাবে ঘটে গেল তোমার আর আমার মধ্যে। বলেই হাসল দুপুর।

একটা মানুষ তার জীবনে কতবার চেয়েছে তার প্রাণে মিলে যাওয়া প্রাণকে নিয়ে গোধূলি দেখতে যাবে। প্রাণে প্রাণ বুঝি তাহলে মেলে না। কাতর হলো একটা মানুষের আত্মা। জখম হলো।

যন্ত্রণার রেখা নানা ভঙ্গিতে ভেসে উঠল তার মুখে। সে তাকালো দুপুরের দিকে। চোখে জলজ মেঘ। দুপুর চেয়ে রইল তার দিকে বেশ কিছু সময়। তারপর বলল, চলো তবে... দেখাই যাক কতটা পথ পেরোলে তাকে পথিক বলা যায়।

শঙ্খের আনন্দঢেউ বুঝি কেউ ছড়িয়ে দিল একটা মানুষের বুকে।

তারা দুজন, একটা মানুষ আর দুপুর যাচ্ছে গোধূলি দেখতে। যেতে যেতে পথে, সামনে পড়ল নদী। নদীর স্বচ্ছ জলে একটা মানুষ চমকে উঠে দেখল, বিকেলের করমচা রঙের রোদ টলটল করছে।

আতঙ্কিত স্বরে একটা মানুষ ডেকে উঠল, দুপুর?

নিরুত্তর।

দুপুর?

শব্দহীন।

একটা মানুষ এবার প্রদীপের শেষ নিশ্বাসের মতো বলে উঠল, দুপুর তুমি কোথায়... য়... য়...

একটা ঢেউ হাহাকার ছড়িয়ে দিয়ে ছুটে গেল দিগন্তে। দুপুর কোথাও নেই। তবু কোথাও আছে যেন মৃন্ময়ী দুপুর। মানুষটার ভেতর কাতরতা। মানুষটার ভেতর হাহাকার। শরীর যেন ভেঙে আসতে চাইছে তার। কাঁপছে হাতপা।

কী রকম নিঃসঙ্গতা, মৃতের মতো নিঃসীম নিঃসঙ্গতা তাকে স্থির থেকে স্থিরতর করে তোলে। যেন সে পাথর। ভার আছে, প্রাণ নেই। তবে মন্ত্রচালিতের মতো সে হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে একটা মানুষ ফিরে আসে সংসারে। তার বউ চুল বাঁধছিল বসে মাটির দাওয়ায়। দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে হাসল তার দিকে চোখ রেখে।

একটা মানুষ বলল, তেষ্টা পেয়েছে। একটু জল দাও।

বউ কথা বলল না। তবে আবারও হাসল কী রকম যেন চোখে।

একটা মানুষ বসল এসে বউয়ের কাছে। বিস্ময়ে থ হয়ে সে দেখল, একটা দুপুরের ভেতর থেকে তার বউ একটা একটা করে নদীফুলপাখি লতাপাতাঘাস আলাদা আলাদা করে ফেলছে।

একটা মানুষ ঝিমোতে থাকে। কাঁপতে থাকে তার পৃথিবী।

অসাড় হয়ে যায় শরীর। আর সে তন্দ্রার মতো দুলতে দুলতে ভাবতে থাকে তার বউ মায়াবিনী কিনা। সে তো জানে নারী, কিন্তু এবার তাকে জানতে হবে মায়াবিনী কিনা। ঢুলতে থাকে একটা মানুষ। অতলান্তিক অন্ধকার থেকে যেন সে উচ্চারণ করল, তুমি কি মায়াবিনী?

কথা নেই, তবে খিলখিল হাসির ধ্বনি মুখর হয়ে ওঠে চারদিকে।

তুমি কি রিপা আক্তার?

