ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

আপন প্রতিভু | তাসলিমা আক্তার

গল্প ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৭, ২০১৬
আপন প্রতিভু | তাসলিমা আক্তার

ক্রাইম সিন, হাজারিবাগ মনেশ্বর লেন। এলাকার রাস্তাগুলো ঘিঞ্জি ধরনের হলেও এই বাড়িটি যে লেনে সেই রাস্তাটি বেশ প্রশস্ত।

  পাঁচ তলা বাড়ির দোতলা। একজন মানুষের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে আজ সকাল এগারোটার দিকে। ময়না তদন্তের জন্য লাশ এখনও নিয়ে যাওয়া হয়নি। গোটা বাড়িটিকেই নিরাপত্তা বলয়ে ঘিরে রাখা। সেন্ট্রাল পুলিশ থেকে শুরু করে সংবাদকর্মী, টেলিভিশন রিপোর্টার- কেউ বাদ নেই। পাড়ার গণ্যমান্য ব্যক্তিরাও উপস্থিত। নিহতের নাম আদনান হায়দার। নিহতের স্ত্রী ও এক ছেলে বর্তমান।

রোবরার অফিস খোলার দিন। কিন্তু মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির উচ্চপদে কর্মরত আদনান হায়দার আজ অফিস যাননি। হাফ ইয়ারলি পরীক্ষা শেষ তাই ছেলে প্রিতমের স্কুল বন্ধ। ঘটনার সময় বাসায় ছিলো দশ বছরের প্রীতম ও স্থায়ী গৃহকর্মী সুলেখা। আদনান হায়দারের স্ত্রীর নাম রোদেলা লায়লা, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিষয়ের অধ্যাপক। নিত্যদিনের মতো এসময় তিনি ক্লাসে ব্যস্ত। আদনান হায়দারের মৃত্যু হয় ছয় তলা বাড়ির ছাদ থেকে পড়ে গিয়ে। ছাদের চারদিকেই বাউন্ডারি দেওয়া। বাড়ির পেছন দিকে কনস্ট্রাকশনের কাজ চলছে তাই বাউন্ডারির সাত থেকে আটফুট মতো জায়গা খোলা। ছাদের সেই অংশ থেকেই পড়ে যান আদনান। প্রীতম তখন সঙ্গে ছিলো।

-প্রীতম, তুমি কি বাবার সঙ্গে সকালে ছাদে গিয়েছিলে?
-হ্যাঁ
-তুমি কী বলবে বাবা কীভাবে পড়ে যায়।
-আমি তখন ট্যাবে গেম খেলছিলাম, ক্ল্যাশ অব ক্ল্যানস্‌। বাবা কফি শেষ করে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ছাদে যাবো কিনা। দু’দিন ধরে লিফট নষ্ট। আমি আর বাবা হেঁটেই উঠি। আমরা গল্প করছিলাম। হাঁটতে হাঁটতে ছাদের কিনারে চলে যাই। নিচে আমাদের যে কুল গাছটা আছে তাতে কুল ধরলেই দুষ্টু ছেলেরা পেড়ে নিয়ে যায়। বাবা ঝুঁকে দেখছিলো গাছে এখনও কুল আছে কিনা। আর তখনই পা পিছলে পড়ে যায়।
-পিছলালো কীভাবে। এখন শীতের দিন। বৃষ্টিও হয়নি যে ছাদ পিছলা থাকবে।
-আজ সকালে খুব কুয়াশা ছিলো, আমাদের সিঁড়িগুলোও পিছলা ছিলো।
-বাবা যখন পড়ে গেলো, তুমি কী করলে। চীৎকার করে সবাইকে ডাকলে?
-আমি কখনও চিৎকার করি না।

ততক্ষণে রোদেলা ও আদনান, দু’পক্ষের আত্মীয়রাই এসে পড়েছে। কথাবার্তার এ পর্যায়ে রোদেলার ছোটবোন শাপলা প্রীতমকে ছোঁ মেরে কোলে তুলে নেন।
-আপনারা কেমন মানুষ, এইটুকুন ছেলে, কাছ থেকে গোটা ব্যাপারটা দেখেছে। কী পরিমাণ শকড্‌! আবার তাকে এতো প্রশ্ন করছেন! কথার সঙ্গে সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টিবাণে বিদ্ধ করেন পুলিশ অফিসারকে।

