ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

হাসান আজিজুল হকের আগুনপাখি | ফজলুল হক সৈকত

পাঠ পর্যালোচনা ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৩৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২, ২০১৬
হাসান আজিজুল হকের আগুনপাখি | ফজলুল হক সৈকত

‘আমার মায়ের য্যাকন মিত্যু হলো আমার বয়েস ত্যাকন আট-ল’ বছর হবে। ভাইটোর বয়েস দেড়-দু বছর।

এই দুই ভাই-বুনকে অকূলে ভাসিয়ে মা আমার চোখ বুজল। ত্যাকনকার দিনে কে যি কিসে মরত ধরবার বাগ ছিল না। এত রোগের নামও ত্যাকন জানত না লোকে। ডাক্তার-বদ্যিও ছিল না তেমন। মরবার আগে মুখে যেদি ওষুধ পড়ত, তাই কতো! পেরায় পিতি বছর কলেরা-বসন্তে কতো যি লোক মরত, তার সীমাসংখ্যা নাই। আমার মা যি কলেরা-বসন্তে না মরে অজানা কি একটো রোগে মারা গেল তাই কতো ভাগ্যি। !’—ব্যক্তি-সমাজ-পরিবার প্রভৃতির প্রাকৃতিক সরলতা ও সংকট, চিকিৎসা-ব্যবস্থার অপ্রতুলতা, মানুষের অনুভবশক্তি, ভাগ্য-অভাগ্য বিবেচনা, রাজনীতির ভুবনে মানুষ-নির্মিত অমানবিক পরিস্থিতি—এইসব নানাবিধ সমাচার স্মৃতি সুতোয় বুনতে বুনতে যে আখ্যান-বর্ণনার দিকে ধাবিত হচ্ছেন নিরীক্ষাপ্রবণ ও ক্রম-পরিবর্তনশীল চিন্তাধারার অনুগামী কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হক (জন্ম: যবগ্রাম, বর্ধমান, ০২ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৯) তাঁর ‘আগুনপাখি’ উপন্যাসে, তার প্রথমপর্ব ‘ভাই কাঁকালে পুঁটুলি হলো’র আরম্ভটি হলো এই।



প্রচলিত প্রেমকাহিনী কিংবা সুড়সুড়ি-দেওয়া যৌনতা নির্ভর উপন্যাস এটি নয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও রুশবিপ্লব-পরবর্তী সময়কাল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও ফ্যাসিবাদী প্রবণতার প্রবল প্রভাব, ভারতের বিভক্তিচিন্তা ও স্বাধীনতা-আন্দোলন, বিলেতি পণ্য বর্জন কমসূচি, ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষ, সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধিনির্ভর দেশ-বিভাগ, ভয়ঙ্কর ধর্মীয় দাঙ্গা প্রভৃতির আলো ও অন্ধকার থেকে প্রত্যক্ষভাবে বহু দূরে গ্রামবাংলার অতি সাধারণ নিম্নবিত্ত মুসলিম পরিবারের অশিক্ষিত নারীর অমার্জিত ভাষার বয়ানে তৈরি হয়েছে কাহিনীটির ক্যানভাস। কথক নারীটি তার অভিজ্ঞতা সরলভাবে বলে গেলেও তা সমকালীন জীবনের নানান জটিলতাকে ধারণ করে আছে জীবনবোধেরই চরম উৎকর্ষে



গল্পনির্মাতা হাসান উপন্যাসের বিরাট-ব্যাপক পরিসরে সাধারণত পরিভ্রমণ করেন না। প্রথম প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ ‘সমুদ্রের স্বপ্ন: শীতের অরণ্য’ (১৯৬৪)। ওই সময়ে—ষাটের দশকে লেখা তার প্রথম ‘অসমাপ্ত’ ও ‘ছোট উপন্যাস’—‘শিউলী’ পরিমার্জন ছাড়াই প্রকাশিত হয়েছে প্রায় চারদশক পরে ২০০৫ সালে। বহুদিন তিনি উপন্যাসের পথে হাঁটেননি; গল্প নিয়েই চলছিল তার লেখালেখির কারবার। রচনাকালের দিক থেকে দ্বিতীয় উপন্যাস ‘বৃত্তায়ন’ বেরিয়েছে ১৯৯১ সালে। ‘আগুনপাখি’ (প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০০৬) হাসানে তৃতীয় উপন্যাস; বলা চলে, এই বইটিই তাকে ঔপন্যাসিক খ্যাতি এনে দিয়েছে। ‘বিধবাদের কথা’ (প্রকাশকাল: ২০০৮) মাত্র ৩৬ পৃষ্ঠার একটি উপন্যাস। সম্প্রতি তাঁর নতুন উপন্যাস ‘নিখোঁজ’ বেরিয়েছে মাসিক পত্রিকা ‘কালি ও কলম’-এ (ফেব্রুয়ারি ২০১৩)। আরেকটি ছোট-পরিসরের ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনার পরিকল্পনা করছেন বলে তিনি জানিয়েছেন সাম্প্রতিককালে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে। হাসান আজিজুল হক কেবল ভারত উপমহাদেশের প্রখ্যাত কাহিনীকার নন—তার পরিচিতি ছড়িয়ে পড়ছে সারাবিশ্বে; হিন্দি-উর্দু ছাড়াও ইংরেজি, রুশ, চেক প্রভৃতি ভাষায় রূপান্তরিত হয়েছে তার কথাসাহিত্য। ‘আগুনপাখি’ সম্প্রতি ইংরেজি ভাষায় রূপান্তরিত হয়েছে; তবে পাণ্ডুলিপির পাতা পেরিয়ে তা এখনও ছাপার অক্ষরে প্রবেশ করেনি।

