ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

আমার আব্বা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না | আহমেদ খান হীরক

মুক্তিযুদ্ধের গল্প ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৪২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০১৫
আমার আব্বা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না | আহমেদ খান হীরক

পাথরঘাটে নৌকা যখন ডাঙা পায় তখন আব্বার ঘড়ির কাঁটা এগারটার ঘরে টিমটিম করে জ্বলছে। বর্ডার তিনি পার হয়েছিলেন দিনের বেলাতেই।

দুপুরের দিকে। ওদিকে মিলিটারির যাতায়াত কম। খুব মওকাবুঝে সপ্তাহে হয়ত দুয়েকবার যায় তারা, ঘণ্টা খানেকের বেশি থাকেও না। কিন্তু ক্যাম্পটা তো রহনপুরেই। হাইস্কুলটায়। আর স্কুলটা এই পুনর্ভবার ওপরেই নিজের একটা ছায়া ফেলে পাহাড়ী টঙের ভূত হয়ে ঝুলছে। আব্বাকে তাই সাবধান হতে হয়। ভোলাহাটেই কাটাতে হয় সারাটা বিকাল। মাঝিও তেমনই বলছিল—মিলিটারিরা লদীক খুব ডড়ায়। দিনে তাও আসে দু’চারইরবার মাগার সান্ধের বেলায় আসেই না!



পাথরঘাট থেকে আব্বার বাড়ি দূরে না। একটা দশধাপির সিঁড়ি উপরে উঠে গলিপথে এগুলে দুইটা বাড়ি পর নিজের বাড়ি। এই অন্ধকারের ভেতরেও নিজের বাড়িটা দেখে অদ্ভুত একটা শান্তি অনুভব করেন আব্বা। বুকে কেমন একটা ঘ্রাণ। ফুল ধরেছে নাকি বাড়ির উঠানে?



ফলে সূর্য নদীতে নাক গুঁজলে আব্বা রওনা দেন। অল্প সময়ের রাস্তা হলেও একটিন বিস্কুট নিয়ে নেন শ্যালকের দোকান থেকে। শ্যালক কোন সাহসে এখনো, এই যুদ্ধের ভেতর ভোলাহাট বাজারে দোকানদারি করে চলেছে কে জানে! আব্বার মাথায় ঢোকে না। তিনি ফিরতেই চাননি দেশে। ঢাকায় গোলাগুলি হওয়ার পরেও আব্বা বুঝতে পারেননি যুদ্ধ লেগে যাবে দেশে। তখনও তিনি মুজিবরের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। মুজিবর নিশ্চয় এমন কোনো জাদু করবে সব ঠিক হয়ে যাবে! কিন্তু আব্বা চোখের সামনেই দেখলেন উত্তাপ কমল না বরং হু হু করে বেড়েই চলল। আব্বা তার শ্যালকের মতো নিজের দোকানটা আর খুলে রাখতে পারলেন না। চাচাকেও বললেন সব গুটাতে। আগে জান তারপর জাহান! নিজের স্ত্রী, গ্যান্দা গ্যান্দা তিন সন্তান নিয়ে প্রথমে ভোলাহাট গেলেন শ্বশুরালয়ে। তারপর সেখান থেকে নদী পার হয়ে একেবারে রিফ্যুজি ক্যাম্পে। মনোহারি-মুদিখানার দোকান থেকে যতটা মালামাল সম্ভব বের করে ঢুকিয়ে রাখলেন বাড়ির একমাত্র পাকা ঘরটায়। অন্য ঘরগুলোতেও মারলেন তালা। হাতের কাছে যা টাকা-পয়সা ছিল সবই নিলেন।

কিন্তু বসে খেলে বাদশাহীও ফুরায়। রিফ্যুজি ক্যাম্পে দুই মাসের মাথায় জীবন অতীষ্ট হয়ে উঠল। খাবার নাই, স্বস্তি নাই, হাতে টাকা নাই। তার সঙ্গে ছেলেমেয়েদের শরীরে হলো ঘাঁ। দুধের অভাবে ছেলেমেয়েগুলো মুখ শুকিয়ে রাখে। এই কদিনেই তাদের চোখ বড় বড় হয়ে গেছে। লিকলিকে হয়ে গেছে হাত-পা। ওদিকে ক্যাম্প থেকেই খবর পাচ্ছেন রহনপুরে মিলিটারি ঢুকে গেছে। চলছে লুটতরাজ। আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়েছে কোথাও কোথাও। চলছে গরু আর ছাগল পুড়িয়ে খাওয়ার উৎসব।