কথা নেই। হাসি নেই। নীরবতা।

একটা মানুষ নীরবতার ভাষা বুঝতে পারল। এবং বুঝতে পারল, এইবার তাকে ঘুমিয়ে পড়তে হবে। এই শূন্যতায়, এই হু হু হাওয়ায়, শরীর ফুরফুরে হয়ে যাওয়া শূন্যতায়।

তবু, ঘুমিয়ে পড়ার আগে একটা মানুষ ষড়যন্ত্রমূলক স্বরে জিগেশ করল, তোমাকে আমি চিনতে পারছি না কেন?

মায়াবিনী বলল, মায়ার ইন্দ্রজালে যে মানুষ থাকে তাকে চেনার চোখ কী জগত-সংসারে কারো থাকে? থাকে না বলেই তো মায়াবিনী হয়ে ওঠে প্রতিটি নারী। মায়াবী হয়ে ওঠে প্রতিটি পুরুষ।

হঠাৎ সংসারী এক পুরুষ দেখতে পায় একটা সেতু। ঝুলন্ত সেতু, যেন শূন্যের ওপর দুলছে। আর তার একদিকে গোধূলির রঙ ছড়িয়ে ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে সূর্য। কত কত যে পাখি সেই সেতুর ওপর, কেবলই কিচিরমিচির শব্দে ভরিয়ে দিচ্ছে তারা শূন্যতা। সেতুর নিচে তিরতির বয়ে যাওয়া ছিপছিপে নদী। টলটলে সিঁদুররঙা তার জল।

ধীরে ধীরে একটা মানুষ পৌঁছে গেল সেতুর ছবির জগতে। রঙচক্রে দীর্ঘ পর্যটন শেষে ফিরে এলো আবার ঘর-গেরস্তে। তার বউ সেতুর নিচে বয়ে যাওয়া টলটলে নদীর ঢেউ শরীরে নিয়ে চুমু খেল তাকে। আর বলল, আমি তোমার জন্যে, কেবলই তোমার স্মৃতি বাঁচিয়ে রেখে অপেক্ষায় আছি।

একটা মানুষ জিগেশ করল, কতকাল বসে আছো তুমি এইভাবে?

তার বউ বলল, দীর্ঘ বছর। পাঁচ বছর হতে পারে। হতে পারে দশ বছর।

একটা মানুষ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, কারো কারো জীবন থেকে সারা জীবনও পেরিয়ে যেতে পারে। তারপর সে এসে বসল ঘরের দাওয়ায়। শেষ বিকেলের সিঁদুররঙা কোমল রোদ ছড়িয়ে আছে তখন তার পায়ের কাছে। তার বউ ছিল উঠোনে দাঁড়িয়ে। হাসছিল। হঠাৎ একটা মানুষ দেখল, তার বউয়ের হাসি থেকে কী রকম যেন রহস্য ছড়িয়ে পড়ছে শেষ বিকেলের নরম রোদের পৃথিবীতে। কেঁপে উঠল সে, এবং কাঁপতে কাঁপতে জিগেশ করল, তোমার শরীরে এই দীর্ঘ বছরে আর কার কার স্মৃতি তুমি বাঁচিয়ে রেখেছো বউ?

তার বউ হাসতে থাকে।

একটা মানুষ আবার জিগেশ করল, তোমার হৃদয়ে এই দীর্ঘ বছরে আর কার কার স্মৃতি তুমি বাঁচিয়ে রেখেছো রিপা আক্তার?

রিপা আক্তার কথা বলে না। গোপন যন্ত্রণার ভেতর থেকে একটা মানুষ উচ্চারণ করে, উহ্।
রিপা আক্তার বলল, শরীর সম্ভোগের অনুভূতি প্রাণীমাত্রই এ রকম তীব্র যে, তা প্রাণীর চাহিদা। আমি তিনটে পুরুষের শরীর সম্ভোগ করেছি এই দীর্ঘ বছরে।

