ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

যুদ্ধোত্তর চুক্তি ভঙ্গকারী পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক কেন | রেজা ঘটক

বিশেষ রচনা ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭১৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০১৫
যুদ্ধোত্তর চুক্তি ভঙ্গকারী পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক কেন | রেজা ঘটক

৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিকাল ৪টা ৩১ মিনিটে ঢাকার ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ-ভারত মিত্রবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা’র কাছে পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন। জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী, বাংলাদেশ ভূখণ্ডে পাকিস্তানের ৯৩ হাজার পাকিস্তানী সেনা-নৌ-বিমানবাহিনীর সদস্যসহ সকল প্যারামিলিটারি ও আর্মস সদস্যসহ তাদের স্থানীয় কোলাবরেটরস রাজাকার-আলবদর-আলশামসের আত্মসমর্পণের ওই মুহূর্তটি বাংলাদেশের তখনকার সাড়ে সাত কোটি বাঙালির জন্যে ছিল একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত।

এখনো সারাবিশ্বের নানান প্রান্তে বসবাসরত ষোল কোটি বাংলাদেশীর জন্য ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের দিন, গৌরবের দিন, পৃথিবীর বুকে মাথা উচু করে দাঁড়াবার দিন। নতুন স্বপ্ন গড়ার লক্ষ্যে নতুন করে দীপ্ত শপথ নেবার দিন।



পাকিস্তান দ্বিপক্ষীয় সিমলা চুক্তি ও ত্রিদেশীয় দিল্লি চুক্তি সুস্পষ্টভাবেই লঙ্ঘন করেছিল। যে কারণে পরবর্তী সময়ে পাকিস্তান থেকে সাড়ে তিন লাখ থেকে সাড়ে চার লাখ বাঙালিকে বাংলাদেশ ফেরত আনলেও পাকিস্তান বাংলাদেশে বসবাসরত সাড়ে চার লাখ নন-বাঙালি বিহারি পাকিস্তানিদের ফিরিয়ে নেয়নি। এখনো বাংলাদেশে জেনেভা ক্যাম্পগুলোর অস্তিত্ব প্রমাণ করে, পাকিস্তান চুক্তি ও প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন করেছে। এমনকি পাকিস্তানের কাছে বাংলাদেশের পাওনা কয়েক হাজার কোটি টাকাও তারা ফেরত দেয়নি



১৯৭২ সালের ২ জুলাই ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো সিমলা চুক্তি স্বাক্ষর করেন। সিমলা চুক্তি অনুযায়ী, ভারত থেকে পাকিস্তান ৬,৫০০ যুদ্ধবন্দি ফিরিয়ে নিতে রাজি হয়। বাংলাদেশ তখন সিমলা চুক্তিকে স্বাগত জানায়। সিমলা চুক্তি হয়েছিল ২৫ বছরের জন্য। সিমলা চুক্তিকে কার্যকর করতে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ ১৯৭৩ সালের ২৮ আগস্ট আরেকটি ত্রিদেশীয় দিল্লি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্মরণ সিং, পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আজিজ আহমেদ ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন ত্রিদেশীয় দিল্লি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। দিল্লি চুক্তি অনুযায়ী, জাতিসংঘ উদ্বাস্তু বিষয়ক হাইকমিশনের তত্ত্বাবধানে পাকিস্তান থেকে ১ লাখ ২১ হাজার ৬৯৫ জন বাঙালি অফিসার ও সেনা সদস্য বাংলাদেশে ফেরত আসে। বাংলাদেশ থেকে ১ লাখ ৮ হাজার ৭৪৪ জন নন-বাঙালি পাকিস্তানি অফিসার ও সেনা সদস্য পাকিস্তানে ফেরত যায়। ভারতে থেকে ৬,৫০০ যুদ্ধবন্দি পাকিস্তানে ফেরত যায়। বাংলাদেশ ও ভারতে যে সকল পাকিস্তানি সেনা যুদ্ধবন্দি হিসেবে জেলে ছিল, তারাও পাকিস্তানে ফেরত যায়। চুক্তি অনুযায়ী, দেশে ফিরিয়ে নিয়ে এসব যুদ্ধবন্দিসহ ১৯৫ জন মানবতাবিরোধী যুদ্ধপরাধীকে আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের মুখোমুখি করার কথা ছিল পাকিস্তানের। যা তারা বিগত এতগুলো বছরেও করেনি। কার্যত পাকিস্তান বাংলাদেশের সঙ্গে একাত্তরের যুদ্ধে পরাজিত হবার পর কোনো চুক্তি বা প্রতিশ্রুতি ঠিকমত পালন করেনি।

পাকিস্তান দ্বিপক্ষীয় সিমলা চুক্তি ও ত্রিদেশীয় দিল্লি চুক্তি সুস্পষ্টভাবেই লঙ্ঘন করেছিল। যে কারণে পরবর্তী সময়ে পাকিস্তান থেকে সাড়ে তিন লাখ থেকে সাড়ে চার লাখ বাঙালিকে বাংলাদেশ ফেরত আনলেও পাকিস্তান বাংলাদেশে বসবাসরত সাড়ে চার লাখ নন-বাঙালি বিহারি পাকিস্তানিদের ফিরিয়ে নেয়নি। এখনো বাংলাদেশে জেনেভা ক্যাম্পগুলোর অস্তিত্ব প্রমাণ করে, পাকিস্তান চুক্তি ও প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন করেছে। এমনকি পাকিস্তানের কাছে বাংলাদেশের পাওনা কয়েক হাজার কোটি টাকাও তারা ফেরত দেয়নি। বরং বাংলাদেশ ১৯৭২ সালে কমনওয়েলথের সদস্যপদ লাভ করলে, পাকিস্তান প্রতিবাদস্বরূপ কমনওয়েলথ ত্যাগ করেছিল। পরবর্তী সময়ে পাকিস্তান, চীন ও সৌদি আরবের নেতৃত্বে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো যাতে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেয়, সেজন্য তারা সম্মিলিতভাবে জোর কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়েছিল।