গৃহকর্মী সুলেখা। বয়স আনুমানিক চল্লিশ। আদনান-রোদেলার  বিয়ের পর থেকেই তাদের সঙ্গে রয়েছেন। মূলত তিনি রোদেলার দূর সম্পর্কের খালা। গ্রামের দরিদ্র মানুষ। স্বামী-সন্তান নেই। পেটে ভাতও নেই। রোদেলার মা গ্রাম থেকে খবর দিয়ে এনে বলেন, ‘আমার মেয়েটাকে দেখে রাখিস সুলেখা’। কথা রেখেছিলেন তিনি। ঘরের তিনজন মানুষকেই মায়ের মমতায় দেখে রাখেন সুলেখা।
-ঘটনার সময় তুমি কোথায় ছিলে?
-বাথরুমে কাপড় কাঁচতেছিলাম
- তুমি কি দেখেছো ওরা ছাদে যাচ্ছে?
-নাহ, আমি কাপড় কাঁচতেছিলাম। প্রিতম বাবু আইসা কইলো, বাবা ছাদ থাইকে পইরা গেছে। আমি ভিজা কাপড়েই দৌড়ায়ে নিচে নামি। দুইদিন ধরে লিফট নষ্ট। সিঁড়ির গুরায় নাইমে দেখি মাইনশির মাথা মাইনশি খায়। মামার শরীল রক্তি মাখামাখি। মাথা থিকে ঘিলু বাহির হয়ে কুথায় চলে গেছে। ফোলোরের উপর শুই আছে, চেহারা একদম ঠাহর পাওয়া যায় না। ওরে আমার মামারে। হু হু করে বিলাপ করতে থাকেন সুলেখা।

স্থির হয়ে বিছানার উপর বসে রয়েছেন রোদেলা। কোলের উপর মাথা রেখে বসার ভঙ্গিটা বাংলা ‘দ’ অক্ষরের মতো। চোখের কোণায় জলের রেখাটুকু অস্পষ্ট। রোদেলা বেশ সুন্দরী। বলা যায়, আগুন সুন্দরী। দুধের বালতিতে কয়েক ফোঁটা আলতা মিশিয়ে সেই মিশ্রণ যেনো গায়ের চামড়ায় লেপে দেওয়া। পাঁচ ফুট চারের শরীরে অপ্রয়োজনীয় হাড়-মাংশ নেই। আবছা লাল চুল নেমে গেছে মাথা থেকে হাটু অব্দি। চোখের গড়নটি একেবারেই অদ্ভুত। যেনো গভীর সমুদ্রের উপর ডানা মেলে দিয়েছে শঙ্খচিল। চোখের উপর আর নিচের অংশের মিলন রেখায় রাজ্যের মায়া জমে রয়েছে। যেনো পাতালপুরীর রাজকন্যার মায়াবিদ্যার সমস্ত লুকিয়ে রাখা এই চোখের কোণে। রোদেলা সুবচনা। কথা বললে মনে হয়, এই একটু আগে পাঁচ চামচ চিনি দিয়ে চা খেয়েছে। কথার সঙ্গে সেই মিষ্টতা ঝরে ঝরে পড়ছে। এখন তিনি সর্বহারার মতো খাটের কোণায় বসে রয়েছেন। পুলিশ অফিসারটি কাছে এসে বসেন।