দর্শনশাস্ত্রের অধ্যাপক হাসান আজিজুল হক জীবনকে বিশেষভাবে দেখবার এক অপরূপ কৌশল অর্জন করেছেন। প্রান্তিক মানুষের জীবনধারা, সাধারণ ব্যক্তির মনের ভেতরের অনুভবশক্তি ও প্রকাশের মাতম, মানুষে-মানুষে চিন্তা-ধর্মবিশ্বাস-সামাজিক পরিচয়ের সংকট, রাজনীতির দারুণ কষ্টকর মারপ্যাঁচ, বিপর্যস্ত মানবতা, ভাবনার বিভক্তি এবং ক্রমাগত ছোট হয়ে পড়া রাষ্ট্র-কাঠামো ও সংকীর্ণতায় পরিপূর্ণ মানবমন, বাঙালি জাতির জন্ম-বিকাশ এবং আপন ভূখণ্ডের সত্যিকারের পরিচয় হাসান আজিজুল হকের আরাধ্য বিষয়। ভাষা-প্রয়োগ আর বিষয়-পরিকল্পনা ও পরিবেশনশৈলীতে তিনি অভিনবত্ব এবং স্বাভাবিকতার পক্ষে। তবে, তার গল্পের মানুষ-পরিবেশ-প্রতিবেশ এক জায়গায় স্থির নয়—চিন্তার ক্রম-অগ্রসর ধারায় পরিবর্তিত তার দেখা ও লেখার প্রেক্ষাপট। ‘অপ্রকাশের ভার’ অতিক্রম-করা নিবিড় কথামালা নির্মাণের দক্ষ শিল্পী তিনি। ‘আগুনপাখি’ কোনো ব্যক্তিকেন্দ্রিক বা চরিত্রনির্ভর কাহিনী নয়। সময়-সমাজ-মানুষ—এই তিনে মিলে তৈরি হয়েছে এই আখ্যানের ক্যানভাস। বাঙালি-বাংলাদেশি, মুসলমান-হিন্দু বিষয়ক ভারতবর্ষীয় যে জাতিগত সমস্যা, সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি; যে বিভাজনের রাজনীতি মানুষকে ‘দেশ’ নামক কাঠামো দিয়ে ছুঁড়ে ফেলেছে মানবতাবিবর্জিত সমাজ-পরিপ্রেক্ষিতে, তার পটভূমিসূত্র ধরে নির্মিত হয়েছে উপন্যাসটির শরীর। এক কথক নারীর মাধ্যমে লেখক পরিবেশন করেছেন ১৯৪৭ সালে দেশ-বিভাগজনিত মধ্যবিত্ত-জীবনের সংকটকে। ভারতে ‘পাকিস্তানি’ হিন্দু এবং পাকিস্তানে ও পরবর্তীকালে বাংলাদেশে ‘হিন্দুস্থানি’ মুসলমানরা যে তখনকার মতো আজও উদ্বাস্তুই রয়ে গেল, সে গল্প আছে এখানে। আসলে গল্প নয়—গল্পের মোড়কে কঠিন সত্য উপস্থাপিত হয়েছে ‘আগুনপাখি’তে।

গণতন্ত্র, সামাজিক বৈষম্য, সংবিধান, সেনাবাহিনীর ক্ষমতাগ্রহণ প্রভৃতি বাস্তবতায় রাষ্ট্রের অগ্রগতি-পশ্চাৎগতি-বিষয়ক নানান পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন ঘটেছে এই উপন্যাসে। রাজনৈতিক বিভ্রান্তি, সিদ্ধান্ত গ্রহণে অপরিপক্বতা এবং জাতিসত্তার বিকাশে বিচিত্র প্রতিবন্ধকতা কাহিনীতে স্থান পেয়েছে প্রাসঙ্গিক পথ ধরে। আর উঠে এসেছে সংসারের খুঁটিনাটি, ব্যক্তির বিচরণের পরিধির সীমাবদ্ধতা ও একাকিত্ব! আমরা যে সময়ের প্রবাহে কেবল বছরের পর বছর সাজিয়ে চলেছি ছোটছোট-পুরনো স্মৃতি আর বাড়িয়ে চলেছি অপ্রয়োজনীয়তার ভার, তার ছবি আছে এখানে। ময়লা-জমা জীবন আর কালিমাখা সমাজ থেকেও আমাদের মুক্তি নেই! কাহিনীতে এক বুড়ির প্রতিদিনের চালচলন ও অভ্যাস তুলে ধরার ভেতর দিয়ে লেখক আমাদের জীবন ও ভাবনার সামান্যতাকে প্রকাশ করতে চেয়েছেন। বলছেন:

দখিন-দুয়োরি ঘরটোর ঠিক পেছনেই ছিল আর একটো ছোট ঘর। ঐ ঘরে থাকত আমার ঐ দাদি, বাপজির খালা। তিন কুলে কেউ নাই। সোয়ামি-ছেলেমেয়ে সব মরে-ঝরে যেয়ে দাদি একা। ছোট ঐ ঘরে সারাদিন খুটুর খুটুর করে বেড়াত। ঘরের ভেতরটো আঁদার, একটিমাত্র দরজা ঘরে ঢোকার লেগে, কুনোদিকে কুনো জানেলা নাই। ঘরের বাইরে উসারার এক পাশে একটো মাটির চুলো। রান্নাবাড়া সব ঐখানে। ঘরের ভেতরে শুদু হাঁড়ি সাজানো। কালো কালো হাঁড়ি, বড়ো-ছোট হিসেব করে একটোর ওপরে আর একটো বসানো। সার সার শুদু হাঁড়ি, অতো হাঁড়িতে কি যি থাকত কে জানে!