ঝিমোতে থাকে একটা মানুষ। ঘুম ঘুম পাচ্ছে। ভাঙন হচ্ছে কোথাও। ভাঙনের শব্দ হচ্ছে। বিস্ফোরক শব্দ। শব্দের ভেতর আলাদাভাবে একটা মানুষ শুনতে পেল, তার বউ বলছে, তিনটে সম্ভোগের স্মৃতি আমি তোমার জন্যে লিখে রেখেছি। এই নাও।

ঘুম ঘুম চোখে ঘুমের ঢেউয়ে দুলতে দুলতে একটা মানুষ তখন ডুবতে আরম্ভ করেছে।

তারপর অন্ধকার।

অন্ধকারে নানা রঙের ছায়াশরীর।

অন্ধকারে নানা রঙের আলাদা আলাদা সৌন্দর্য।

রঙের নানা রকম আঁকিবুঁকি অন্ধকারে ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হয়। আলোর রেখা ছায়ার শরীর হয়ে ওঠে। এই আরেক জগত।

শব্দ ওঠে। মিহি শব্দ। ভারী শব্দ। ছায়াশরীরের চিৎকার। ফিসফাস কথাবার্তা। সে শুনতে পায়, খুব মৃদু শব্দের ঢেউ তুলে পাঠকাঠির বেড়া কাটছে উঁইপোকা। সে শুনতে পায়, একটি তক্ষক পাখির ডাক। সে দেখতে পায়, রিপা আক্তারের ছায়াশরীর ঘুরতে ঘুরতে মিলিয়ে যাচ্ছে শূন্যে। এই দৃশ্য তার বুকের ভেতর হাহাকার ছড়িয়ে দেয়।

দৃশ্য এবং শব্দের ভেতর দিয়ে যেতে থাকে একটা মানুষ। যেতে যেতে সে এসে দাঁড়ায় একটা পাহাড়ের পাদদেশে। বিস্ময়ে তার নিশ্বাস থমকে যায় বুকের মধ্যে। বিচিত্র রঙের নানা পাখি এই পাহাড় ঘিরে। পাহাড় যে, বোঝাই যায় না। যেন পাখির পাহাড়। ছোট ছোট সব পাখি। নানা রকমের রঙ শরীরে। পাহাড় ঘিরে ওড়াউড়ি করছে তারা। হেঁটে বেড়াচ্ছে পাদদেশে। তার পায়ের কাছ দিয়ে। পাহাড়চূড়া দেখাই যায় না, কেবলই নানা রঙের পাখির নড়াচড়া চোখে পড়ে। কিচিরমিচির শব্দে চারদিক মুখরিত।

ভালোলাগা ঝিরঝির ঢেউ একটা মানুষের বুকের ভেতর কেঁপে কেঁপে ওঠে। চেয়েই থাকে সে বিপুল বিস্ময়ের মতো দৃশ্যমান এই দৃশ্যের দিকে।

কী এক ঘোরের মধ্যে থেকে সে শুনতে পায় পাখির ভাষা। পাখির ছোট্ট বুকের ধুকপুক। ডানার ফরফর শব্দ।

বিস্ময়ের মাত্রা ছাড়িয়ে একসময় সে বিহ্বল হয়ে ওঠে। একজন বিহ্বল মানুষ ফিরতে থাকে তার সংসারে। শর্ষে ক্ষেতের আঁল ধরে সে হাঁটতে থাকে। শর্ষে ফুলের মৌতাত ছড়ানো গন্ধ তাকে মাতাল করে তোলে। আনন্দে বিহ্বলতায় সে হাত বোলায় শর্ষে ফুলের শরীরে। টুপ করে ঝরে পড়ে একটা ফুল। সে তুলে নেয়। আর তার চোখ পড়ে সামনে। ছেড়ে আসা পাহাড়ে যে পাখি সে দেখেছিল, এখানেও তার কয়েকটা পড়ে আছে। মৃত। পাখিগুলোর মাথা নেই। গলার কাছটায় রক্ত জমাট হয়ে আছে।