-মিসেস রোদেলা, আপনি আজ সকালে কোথায় ছিলেন?
-ক্লাসে
-সকালে বাসা থেকে বেরোনোর আগে কিংবা গত কদিনের মধ্যে কি আপনার স্বামীর ভেতর কোনো অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করেছেন?
-নাহ, গত এগারো বছরে যেমন দেখেছি ঠিক তেমনি ছিলো গত দিনগুলোতেও।
-আপনার কি কোনো কারণে মনে হয়, মৃত্যুটি একটি হত্যাকাণ্ড?
-সেরকম মনে হওয়ার তো কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছি না। বাড়িতে সিসি ক্যামেরা লাগানো আছে। ফুটেজ দেখতে পারেন। নিচে দু’জন ওয়াচম্যান আছে। রেজিস্টারে এন্ট্রি না করে কোনো ভিজিটর গেটের ভেতর ঢুকতে পারে না। আপনারা এসব চেক করেননি?
-করেছি। কোথাও কোনো অস্বাভাবিক কিছু পাওয়া যায়নি। ওয়াচম্যানদের অ্যারেস্ট করা হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, আপনার ছেলে সঙ্গে ছিলো। সে পড়ে যেতে দেখেছে। তিনি কি গতরাতে অ্যালকোহল নিয়েছিলেন?
-বৃহস্পতিবার ছাড়া সে অ্যালকহোল নেয় না।
-তদন্তের স্বার্থে জিজ্ঞেস করছি, মিসেস রোদেলা আপনি কী সংক্ষেপে বলবেন আপনাদের দাম্পত্য জীবন কেমন ছিলো? রোদেলার চোখ যায় অতি দ‍ূর অতীতে।

অতীমাত্রায় সুন্দরী বলে কিশোরী বয়স থেকেই বিয়ের জন্য হামলে পড়েছিলো ছেলের মায়েরা। ঠেকিয়ে-ঠুকিয়ে পড়াশুনার ধাপগুলো শেষ করে সে। তারপর দেখে-শুনে আদনানের সঙ্গে সাত তাড়াতাড়ি বিয়েটা হয়ে যায়। অন্যসব পুরুষরা যেমন, আদনান তার ব্যতিক্রম কিছু নয়। কাজ নিয়ে মেতে থাকা। ঘরে ফিরে টুকটাক কথাবার্তা তারপর টিভির বোতামে চড়ে বিশ্বভ্রমণ। প্রথম দু’বছর চালচিত্র ঠিকমতোই এগোচ্ছিলো। ধীরে ধীরে পরিবর্তনটা গোচরে আসে। আদনানের ফোনের মেসেজ বুকে কিছু অসংলগ্ন টেক্সট দিয়ে শুরু। রোদেলা জিজ্ঞেস করেও তেমন কোনো উত্তর পেতো না। রাতজাগার টেন্ডেন্সি বাড়ে। শোবার ঘর আলাদা হয়। ছেলে নিয়ে মাস্টার বেডে ঘুমায় রোদেলা। পাশের ঘরে আদনান। রাতে কখনও প্রয়োজন হলে আহ্লাদে ডেকে নেয়। এছাড়া ছেলে বুকে একা ঘরে রোদেলা নদীর পাড় ভাঙনের শব্দ শুনতে পায়। এক যৌবনে খুশি নয় পুরুষ। হুর চাই সত্তরখানা। গলায়, ঘাড়ে, অধরোষ্টে চাই ভিন্ন হুরের চুম্বন। প্রেম নয়, হৃদয় নয়- শরীরের জাগরণই পৃথিবীতে সবচে বড়। আর ওঘরে যে একলা ঘুমায় সে স্থাবর সম্পত্তি। সামলাক ঘর, সামলাক উত্তরাধিকার। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও উন্মত্ত  হয় আদনান।
-তুমি কি ভুলে গেছো, তোমার বউ-ছেলে আছে?
-এছাড়াও আমার একটা জীবন আছে। তুমি আমায় কতটুকু সুখী করতে পারো ভেবে দেখেছো?
-তোমার নীচতায় আমি লজ্জা পাই। প্রীতম বড় হয়েছে। ও দেখে, সব বোঝে। তুমি কি বদলাতে পারো না!
-না পারিনা। আমার সঙ্গে থাকতে না চাইলে চলে যাও। তোমাকে বেঁধে রাখিনি। কিন্তু শর্ত একটাই, ছেলে আমার।