সমকাল, সমাজ-পরিপ্রেক্ষিত এবং ব্যক্তি ও পরিবারের বিবর্তন ধরা পড়ে উপন্যাসটির সুপরিকল্পিত অধ্যায়-বিভাজনে। ‘ভাই কাঁকালে পুঁটুলি হলো’র পর কাহিনী-বর্ণনার ধাপগুলো মন্তব্য আকারে সজ্জিত হয় বিভিন্ন উপনামে; সময়ের ধারাবাহিকতায় সমাজ ও মানুষের গতিপথ ধরে ধরে—‘বিছেনা ছেড়ে একদিন আর উঠলে না’, ‘আমার বিয়ের ফুল ফুটল’, ‘মাটির রাজবাড়িতে আমার আদর’, বড়ো সোংসারে থই মেলে না’, ‘আমার একটি খোঁকা হলো’, ‘সোয়ামি সোংসার নিয়ে আমার খুব গরব হলো’, ‘সোংসার সুখ-দুখের দুই সুতোয় বোনা বই-তো লয়’, ‘ও মা, মাগো, কতোদিন যাই নাই, এইবার বাপের বাড়ি যাব’, ‘ছেলে চলে গেল শহরে’, ‘সব গোলমাল লেগে যেচে’, ‘খোঁকা ভালো আছে তবে সোময়টো খারাপ’, ‘ছেলে আনো বাড়িতে, আর পড়তে হবে না’, ‘যা ভয় করেছেলম, তা-ই হলো, ই সান্নিপাতিক জ্বর’, ‘সারা জাহান খাঁ খাঁ—হায়রে শোধ তোলা’, ‘সোংসার কাউকে ছেড়ে কথা বলবে না’, ‘কতো লোকের কতো বিচের, কতো বিধেন’, ‘পিথিমির র্পেজা আর কতো বাড়াব’, ‘কি দিন এল, সারা দুনিয়ায় আগুন লাগল’, ‘আবার অ্যানেকদিন বাদে বাপের বাড়ি’, ‘গিন্নি বিছেনা নিলে, আর উঠলে না’, ‘আকাল আর যুদ্ধুর দুনিয়ায় কেউ বাঁচবে না’, ‘নোহ নবীর সোমায়ের কেয়ামত কি আবার এল’, ‘দুনিয়ায় আর থাকা লয়, গিন্নি দুনিয়া ছেড়ে চলে গেল’, ‘সোংসার তাসের ঘর, তুমি রাখতে চাইলেই বা কি’, ‘ভাই ভাই, ঠাঁই ঠাঁই, সবাই পেথগন্ন হলো’, ‘এত খুন, এত লউ, মানুষ মানুষের কাছে আসছে খুন করার লেগে’, ‘আর কেউ নাই, এইবার আমি একা’। তিন-প্রজন্মের সংসারযাত্রা, তার চারপাশের পরিবর্তিত রাজনীতি ও রাষ্ট্রকাঠামো, বিপন্ন মানবতা আর বিস্ময়কে আশ্রয় করে কথক নারী আঞ্চলিক ভাষায়, মধ্যবিত্তের এক বৈঠকখানায় বসে অবিরাম-অকৃত্রিম ঢঙে বলে চলেছেন তার ভেতরে জমেথাকা কথাগুলো। যুদ্ধ-বিবাদ, ক্ষমতার লোভ, রাজনীতির চিন্তান্ধতা, মিডিয়ার অপপ্রচার যে সংসারে-সমাজে কী অশুভ ফল ফেলে, মানুষ যে কেমন বিপন্ন হয়ে পড়ে, তার চিহ্ন খনিকটা দেখে নেওয়া যাক ‘আগুনপাখি‘র পাঠ থেকে:

কবর কেমন হবে জানি না তবে মনে হয়, কবরের থেকে একটু বড়ো এই সোংসার। কবরের জায়গাটো তবু নিজের নিজের, সোংসারের সবটো নিজের লয়। সোংসার থেকে যা দেখা যায়—আসমান-জমিন—সি তো কবরের বাড়া! সোংসার করতে করতে জান জ্বলে গেলে এইরকম মনে হয়। ... ত্যাকন যেন নিজের ছেলেমেয়ে-সোয়ামি-সোংসার সবই বিষ। তা বিষ খেতে খেতে এমন হয়েছে যি এ্যাকন এই বিষেও নেশা লাগে। ... কতো দূরে যুদ্ধু হচে, আমরা ইয়ার কি বুঝব? উ নিয়ে তুমি অত মাথা ঘামাইছ ক্যানে? কই, সেই আগের যুদ্ধুতে তো কিছুই বুঝতে পারা যায় নাই! ঐ বঙ্গবাসী কাগজ আর কি কি সব ছাইভস্ম বাড়িতে আসে, ওইগুনোই য্যাতো লষ্টের মূল। ... কখনো কখনো মনে হয়, গাঁয়ের ভেতর ঘরের কোণে বসে আছি বলে কিছু বুঝছি না। শহরে হয়তো অ্যানেক কিছুই হচে। কত্তা আগের মতুনই শহরে যায় বর  এট্টু বেশিই যায়। ... যুদ্ধের ফল এই বোধহয় শুরু হলো। ঘরে ঘরে সব তাঁত বন্ধ। সুতো নাই, তাঁতিরা সব পেটে কাপড় বেঁধে বসে আছে। ... যুদ্ধুর কুনোকিছু তো এখনো ই-দেশে হয় না। তাইলে হঠাৎ হঠাৎ এক একটো জিনিশ ক্যানে নাই হবে?... এমনি য্যাকন অবস্তা, ত্যাকন একদিন শোনলম, ছায়রাতুনবিবির লাতিনি মেয়েটি—এখনো বিয়ে হয় নাই, সোমত্ত মেয়ে—সেই মেয়ে ন্যাংটো হয়ে ঘরে বসে আছে। ছায়রাতুন বুড়ি ক্যানে বেঁচে আছে কেউ বলতে পারবে না, সোয়ামি-পুত্তুর-ভাই-বেরাদর কেউ নাই তার। সব পুড়িয়ে খেয়েছে, শুদু ঐ লাতিনটো আছে। বোধায় ঐ লাতিনটোর লেগেই বেঁচে আছে। তাদের মতুন তাদের ভিটেটোও বেআব্রু। একটোই মাটির কুটুরি। ভিটেঘেরা মাটির দেয়াল এককালে ছিল, এখনো তার কিছু কিছু চিহ্নত আছে, এই পয্যন্ত। ঘরটোর দেয়ালও জায়গায় জায়গায় ভাঙা, দরজার বালাই নাই, একটো ছেঁড়া চট টাঙানো থাকে, চোরে সিটি নেয় নাই—ভাগ্যিস নেয় নাই। পায়খানা-পেশাব করতে ঐ চটটো পিঁদে লাতিনি বাইরে আছে। বুড়ি লিকিনি বলেছে, নিজের শাড়িটি লাতিনিকে দিয়ে সে ন্যাংটো হয়ে বাড়িতে কাজ করবে, ন্যাংটো হয়ে গাঁয়ের রাস্তায় ঘুরে বেড়াবে। সে কি এ্যাকন আর মেয়েমানুষ যি লাজ-শরম থাকবে? উসব ধুয়ে-মুছে খেয়ে নিয়েচে সে। সে ন্যাংটোই ঘুরবে। বলেছে, দেখি গাঁয়ের লোকে কি করে!’  (‘কি দিন এল, সারা দুনিয়ায় আগুন লাগল’)

‘আগুনপাখি’তে ইতিহাস-ঐতিহ্য আর জাতিত্বের অস্তিত্বের প্রতি প্রবল দায়বদ্ধতা আছে। গল্পের কাঠামোর শর্তানুযায়ী কোনো গল্প না থাকলেও রয়েছে চরিত্র ও সংলাপ নির্মাণের নতুনত্ব। ঘটনার ধারাক্রম চরিত্রকে, সংলাপকে আশ্রয় করে এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে প্রবল গতিতে। কোথাও গতির জড়তা নেই, নেই স্থবিরতা। প্রচলিত প্রেমকাহিনী কিংবা সুড়সুড়ি-দেওয়া যৌনতা নির্ভর উপন্যাস এটি নয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও রুশবিপ্লব-পরবর্তী সময়কাল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও ফ্যাসিবাদী প্রবণতার প্রবল প্রভাব, ভারতের বিভক্তিচিন্তা ও স্বাধীনতা-আন্দোলন, বিলেতি পণ্য বর্জন কমসূচি, ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষ, সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধিনির্ভর দেশ-বিভাগ, ভয়ঙ্কর ধর্মীয় দাঙ্গা প্রভৃতির আলো ও অন্ধকার থেকে প্রত্যক্ষভাবে বহু দূরে গ্রামবাংলার অতি সাধারণ নিম্নবিত্ত মুসলিম পরিবারের অশিক্ষিত নারীর অমার্জিত ভাষার বয়ানে তৈরি হয়েছে কাহিনীটির ক্যানভাস। কথক নারীটি তার অভিজ্ঞতা সরলভাবে বলে গেলেও তা সমকালীন জীবনের নানান জটিলতাকে ধারণ করে আছে জীবনবোধেরই চরম উৎকর্ষে। গল্পটি প্রকৃতঅর্থে হাসান আজিজুল হকের মায়ের বিবৃত কাহিনীর সামান্য পরিমার্জিত রূপ। দেশভাগের ফলে দুই বাংলায় মানুষের গমনাগমন নিয়ে, অত্মীয়-পরিজনদের মধ্যে বিভেদরেখা টানার মধ্যে যে যন্ত্রণা, তা এই নারী তার অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে মুখে মুখে বলছিলেন নাতী-নাতনীকে—ড্রয়িংরুমে বসে। শ্রোতা নাতী-নাতনী পূর্ব-মহিলা দাদীর কথাগুলো রেকর্ড করে। আর মাঝখান থেকে নারীটির পুত্র আর গল্প-শোনা এই প্রজন্মের দুই ভাই-বোনের বাবা গল্পনির্মাতা, পাশের কক্ষ থেকে মাঝে-মধ্যে শোনা, ড্রয়িংরুমে বসে বলা এই গল্পটিকে সাজিয়ে তুললেন উপন্যাসের বিরাট ক্যানভাসে। কাজেই তিন প্রজন্মের অনুভব, জীবন-জিজ্ঞাসা গেঁথে আছে বর্তমান আখ্যানে। সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিকূলতার ভেতর দিয়ে সংসারের পুরুষগণ কিভাবে পরিবারকে পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত করে, কিভাবে টিকিয়ে রাখে, তারও বাস্তব ছবি মেলে এখানে। লেখকের জন্মের কিছুকাল পূর্ব থেকে তার কৈশোরকাল পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছে গল্পের পরিসর। তাই এই আত্মস্মৃতিমূলক কাহিনীটিতে নিজের অভিজ্ঞতা, মা এবং প্রতিবেশীদের কাছ শোনা ঘটনা, পরিবার-পরিজনদের প্রশ্নাদি, ইতিহাস থেকে পাঠ নেওয়া—সব মিলিয়ে তৈরি হয়েছে পটভূমি। কোনো চরিত্র কিংবা ঘটনা আরোপ করা হয়নি—সবই ইতিহাসের সত্য থেকে উঠে আসা। তবে গাঁথুনি আর পরিবেশন-কায়দার কারণে তা ইতিহাস বা কেবল স্মৃতিকথা না হয়ে হয়ে উঠেছে উপন্যাস। দ্বিজাতি-তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতের যে বিভাজন, তাতে বাঙালির মনে সমাজ-পরিবর্তনের নেতিবাচক ফল-ফলাদির উপস্থিতি দেখা দিয়েছে—একথা আজ দিনের আলোর মতো, চন্দ্র ও সূর্যের মতো সত্য। তৎকালে হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ্বের ছবি পাচ্ছি আমরা ‘আগুনপাখি’র ‘সব গোলমাল লেগে যেচে’ উপ-অধ্যায়ে। লেখক গল্পে-বর্ণিত কথকের কণ্ঠে বলছেন সে কথা:

একদিন হঠাৎ কত্তা আমাকে শুদুইলে, আচ্ছা হিন্দু-মুসলমানে তফাত কি বলো তো শুনি। ই আবার কি কথা? ইসব তো কুনোদিন ভাবি নাই, ভাবতে হবে বলে কুনোদিন মনেও করি নাই। কত্তার কথা শুনে আমি ফ্যাল ফ্যাল করে খানিকক্ষণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলম। দেখি সে মিটি মিটি হাসছে। কত্তার ই রূপ তো কুনোদিন দেখি নাই। একটু পরে সে বললে, এত কষ্ট করে যে পড়তে লিখতে শিখলে তা দিয়ে কি তোমার কোনো কাজই হবে না?

কথা শুনে আমার রাগ-ও হলো দুঃখ-ও হলো। কি কথা বলছে এই মানুষ? সকাল থেকে রেতে বিছানায় শোয়া পয্যন্ত তার সোংসারের ঘানি টানছি, চোখে বেঁধেচি ঠুলি, কানে দিয়েছি তুলো, পিঠে বেঁধেচি কুলো, দোপরের খাওয়া খেতে বসি সাঁঝবেলায় আর সে কিনা বলে লেখাপড়া শিখে আমি কি করলম! রাগে অমি গুম মেরে থাকলম, অ্যাকটো কথা বললম না। একটু সোময় যেতে কত্তা বললে, হিন্দু-মুসলমান সব এক হয়ে এই একবারই ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে নেমেছিল। মোসলেম জাহানের খলিফাকে তাড়াতে যাবে না বলে কতো কি করেছিল! শেষ পর্যন্ত কি হয়েছে জানো? ব্রিটিশদের কিছুই করতে হয় নাই। সে দেশের মুসলমানদের এক নেতাই খলিফাগিরি খতম করে দিয়েছে। এখন এ দেশের হিন্দু-মুসলমান এক হয়ে যাই করুক সব বেকার। দাবিই তো আর কিছু নাই। সব ছত্রখান হয়ে গেল। আবার সেই হিন্দু-মুসলমানের নিজের নিজের দাবি নিয়ে মারামারি কাটাকাটি শুরু হয়েছে। তাতে তো বিদেশীদেরই পোয়াবারো। সেইজন্যে তোমাকে জিজ্ঞাসা করছি, হিন্দু-মুসলমানে তফাত কি? এইবার বুঝতে পেরেছ? 

রাজনীতির ঘোরপ্যাঁচ আর কতিপয় ভাবনান্ধ রাজনীতিবিদের কারণে ভারতে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার যে ভয়াবহ রূপ ও পরিণতি বিশ্ববাসী অবলোকন করেছে, তার সাথে দেশটির আপামর জনসাধারণের কোনো যোগাযোগ বা সম্পৃক্তি ছিল না। ভারতবর্ষ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। এখানে হাজার হাজার বছর ধরে বিভিন্ন জাতি-ধর্মের লোক একসাথে বসবাস করে এসেছে। কিন্তু ইংরেজ শাসন, এবং তৎপরবর্তী ভারত-বিভাজন চিন্তার মধ্যে কিভাবে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিভেদ ও দূরত্ব সৃষ্টি হলো, তা গ্রামবাংলার সাধারণ জনগোষ্ঠীর কাছে তখন অবোধ্য ছিল, আজও তা রয়ে গেছে রহস্যাবৃত!