মুহূর্তে টলে ওঠে একটা মানুষ।

মাতালের মতো বিড়বিড় করে ওঠে।

লাল ফ্রক পরা ছোট্ট একটা মেয়ে বসে আছে আঁলের ওপর। এ রকম মায়ামাখা টলটলে মুখ ছায়াবীথি ছাড়া আর কারো সে দেখেনি। কী নিষ্পাপ আর কী স্নিগ্ধ এই মুখ। তবে এই মুহূর্তে মেয়েটির নিষ্পাপ মুখচ্ছবির ভেতর  ক্রূরতার একটা ছায়া পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। সে খুব মনোযোগ দিয়ে হাতের ধারালো ছুরি দিয়ে পাখির গলা কাটছে। পাখিরা পালিয়েও যাচ্ছে না। বরং দেখে মনে হলো, পাখিগুলো যেন সার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে গলা কাটার অপেক্ষায়। একটা একটা করে তারা এগিয়ে আসছে। আর মেয়েটি মাথাটা আলাদা করে পাখির শরীরটা ছুঁড়ে দিচ্ছে শর্ষেক্ষেতের ভেতর।

হঠাৎই কী রকম যেন অন্ধকার হয়ে এলো চারদিকে। কারা যেন ফিসফাস করছে। মনে হলো একটা মানুষের, গুপ্তহত্যার ষড়যন্ত্র হচ্ছে কোথাও। এখানে আর সে নিরাপদ নয়। কিন্তু যাবে সে এখন কোথায়? অন্ধকারে ফিকে আলোর নানা ছায়াশরীর ছোটাছুটি করছে। সামনে। পেছনে। ডানে। বামে। বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে এরই মধ্যে। রক্তের বৃষ্টি। লাল লাল বৃষ্টি। পাখি পাখি গন্ধ এই বৃষ্টির। কাতর ধ্বনি বৃষ্টিপাতের।

কাতরতা ছড়াতে থাকে একটা মানুষের ভেতর।

সে হাঁটতে থাকে।

সে দৌড়োতে থাকে।

হাঁপাতে থাকে একটা মানুষ।

বুক ঢিবঢিব করে তার। তেষ্টা পেতে থাকে।

পাশাপাশি একটা ছায়া সে দেখতে পায়। তার সঙ্গে সঙ্গে ছায়াও দৌড়োচ্ছে। একটা মানুষ ভাবতে থাকে, কী তার পরিচয়। সে ভাবতে থাকে, তার সঙ্গে দৌড়োতে থাকা এই ছায়ার পরিচয় কী হতে পারে।

হঠাৎ থমকে দাঁড়ায় সে। তার সামনে গাছপালায় ঘেরা নির্জন একটি কুঁড়ে। অবাক বিস্ময়ে কী এক ঘোরের ভেতর কাঁপতে থাকে সে। রাত্রি তখন গভীরতার দিকে যাত্রা করেছে। রাতের নিজস্ব সুললিত শব্দে চারদিক মুখরিত। ওপরে রুপোর থালার মতো ঝকঝকে চাঁদ। নরম আর উজ্জ্বল এক রকম আলো চারদিকে। গাছপালার ছায়া ছায়া আলো-অন্ধকারের ভেতর থেকে ডেকে যাচ্ছে পাখি। কী যেন কাতরতা স্বরে। ডেকে যাচ্ছে ঝিঁঝি। হঠাৎ হঠাৎ ঝিরঝির হাওয়ায় মাথা দোলাচ্ছে উঁচু উঁচু গাছপালা।

স্নিগ্ধতা কেবল চারদিকে। এই অন্ধকারে। চাঁদের রহস্যময় শরীরে। আশ্চর্য কুহক ছড়ানো একটা দৃশ্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একটা মানুষ স্থির হয়ে যায়। চেয়ে থাকে কুঁড়ের দিকে। টিনের একচালা। চারদিকে পাটকাঠির বেড়া। উঁই ধরে বেড়ার বেশিরভাগ অংশ খসে খসে পড়েছে। হতশ্রী মানুষের হতশ্রী ঘর। সে তো তার এক জীবনে এ রকম হতশ্রী মানুষ হতে চেয়েছিল। সে তো চেয়েছিল এ রকম একটি হতশ্রী ভেঙে পড়া নির্জন ঘরে ঘুমোতে। জেগে থাকতে।