মিলিটারি। শব্দটার মধ্যেই এক ধরনের গা শিরশির করা ভয় আছে। আব্বা এই ভয়ের মুখোমুখি হতে চাননি বলেই ফিরতে চাননি দেশে। কিন্তু খিদার কষ্ট সবসময়ই ভয়কে হারিয়ে দেয়। রিফ্যুজি ক্যাম্পের জীবন যখন একেবারেই ময়লা কাঁথার মতো ঘিনঘিনে হয়ে ওঠে আব্বা তখন বাধ্য হন দেশে ফিরতে। উদ্দেশ্য একটাই—গোপনে এসে কিছু টাকা-পয়সার যোগাড় করে ফিরে যাবেন।

পাথরঘাট থেকে আব্বার বাড়ি দূরে না। একটা দশধাপির সিঁড়ি উপরে উঠে গলিপথে এগুলে দুইটা বাড়ি পর নিজের বাড়ি। এই অন্ধকারের ভেতরেও নিজের বাড়িটা দেখে অদ্ভুত একটা শান্তি অনুভব করেন আব্বা। বুকে কেমন একটা ঘ্রাণ। ফুল ধরেছে নাকি বাড়ির উঠানে?

দরজা হা করে খোলা। আব্বা অবশ্য আশাও করেননি দরজায় তালাটা ঠিকঠাক থাকবে। তবু এভাবে হা-খোলা দরজা দেখে ভালো লাগে না আব্বার। ভেতরে ঢোকেন কেমন অস্বস্তিতে। নিজের বাড়িতে নিজেকেই অচেনা লাগে। এমনকি চোরও মনে হয় নিজেকে। যেন এক অনধিকার চর্চা করছেন। বাড়িতে ঢুকেই তিনি ভাঁড়ার ঘরের দিকে চলে যান। কোমরে আটকানো তিন ব্যাটারির লাইটটা খুব সন্তর্পণে মারেন ঘরটার দরজায়। তালা ভাঙা। দরজাটা হাত দিয়ে ঠেলতেই দেখেন ঘরের ভেতরটায় যেন কোনো মোরগ লড়াই হয়েছে। দোকান থেকে নিয়ে আসা মালসামানগুলো এমনভাবে সব ছড়ানো যেন কেউ গুপ্তধন খুঁজে গেছে এখানে। চাল-ডালের বস্তাগুলো নেই। সাবানের বাক্স আর দুধের টিনগুলোও লুট হয়েছে। আর লবণের বস্তাটাকে খুন করার উদ্দেশ্যে কেউ যেন তার পেট ফাঁসিয়ে দিয়েছে। এলোমেলো গড়িয়ে আছে আগরবাতি। কেরোসিন তেলের ড্রামটা ভাঙা।

আব্বা হাউমাউ করে কাঁদতে গিয়েও কাঁদলেন না। কান্নাটাকে সম্পূর্ণ গিলে মাটির ঘরগুলোতে ঢুকলেন। একটা ঘরে ঢুকলে আরো তিনটা ঘরে যাওয়া যায়। টর্চ দিয়েই একবার ঘরগুলো দেখলেন, হারিকেন জ্বালানোর উদ্যম পেলেন না। নেই। ঘরের কোথাও কোনো আসবাব নেই। নিজের বাগানের গাছ কেটে, উঠানে কাঠ চেরাই করিয়ে, নিজের চোখের সামনে খাট আর চেয়ারগুলো বানিয়েছিলেন। স্ত্রীর শখ মেটাতে একটা ড্রেসিং টেবিলও বানিয়ে ছিলেন। লম্বা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আব্বা বুক ফুলিয়ে দাঁড়াতে ভালোবাসতেন। কিছুই নাই সেসবের। শুধু আলমারিটা আছে। আলমারিটাকে কোপানো হয়েছে ধারালো কিছু দিয়ে। কাঁসার থালাবাসনের জায়গাটা এখন মিলিটারির মতো হা হা হা করে গোঁফ তাতিয়ে হাসছে। সে হাসিতে আব্বার কলিজা হিম হয়ে যায়।

পাত কুয়াতে পুরনো বালতিটা এখনো রশিসমেত আছে। আব্বা রশিটা নামিয়ে পানি উঠিয়ে আনলেন। কুকুরের মতো চুকচুক করে বালতিতে জিভ দিয়েই পানি খেলেন। তারপর মাথায় পানি ঢালেন। মধ্যরাতের সমস্ত নীরবতাকে খানখান করে যেন কলতলার শানে পানি পড়ে। রক্ত ছলকে ওঠে আব্বার। নিশ্চয় কেউ টের পেয়ে যাবে যে তিনি এসেছেন। আব্বা কিছুক্ষণ নড়তে পারেন না। হাতে শূন্য বালতিটা নিয়ে আব্বা শুধু নিজের বুকে ড্রাম পেটানো শোনেন। যেন এক্ষুনি মিলিটারিরা লেফট-রাইট লেফট-রাইট করতে করতে ঢুকবে তার বাড়িতে।