‘সোংসার কাউকে ছেড়ে কথা বলবে না’—এই চরম সত্যটি লেখক গল্পকথক নারীর মাধ্যমে তার পাঠকের সামনে হাজির করেছেন। নিয়তি, সমাজ, সংসার এসবের মধ্যে কোনো মিথ্যার স্থান নেই। চালাকি বা প্রতারণা করেও বেশিদিন টেকা যায় না। মুখ লুকিয়ে আর কতকাল সমাজকে, পরিবর্তনটাকে অস্বীকার করা চলে? প্রকৃতঅর্থে চলে না। জীবন-চলার পথে মানুষের অভিজ্ঞতার ঝুলিতে জমতে থাকে আনন্দধারা ও কষ্টযাতনার বিচিত্র দাগ। এই পৃথিবীতে কেউই গুরুত্বপূর্ণ নয়; কিছুই নয় অপরিহার্য-অনিবার্য! কারো জন্যে থেমে থাকে না সময়ের স্রোত ও সংসারের দায়। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে দায় ও দায়িত্বের উত্তরাধিকার চলে আসছে বাতাসের অদৃশ্য প্রবাহের মতো। কেউ কিছু টের না পেলেও পরিবর্তনটা কিন্তু ঠিকই ঘটছে; একের পর আরেক চলে আসছে বিধাতা-নির্ধারিত নিয়মের ফলে। স্রষ্টার এ এক বিচিত্র খেলা! ‘সংসারের ঘানি টানা’ মানুষগুলোর ওপর প্রকৃতি আর রাষ্ট্রকাঠামোর যে চাপ, তা কি তারা সরলতা আর সাধারণতা দিয়ে মোকাবিলা করতে প্রস্তুত থাকে সবসময়? বুঝে উঠতে পারে সমাজের সব রূপান্তর বা বদলে-যাওয়া চেহারা-চরিত্র ও ঘটনারাজি? বোধহয় না। আর কিভাবে যে মানুষ পরিবার-পরিজনঘেরা চারদেয়ালে সুখ-দুঃখের ভেলায় ভেসে বেড়ায় সে আরেক বিস্ময়! বর্তমান উপন্যাসে বিবৃত সমাজসত্যের একটা পাঠ নেওয়া যাক:

আমার বড়ো খোঁকা চলে গেল। দুনিয়াদারিতে আর আমার মন নাই—নাই নাই নাই—তবু কি মওত এল? সোংসার কি ক্ষ্যামা দিলে? ছুটি কি প্যালম? বড়ো খোঁকা গেল তো পরের খোঁকাটি বড়ো খোঁকার জায়গায় চলে এল। কবে এল তা জানিও না। দেখতে দেখতে সে-ও বড়ো হয়ে গেল। মোটেই বড়ো খোঁকার মতুন লয়, গড়ন-পেটন একদম আলাদা। তারও খুব রূপ। কাঁচা সোনার মতুন গায়ের রঙ। এতদিন কিছুই খেয়াল করি নাই, একদিন হঠাৎ দেখি, ও-ও তো বারো-তেরো বছরের ছেলে হয়ে গেয়েছে। তাপর, মেয়েটি বাড়ির পেতম মেয়ে, সি-ও তিন-চার বছরের হয়ে গেল। মাজা-মাজা রঙ, আঁকা-আঁকা চোখমুখ, এইটুকুনি কপাল, মাতাভত্তি এলোমেলো কালো চুল—ওমা, আমার কি হবে মা—গা থেকে যেন ননী গলচে! এ্যাকন এদের নিয়ে কি করব? পোড়া সোংসার কি জিনিস কে বলতে পারে বলো! শুদু কি তাই? সোংসার ইদিকে আপনা-আপনি বড়ো হচে। তা সোংসার বড়ো হবে কি ছোট হবে তাতে কারুর হাত নাই।

নারী-পুরুষের মিলিত প্রয়াসে সংসারের যে চিরায়ত অভিযাত্রা, তার উত্থান-পতন—এসবের মধ্যে বাঙালি জাতির ঐতিহ্যিক শক্তির যে নির্মল প্রবাহ, তার সত্যিকারের ছবি আভাসিত হয়েছে ‘আগুনপাখি’তে। আর সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে আরেকটি সত্য আছে, তা হলো যুগে যুগে কালে কালে পর্দার আড়ালে বা প্রকাশ্যে নারীরাই জাগিয়ে রেখেছে সংসারের চাবি ও কাঠি! ‘এ বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর’, ‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে’, ‘আমাকে একটি শিক্ষিত মা দাও, আমি একটি শিক্ষিত জাতি দেব’, ‘জ্ঞানের লক্ষ্মী, গানের লক্ষ্মী, শস্যলক্ষ্মী নারী...। ’—এইসব কথামালার ভেতরে যে চিন্তাপ্রবাহ ও সত্যানুভব প্রবাহিত, তার সারটুকু ধরতেই বোধকরি সমাজ-রাষ্ট্র-পরিবার-পরিজনের এই মহাকাব্যিক উপন্যাসের কথকের ভূমিকায় রচয়িতা দার্শনিক হাসান আজিজুল হক নারীকে হাজির রেখেছেন। জেন্ডারভাবনা, নারীর অধিকার, সামাজিক সাম্য—সবকিছুকে ধারণ করছে হাসানের এই মূল্যায়ন কিংবা বলা চলে এক দার্শনিক লেখকের সত্য-উপলব্ধি!