বাংলাদেশ যখন জাতিসংঘের সদস্যপদের জন্য আবেদন করে তখন পাকিস্তানের মিত্র চীন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো প্রদান করেছিল। পরবর্তী সময়ে ১৯৭৪ সালের ২২ থেকে ২৪ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠিত হয় মুসলিম দেশগুলোর ওআইসি’র দ্বিতীয় শীর্ষ সম্মেলন। পাকিস্তান বাংলাদেশকে ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনে যোগদানের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে আহবান জানায়। ওআইসি’র সাত সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় আসে শেখ মুজিবকে আনুষ্ঠানিকভাবে নিমন্ত্রণ জানাতে। গাম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট টাংকু আবদুর রহমান একটি বিশেষ বিমান পাঠান মুজিবকে পাকিস্তানে নেওয়ার জন্য। পাকিস্তানের সঙ্গে বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে শেষ পর্যন্ত মুজিব বাংলাদেশের জেলে বন্দি একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন এবং পরদিন বিকালে সেই বিশেষ বিমানে সাত সদস্যের বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলসহ লাহোর গমন করেন।

পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী বিমানবন্দরে মুজিবকে স্বাগত জানান এবং ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪ সালে ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনে শুরুর কয়েক মিনিট আগেই আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের পর ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪ সালে আবার পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক পথচলা শুরু। পরবর্তী সময়ে একই বছর জুলাই মাসে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো বাংলাদেশ সফর করেন এবং সাভারের জাতীয় স্মৃতি সৌধে মুক্তিযুদ্ধে নিহতদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেন। ভুট্টো তখন বাংলাদেশে বসবাসরত সাড়ে চার লাখ বিহারি পাকিস্তানিদের ফিরিয়ে নেবার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু ঢাকা সফর শেষ করে পাকিস্তানে ফিরেই আবার বাংলাদেশ থেকে বিহারিদের ফিরিয়ে নেবার কথা অস্বীকার করেন ভুট্টো। এমনকি একাত্তরের ১৯৫ জন মানবতাবিরোধী যুদ্ধপরাধীদের বিচার নিয়েও তালবাহানা শুরু করেন।
 
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট—মুজিবকে সপরিবারে হত্যা করা পর্যন্ত ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ভুট্টো মুজিবের সঙ্গে নানান সময়ে নানাভাবে বন্ধুত্ব রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েও বারবার তা ভঙ্গ করেছেন। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ থেকে বাংলাদেশের কার্যত পুনরায় পাকিস্তানমুখী যাত্রা শুরু হয় খোন্দকার মোশতাক ও জেনারেল জিয়ার নেতৃত্বে। পাকিস্তানের প্রধানমিত্র জামায়াতে ইসলামীর আমির গোলাম আযমকে জেনারেল জিয়া আবার বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনেন। পরবর্তীতে বেগম খালেদা জিয়া গোলাম আযমকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করেন। পাশাপাশি কুখ্যাত যুদ্ধপরাধী জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামী ও জামায়তের সেক্রটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে নিজের মন্ত্রীসভায় ঠাঁই দেন।

দীর্ঘ ২১ বছর ক্ষমতার বাইরে থেকে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গিয়ে জেনারেল জিয়ার প্রবর্তিত বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচার রোহিতকরণ ব্লাসফেমি আইন বাতিল করে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচার শুরু করে। পরবর্তী সময়ে ২০০৮ সালের নির্বাচনী মেনুফেস্টোতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের পুনরায় বিচার শুরু করার প্রতিশ্রুতি দেয়। ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচার শেষ করে এবং আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে একাত্তরের মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করে।

১২ ডিসেম্বর ২০১৪ তারিখে রাত ১০টা ১ মিনিটে কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হবার পর পাকিস্তান তাদের পার্লামেন্টে যুদ্ধপরাধীর ফাঁসি দেওয়ার জোরালো প্রতিবাদ করে। ২০১৫ সালের ১১ এপ্রিল আরেক মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী মুহম্মদ কামরুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর করলেও পাকিস্তান আবারও তাদের পার্লামেন্টে তার জোরালো প্রতিবাদ করে। সর্বশেষ চলতি বছর ২২ নভেম্বর অপর দুই যুদ্ধাপরাধী বিএনপি নেতা ও খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক উপদেষ্টা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং জামায়াত নেতা ও বিএনপি সরকারের মন্ত্রী আলী আহসান মুহম্মদ মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকর করার পরেও পাকিস্তান একইভারে জোরালো প্রতিবাদ করে প্রমাণ করেছে, পাকিস্তান কার্যত একাত্তরের সেই পরাজয়ের গ্লানি ভুলতে পারেনি।

যে কারণে এখন সবচেয়ে বড় হয়ে এ প্রশ্নটি সামনে আসছে, বাংলাদেশের কি আদৌ পাকিস্তানের সঙ্গে কোনো ধরনের কূটনৈতিক সম্পর্ক রক্ষা করা জরুরি? যদি না হয়, তাহলে কখন কিভাবে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশ সকল ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করবে? যদি পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশ সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন না করে, তাহলে আর কত মাসুল দেবে বাংলাদেশ?



বাংলাদেশ সময়: ১৭২০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।