ফজরের আজানে ঘুম ভাঙে আব্বার। নিজের অজান্তেই কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলেন ঘরের মেঝেতে। ধড়ফড় করে উঠে বসতেই বাইরে কয়েকটা ছায়ামূর্তি দেখতে পান তিনি। কে? বলতে চাইলেও বলতে পারেন না। যেন কথা বলার সমস্ত অধিকার তিনি হারিয়েছেন। দেখেন ছায়ামূর্তিগুলো ঠিক ভূতের মতো ঘোরাফিরা করছে। এগিয়ে যাচ্ছে ভাঁড়ার ঘরের দিকে। ভেতরে উঁকি দিয়ে একটা ছায়া বলল, আগেই বলছিলাম এই বাড়িত আর কিচ্ছু নাই!

অন্যজন বলে, হ। রহমইত্যারা সব নিয়া গেছে!

আরেকজন বলে, সেই ভাগ তো তুমিও পাইছিলা। পাও নাই।

প্রথম জন বলে, ভাগের মাল কবেই ফুরায়। কিন্তুক শালা পুরা বাড়িটাই তো খালি! এইখানে আইসা আর লাভ নাই!

আব্বার গলার স্বর বুঁজে আসে। রাজাকার আর আলবদর বাহিনি তৈরি করেছে মিলিটারিরা। তাদের কাজই এখন বাড়ি বাড়ি ঢুকে লুটতরাজ করা। ওই ছায়াগুলো, ভূতের মতো ছায়াগুলোও নিশ্চয় মিলিটারিদের বন্ধু। মিলিটারিদের সাথে তাদের দহরম। বাঁশের চেয়ে কঞ্চি বড় হয়, মিলিটারির থেকে এরা নিশ্চয় আরো বেশি হিংস্র।

ছায়াগুলো বেরিয়ে আসতে থাকে। আসতে গিয়ে একটা ছায়া আটকে যায়। কী গাছ বে এটা?

হাশনাহেনার। চিনতে পারিসনি?

গন্ধ কত বে ফুলের!

হ। এই গন্ধে সাপ আসে।

কী কহছিসবে?

যে এতক্ষণ কথা বলছিল না সেই ছায়ামূর্তিটা হঠাৎ গাছটাকে মাড়াতে শুরু করে। অন্যরা বলে, কী করছিস কী করছিস?

ছায়ামূর্তিটা বলে, মাইরা ফেলব গাছটারে...উপড়ায়ে ফেলব...

ছায়ামূর্তিটা দারুণভাবে টানাটানি শুরু করে গাছটা নিয়ে। ওই সময় আব্বার কী জানি হয়। হয়ত ঘোরের ভেতর চলে যান। উঠানে একদল ছায়া তার লাগানো হাসনাহেনা গাছটাকে উপড়ে ফেলছে দৃশ্যটা কেমন স্বপ্নদৃশ্যের মতো হয়ে যায়। যেন ছায়াগুলো ভোরের আলোর ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। আব্বা প্রচণ্ড শব্দে চিৎকার করে ওঠেন, শুয়োরের বাচ্চারা...!

ছায়াগুলো চমকায়। এ সময় কেউ ঘরের ভেতর থাকতে পারে তারা ভাবতে পারে না। তারা অনেকটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। ভোরের আলোয় ছায়াগুলো পরিচিত হয়ে ওঠে। ছায়াগুলোর কাছেও আব্বা পরিচিত হয়ে ওঠে। একটা ছায়া বলে, চল চল!

ছায়াগুলো বেরিয়ে যায়। আব্বা ওই সকালেই পুনর্ভবার সাঁতরে ওপারে গিয়ে একটা নৌকা ধরেন। ভোলাহাট দিয়ে ভারতের রিফ্যুজি ক্যাম্প চলে যান। যেখানে তার স্ত্রী আর অসুস্থ ছেলেমেয়েরা এই অপেক্ষা করছে যে তাদের জন্য তিনি খাদ্য আর পয়সা নিয়ে আসবেন। কিন্তু আব্বা এসব নিয়ে যেতে পারেন না। আব্বা নিয়ে যান শুধু একটা গল্প। যে গল্পে তিনি তার হাসনাহেনার গাছটাকে কিভাবে বাঁচিয়েছেন তার বর্ণনা থাকে। গল্পটা বলতে বলতে আব্বার ভরসা হারানো ভীত চোখগুলো অদ্ভুত উজ্জ্বল হয়ে যায়।



বাংলাদেশ সময়: ১৭৪৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।