শিক্ষায় মুক্তি মেলে, পয়সায় মুক্তি মেলে তবু কোথায় যেনো রোদেলাদের হাতে-পায়ে শেকল। বিদ্রোহ বুক চিরে বেরোতে চায় কিন্তু মুখ ফুটে বেরোয় না। মাকে কিছু কিছু ইঙ্গিত দেয় রোদেলা। ছোটবেলা থেকে শেখানো বুলি গতের মতো মা বলে, ‘ঝিনুক নিরবে সহ’। পাড়া-পড়শী দেখে, আহা কী চমৎকার গৃহকোণ।   বছরখানেক ধরে কথায় না মিললে গায়ে হাত তোলাটা ছিলো প্রায় নিয়মিত। মধ্যরাতে মন ও শরীরের বিবর্ণ ব্যথায় ছেলেকে বুকে নিয়ে কাঁদতো অসহায় মা। চিরায়ত বাঙালি নারীর প্রতিচ্ছবি। স্বল্পভাষী প্রীতম কিছু বলে না কখনও। শুধু মায়ের বুকের সঙ্গে লেপ্টে থাকে। কষ্ট অসহ্য হলে অস্ফুটে বলে, ‘মা তুমি চলে যাও। আমি ঠিক থাকতে পারবো’। রোদেলার উত্তর, ‘সমাজ খারাপ বলবে, মানুষ খারাপ বলবে। আর তোকে ছাড়া আমি বাঁচতেই পারবো না সোনা’।

বাড়িতে প্রাথমিক তদন্তের কাজ শেষ। পোস্টমর্টেমের জন্য লাশ নিয়ে যাওয়া হবে ঢাকা মেডিকেল কলেজের হাসপাতালের মর্গে। ছোপছোপ রক্ত এতোক্ষণে জমাট বেঁধে গেছে আদনানের শরীরের সঙ্গে। ট্রান্সপারেন্ট সেলোফেনে মোড়ানো হয়েছে বডি। নিচে পুলিশের কাভার্ড ভ্যান অপেক্ষারত। দু’জন কনস্টেবল ধরাধরি করে লাশ ওঠায়। মা, বোন, প্রতিবেশী, ঘরের ভেতর কান্নার রোল ওঠে। মার্সিয়া। বাসায় আসার পর রোদেলা খাটের উপর সেই যে বসেছেন আর একচুলও নড়েননি। এখন বুকের সঙ্গে চেপে ধরা শিশুপুত্র।

মায়ের বুকের ফাঁক গলে আড়চোখে বাবার লাশের দিকে তাকায় প্রীতম। শেষবারের মতো বাবা এ ঘরের দরোজা পেরিয়ে চলে যাচ্ছে। আর কখনও ফিরে আসবে না। সকালে কফি শেষ করে প্রীতমকে ছাদে যাবার আহ্বান জানায় আদনান। কদিন আগে বাবার ফোনের ফটো গ্যালারিতে একটা আন্টির সঙ্গে বাবার ছবি দেখেছিলো সে গোপনে। আন্টিটা মায়ের মতো অতো সুন্দর না। অপরিচিত বিছানার উপর বসা বাবার আনন্দিত মুখ সেই আন্টিটার বুকের কাছে ধরা। ছকটা অনেকদিন থেকেই আঁকা ছিলো প্রীতমের মগজে। কুল দেখার উসিলায় বাবাকে নিচে ঝুঁকতে উদ্বুদ্ধ করেছিলো প্রীতম। তারপর ছোট্ট শরীরের সমস্ত শক্তি এক করে ধাক্কাটা মারতে পেরেছিলো সে।

অসুর রুধতে যুগে যুগে সুরের অবতারণা ভিন্ন রূপে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। প্রকৃতি বেশিদিন অনিয়ম সহ্য করেনা। কোনো না কোনোভাবে অন্যায় ফেরত দেয়। আমাদের জ্ঞ্যান সীমিত, সব বোঝার সাধ্য আমাদের নেই। পৃথিবীটা ঘেরা ভীষণ রহস্যময়তায়। আর এর মধ্যে সবচে’ বেশি রহস্যময় মায়ের সাথে সন্তানের সম্পর্ক।



বাংলাদেশ সময়: ১৪১৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৭, ২০১৬
এসএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।