তার বুকের ভেতর মুগ্ধতার একটা নদী বয়ে যেতে থাকে।

তার মাথার ভেতর চাঁদের আলোয় ঘুমিয়ে থাকা ভেঙেপড়া একটি ঘর।

এই এক মুহূর্ত। জীবন-যাপনের আর কোনো কিছুই তার মনে পড়ে না। কারো মুখ মনে পড়ে না। সে মানুষ কিনা, তাও তার আর মনে থাকে না। তবে মনে থাকে, সে একটি প্রাণ। এই পৃথিবীর মুগ্ধ একটি প্রাণ। সে মুগ্ধ একটি প্রাণে চেয়েই থাকে কুঁড়ের দিকে। ভালো লাগে তার। এবং তার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে, এই যে মুহূর্ত সে পেরিয়ে যাচ্ছে এই সময়টাই সে বেঁচে আছে পৃথিবীতে। এর আগে সে বেঁচে ছিল না। এর পরেও সে বেঁচে থাকবে না।

কুঁড়ের ভেতর থেকে নিশ্বাস ফেলার শব্দ হচ্ছে। গভীর ঘুমের মধ্যে থেকেই মানুষ এ রকম নিশ্বাস ফেলে। একটা মানুষ ডেকে ওঠে, কেউ আছেন ঘরে... কেউ কী আছেন...

কেঁদে ওঠে একটি শিশু। একটি নারীর স্বর শোনা যায়। ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলছে, উঁ-উঁ, এই তো... নে, খা।

তারপর চুকচুক শব্দ হয়। শিশুটি মায়ের বুক চুষতে থাকে।

একটা মানুষ আবার ডেকে ওঠে, কেউ আছেন ঘরে?

নারী কণ্ঠ হতচকিত। ভাঙা ভাঙা শব্দে ঘরের মধ্যে থেকে ভেসে আসে, কে?

একটা মানুষ বলে, আমি একজন মানুষ।

নারী বলে, এখানে কাকে চান?

কাউকে না। দরজাটা একটু খুলুন। এই ঘরে আমি থাকতে চাই। এই ঘরে আমি ঘুমোতে চাই।

জবাব নেই। একটু সময় পর দরজা খুলে যায়।

থমকে যায় একটা মানুষ।

থমকে যায় নারী।

একটা মানুষ দেখতে পায় তার বউকে।

একটা নারী দেখতে পায় তার স্বামীকে।

ঘরের ভেতর কেঁদে ওঠে ছায়াবীথি। বউ বলে, ঘরে এসো।

একটা মানুষ বলে, এই তবে আমার ঘর। এতদিন কেন জানতে পারিনি বলো তো বউ।
বউ হাসে।

একটা মানুষ বলে, আমি তো এক জীবনে এরকম একটি ঘরেই বেঁচে থাকতে চেয়েছি।

বউ বলে, বেঁচে তো আছোই।

কেঁদে ওঠে ছায়াবীথি, দুদ্দে... দুদ্দে...

বউ ঢুকে যায় ঘরের মধ্যে। একটা মানুষও পা রাখে ঘরের চৌকাঠে। তারপর হঠাৎ কী রকম যেন এলোমেলো লাগে তার। শব্দের গুঞ্জন শুনতে পায় সে। কোত্থেকে যেন ভেসে ভেসে তার কাছে চলে আসছে শব্দ। শব্দের ঢেউ ভেঙে ভেঙে পড়তে থাকে তার ভেতর। প্রকাশ পেতে চায় শব্দেরা। শব্দেরা ছটফট করে। একটা মানুষ ছটফট করে।



বাংলাদেশ সময়: ১৭৩২ ঘণ্টা, অক্টোবর ২০, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।