মানুষ-মাতৃভূমি-মাতৃভাষা—এই তিন একসূত্রে গাথা। জন্ম-পরিচয়, বেড়েওঠার কাল ও প্রতিবেশ থেকে মানুষকে জোর করে বিছিন্ন করা চলে না। রাষ্ট্র নামক কাঠামোর পরিবর্তনে, ধর্মীয় চিন্তার রোষানলে কিংবা নিজেদের বোকামির জন্য পরিজন থেকে শারীরিকভাবে দূরে সরিয়ে দিলেও আপনজনদের জন্য মনের যে আকুতি, তা মুছে ফেলতে পারে না কোনো পরিস্থিতিই। তাই, ভারত-বিভাগজনিত বাঙালির মধ্যে যে বিভেদরেখার সৃষ্টি, পশ্চিম আর পূর্ব—দুই দিকে বাঙালির অবাসভূমির রূপবদল, তার যন্ত্রণার চিহ্ন স্থান পেয়েছে ‘আগুনপাখি’তে। ভিটে-মাটি-জমি ফেলে আরেক দেশে চলে গেলেই মানুষ সেখানকার ব্যক্তি হয়ে ওঠে না। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট প্রতিষ্ঠার কালে হিন্দু-মুসলমানের মাটি-ভিটে ছাড়ার অনিবার্যতার পরিপ্রেক্ষিতে কবি জসীম উদ্‌দীন লিখেছিলেন ‘গীতরা চলিয়া যাবে’, ‘গীতারা কোথায় যাবে’, ‘গীতারা চলিয়া গেল’ শীর্ষক ত্রয়ী কবিতা এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট হবার ছবিকেন্দ্রিক ‘ধামরাই রথ’ নামক আরেকটি হৃদয়গ্রাহী কবিতা। হাসান আজিজুল হক ইতিহাসের পাতায় আরেকটু পিছনে সরে গিয়ে ১৯৪৭ সালে ভারত-বিভাগের ফলশ্রুতিতে দীর্ঘকাল ধরে ওপারে-এপারে নীরবে জেগেথাকা মানবিক কষ্টের কথামালা সাজিয়ে তুলেছেন পরিণত বয়সে লেখা এই উপন্যাসে। তিনি সম্ভবত ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গের কোনো ডাক শুনতে পেয়েছেন অজানা কোনো প্রহর কিংবা প্রান্তর থেকে। অথবা নিজের কাছে নিজেকে অপরাধী ভেবে প্রকাশ করেছেন ‘অনেককালের লুকিয়েরাখা’ কথা ও কাহিনী। হয়তো তার মনে রক্তের ধারার মতো বয়ে চলেছে বিভেদ দূর করে ঐক্য প্রতিষ্ঠার কোনো অপ্রকাশ ভাবনা। যেমন ১৯৯০ সালে প্রায় ৪৫ বছর আগে বিছিন্ন হয়ে পড়া জার্মানি, পশ্চিম-পূর্বের মাঝখানের প্রাচীর ভেঙে গুড়িয়ে দিয়ে এক হয়ে গেছে! ধুয়ে-মুছে ফেলেছে নিজেদের ভুলের আর অপরাধের দাগ ও যন্ত্রণা! প্রত্যক্ষ দর্শক হিসেবে কথাকার ও কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় জার্মান থেকে ভারতে ফিরে লিখেছিলেন ‘ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গ’ (১৯৯২)। হাসানও কি তবে ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ—এই ত্রিরাষ্ট্রের মানব-নির্মিত প্রাচীন ভাঙার গান রচনা করতে চান! হিন্দু-মুসলমানের বিভেদরেখা ছিঁড়ে মিলিয়ে দিতে চান পূর্ব-পরিজনদেরকে!

সারা পৃথিবীতে ইউনাইটেড ও ইউনিয়ন পদ্ধতির জনপ্রিয়তা-প্রাসঙ্গিকতা বাড়ছে। আমেরিকা-ইউরোপ এই ধারণার ওপর নির্ভর করে এগিয়ে চলেছে ক্রমাগত। চীন এখনো অখণ্ড। কেবল ভেঙেছে ভারত আর এক বিরাট পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন! বিভাজনে ক্ষতিটা কার হয়েছে—ভারতের, রাশিয়ার না ইংরেজদের? প্রকৃতঅর্থে মরেছে এসব দেশের মানুষ। সাধারণ গ্রামবাসী ও আপামর শান্তিপ্রিয় জনতা। বেড়েছে কেবল অসহায়তা ও বিপন্নতা! দর্শনের ছাত্র ও অধ্যাপক, প্রখর সমাজ-বিশ্লেষক কথানির্মাতা হাসান আজিজুল হক সম্ভবত কখনো বিভাজননীতিকে সমর্থন করতে পারেননি। তাই তো তার সকল অপ্রকাশের ভার ‘আগুনপাখি’তে ভর করেছে সমর্থ শক্তি ও সম্ভাবনা নিয়ে। আশাবাদও আছে কিছু এই কাহিনীর ক্যানভাসে। নিজের সাথে নিজের দ্বন্দ্ব, মনের সাথে দেহের দ্বন্দ্ব, জানার সাথে ভানের দ্বন্দ্ব আর কতকাল গোপন রাখা যায়? হাসান বোধকরি দীর্ঘদিন ধরে বয়ে-বেড়ানো যন্ত্রণা থেকে মুক্তি চেয়েছেন। গল্পকথক নারীর ভেতরের কথাটি যেন শেষপর্যন্ত লেখকের অভিজ্ঞান হয়েই প্রকাশ পায়:

