এই যে এতোসব ভাস্কর্য আর ঝকঝকে চুনকাম করা এদের জাদুঘরগুলো, কিন্তু তৈরি করা হয়েছে অতিসম্প্রতি। যদিও নাট্যশালা বা জাদুঘরের মতো স্থাপনাগুলো বেশ আগেও ছিল, কিন্তু সেই ঐতিহাসিক ভবনগুলোর অধিকাংশই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল ৬৩ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্পে।
মার্শাল টিটো সেসময় ফেডারেল সরকারের অর্থ ও সেনাবাহিনীকে কাজে লাগিয়ে স্কপিয়ে শহর পুনর্গঠন করেন। এ যুগে হলে হয়তো তেমন ভূমিকম্পে মেসিডোনিয়ার আরও বেশ সময় লাগতো মাথা তুলে দাঁড়াতে। সে যাকগে। সাম্প্রতিক যে নির্মাণযজ্ঞের কথা বলছিলাম সে নিয়ে কিন্তু বেশ বড়সড় বিতর্ক রয়েছে এ দেশে। কারণ, মেসিডোনিয়ান সরকার প্রায় কয়েক শ’ মিলিয়ন ডলার ঋণ করে এ নির্মাণযজ্ঞ চালিয়েছে। তাই অনেকেরই কথা হলো, যেখানে দেশে বেকারত্ব প্রবল, মানুষের হাতে অর্থ নেই, সেখানে এই ঋণ করে ঘি খাওয়ার মানে কী?
শুধু শহরকে সুন্দর বানালেই হলো? ওদিকে গ্রামগুলো যে শ্রীহীন তার কী হবে? শুধু তাই নয়, বিদেশি উৎসগুলো থেকে যে ঋণ নেওয়া হলো, সে ঋণের বোঝাই বা পরবর্তী প্রজন্মের কাঁধে ফেলার উপযোগিতা কোথায়? কিন্তু রাজনীতিবিদরা তো আর এতো যুক্তির কথা শুনবার পাত্র নয়, তারা সেটাই করবেন যেটিতে তারা উপকৃত হন।
শোনা যায়, এই নির্মাণযজ্ঞ থেকে তাদের পকেটও নাকি বেশ ভারী হয়েছে। আর এসব কারণেই মেসিডোনিয়ার বর্তমান সরকারের উপর জনগণের ক্ষোভ দিন দিনই বাড়ছে। আমি এদেশে আসার মাস কয়েক আগেই তো বিশাল এক বিক্ষোভ হয়েছে প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে, সেবার কয়েক হাজার জনতা প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে হামলে পড়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। জনতার ক্ষোভের কারণটি ছিল প্রেসিডেন্টের দুর্নীতিবাজদের প্রশ্রয় দেওয়া এবং গোপনে হাজার হাজার লোকের উপর নজরদারি নিয়ে।
সেদিনের দিনটি ছিল সোমবার। ইউরোপের অনেকখানেই সোমবার জাদুঘর বন্ধ থাকে। যথারীতি এখানেও সে নিয়ম, তাই জাদুঘরগুলোতে আর ঢুঁ মেরে দেখা হলো না।
আমি এবার সেই প্রস্তর সেতু পেরিয়ে ওপারে, অর্থাৎ আমার হোটেলটি যে পাড়ে সেদিকের দিকে পা বাড়াই। এতোক্ষণে অবশ্য মোটামুটি সব দোকানই খুলে গিয়ে দিনের পয়লা খরিদ্দারের অপেক্ষায় প্রহর গুনছে। আমি প্রথমেই কৌতূহলী হয়ে ঢুকি এক পুরনো জিনিসের দোকানে। এ দোকানটি তেমন বিশাল নয়, বেশ কিছু যুগোস্লাভ, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়কার অস্ত্রপাতি আর পাসপোর্টের সঙ্গে হঠাৎ আমার চোখ পড়ে দেয়ালের কুশনে আটকে থাকা একটি সোনার মাকড়শার উপর, যার মাঝে বসানো রয়েছে বেশ বড়সড় এক এম্ব্যার পাথর। জিনিসটি একটি মেয়েদের ব্রোচ, আর একঝলক দেখেই বোঝা যায় এটি যেন বাতিল জিনিসে হারিয়ে যাওয়া মূল্যবান কোনো কিছু।
এমন জিনিস হেলায় ফেলে আসার কোনো মানে হয় না, যেখানে কিনা দোকানি আবার বেশ কিছুটা ছাড়ে বিক্রি করতে চাইছে। উল্টোদিকের আরেকটি দোকানও পুরনো জিনিসের, তবে সেটির দ্রব্যসম্ভার আরও অনেক বিশাল। জার্মান সৈনিকের হেলমেট, গ্যাস-মাস্ক, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত দূরবীন, জার্মান মাইন ফিল্ডের একটি কাঠের নোটিশ বোর্ড- যার গায়ে লেখা 'আখতুং মাইনেম', যুগোস্লাভ সময়ের নানা মেডেল, যুগোস্লাভিয়ার এককালের এক সেনাপ্রধানকে তার অধস্তনদের উপহার একখানা ছোটখাটো ট্যাঙ্কের রেপ্লিকা, এমনি আরও কত কি যে ঠাসা সেই দোকানে!
এতোসব জিনিসের ভিড়ে সেখানে প্রায় পা ফেলবার স্থান নেই, কোনোক্রমে নিজেকে কুঁচকে বেশ কসরত করে দেখতে হয় এই জিনিসগুলো। বেশ কিছুটা তল্লাশির পর আমিও পেয়ে গেলাম কেনবার মতো ছোট্ট এক বস্তু, আর সেটি হলো টিটোর মুখায়ব অঙ্কিত এক মেডেল।
চলবে...
**কসোভোর অন্ধ বাঁশিওয়ালা (পর্ব-১)
**কসোভোর অন্ধ বাঁশিওয়ালা (পর্ব-২)
বাংলাদেশ সময়: ০৬২৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১২, ২০১৭
এএ