আমি কি ঠিক করলম? আমি কি ঠিক বোঝলম? সোয়ামির কথা শোনলম না, ছেলের কথা শোনলম না, মেয়ের কথা শোনলম না। ই সবই কি বিত্তি-বাইরে হয়ে গেল না? মানুষ কিছুর লেগে কিছু ছাড়ে, কিন্তু একটা পাবার লেগে কিছু একটা ছেড়ে দেয়। আমি কিসের লেগে কি ছাড়লম? অনেক ভাবলম। শ্যাষে একটি কথা মনে হলো, আমি আমাকে পাবার লেগেই এত কিছু ছেড়েছি। আমি জেদ করি নাই, কারুর কথার অবাধ্য হই নাই। আমি সব কিছু শুদু নিজে বুঝে নিতে চেয়েছি। আমাকে কেউ বোঝাইতে পারলে না ক্যানে আলেদা একটো দ্যাশ হয়েছে গোঁজামিল দিয়ে যিখানে শুদু মোসলমানরা থাকবে কিন্তুক হিঁদু কেরেস্তানও আবার থাকতে পারবে। তাইলে আলেদা কিসের? আমাকে কেউ বোঝাইতে পারলে না যি সেই দ্যাশটো আমি মোসলমান বলেই আমার দ্যাশ আর এই দ্যাশটি আমার লয়। আমাকে আরো বোঝাইতে পারলে না যি ছেলেমেয়ে আর জায়গায় গেয়েছে বলে আমাকেও সিখানে যেতে হবে। আমার সোয়ামি গেলে আমি আর কি করব? আমি আর আমার সোয়ামি তো একটি মানুষ লয়, আলেদা মানুষ। খুবই আপন মানুষ, জানের মানুষ, কিন্তুক আলেদা মানুষ। সকাল হোক, আলো ফুটুক, তখন পুবদিকে মুখ করে বসব। সুরুজের আলোর দিকে চেয়ে আবার উঠে দাঁড়াব আমি। আমি একা। তা হোক, সবাইকে বুকে টানতেও পারব আমি। একা।

ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্যবোধ, চিন্তার স্বাধীনতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার, গণতন্ত্র-রাষ্ট্রকাঠামো, সামাজিক বিস্তার ও বিভাজনকে কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হক ধরতে চেষ্টা করেছেন ঐতিহ্যিক আলোয়। ইতিহাস-রূপান্তরের প্রয়োজনে এমনটি হতে পারে বলে ধরে নেওয়া যায়। রাতের অন্ধকারে কিংবা রাষ্ট্রের অধিকাংশ মানুষকে অন্ধকারের মধ্যে রেখে বড় কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায় না। আর তা করা হলে ফল ভালো পাওয়া যায় না। ১৯৪৭ সালের দেশভাগ আমাদেরকে বারবার ওই অভিজ্ঞতার সামনে দাঁড় করায়। তবে, বিপন্নতা ও হতাশার পিঠে আছে আশার বাতি ও প্রসন্ন বাতাস! অনেক সূর্যের আশায় বুক বাঁধলে কারো জন্যে, কিছুর জন্যে অপেক্ষা করতে হয় না। পরিবর্তনের জন্য একার পথচলার অবিরাম চেতনাই যথেষ্ট। পৃথিবীতে প্রচুর ভালো কিছু আবিষ্কার ও অর্জন ব্যক্তির একক প্রচেষ্টায় ও প্রত্যয়ে হয়েছে। ওইসব অর্জনে সমবেত জনতা কিংবা অনেকে কেবল সমর্থন দিয়েছে; তারা কেবল সংখ্যা—শক্তির পেছনে তাদের অবস্থান। যুগে যুগে নেতা, চিন্তাবিদ, পরিকল্পনাবিদ দেশে-দেশে খুব বেশি আসে না; সব মানুষের অনুভবজ্ঞান এবং বিচার-বিবেচনাশক্তিও এক নয়। ব্যক্তির চিন্তা, প্রত্যয় ও প্রতিষ্ঠার এই যে সমাজ-দার্শনিক ধারণা, তার বিকাশের পথ-নির্মাণ হয়েছে ‘আগুনপাখি’তে। ‘আগুনপাখি’ উপন্যাসে দেশবিভাগের ভয়াবহতা এবং ব্যক্তির বিকাশের প্রতিবন্ধকতা বিষয়ে যে বারতা প্রতিফলিত হয়েছে, তার স্বরূপ যত তাড়াতাড়ি আমরা অনুধাবন করতে পারব, ততই মঙ্গল। পাঠশেষে সাধারণ-পাঠকের বিবেচনায় আমার মনে হয়েছে, মহাকাব্যিক উপন্যাস ‘আগুনপাখি’ কেবল গতানুগতিক কোনো আখ্যান নয়—আমাদের অগ্রগমণের, জেগে ওঠার নতুন প্রেরণার গল্পমালা!



বাংলাদেশ সময়: ১৩৩৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২, ২০১৬
টিকে/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।