ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

সুখহাটা বাজার | শেখর কান্তি রায়

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৩৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০১৭
সুখহাটা বাজার | শেখর কান্তি রায় ছবি: বাংলানিউজ

সুখহাটা বাজার। সুন্দরবন এলাকার আর দশটা বাজারের মতোই এই বাজার। নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মুদি দোকান, দর্জি দোকান, খাবারের দোকান, সেলুন, গ্রাম্য ডাক্তারের চেম্বার- মোটামুটি এই সব নিয়েই সুখহাটা বাজার।

সাপ্তাহিক হাটবারের দিন অবশ্য দূরের দোকানিরা নানা পণ্যের পসার সাজিয়ে বাজারের জৌলুস বাড়িয়ে দেন। তবে সুখহাটা বাজারের গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে বাজারের পাশের স্কুল, হাসপাতাল, এনজিও অফিস, ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়।

সকালের বাজার শিক্ষার্থী আর বিভিন্ন অফিসে আসা মানুষের পদচারণায় মুখর। বিকেলের বাজারের ব্যস্ততার ধরন অবশ্য অন্যরকম। এই সময়টা কর্মজীবী মানুষের অবসর সময় কাটানোর সময়। বাজারের চৌমাথা, চায়ের দোকান, নদীর ঘাট- এ জায়গাগুলো কিছু সময়ের জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠে। দোকানিদের বেচাকেনা বেড়ে যায়। যাদের চায়ের নেশা রয়েছে তারা অবশ্য বাজারের চায়ের দোকানগুলোতে বসে আড্ডা দেন। এই ব্যস্ততা দুই-তিন ঘণ্টার বেশী স্থায়ী হয় না। সন্ধ্যার পর থেকে একটু একটু বাজারের কোলাহল থেমে আসে। বাজারের বৈদ্যুতিক বাতির রোশনাই অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। রাত দশটা বাজার সঙ্গে সঙ্গে বাজারের সব আলো নিভে গিয়ে বাজার আর গ্রামের পার্থক্য বিলীন হয়ে যায়।

সুখহাটা বাজারের প্রতিদিনের এই চিত্রের সঙ্গে এলাকার মানুষ পরিচিত। অথচ বাজারের খুব কাছে থেকেও নন্দরামের কাছে বাজারের প্রতিদিনের চিত্রের অনেকটা অজানা থেকে যায়। নন্দরাম খেয়াঘাটের মাঝি। তার নামেই ঘাটের ইজারা বরাদ্দ হয় এজন্য সবাই নন্দরামের খেয়াঘাট বলে ডাকে। নন্দরামের তিন পুরুষের পেশা- খেয়া নৌকা বাওয়া। তার বয়সের অন্যরা যখন স্কুলে যেতো তখন নন্দরাম তার বাবার সঙ্গে নৌকায় যাত্রী পারাপার করতো। নদীর দু’পারের মানুষ তো বটেই আর কতো দূরের মানুষ পার হতো নন্দরামদের নৌকায়। বরষার কয়েক মাস বাদ দিলে বছরের অন্যসময় বিয়ে, ঈদ, পূজা, যাত্রা গান, অপেরা- এরকম নানা উৎসবে নন্দরামদের ছোট্ট খেয়া নৌকায় সারাদিন যাত্রী পারাপার করতে হতো। নন্দরামের বাবা তাকে তাড়া দিয়ে বলতেন, দাঁড়টা আরেকটু জোরে টান বাপ, কতো লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে দু’পারে। তাতে অবশ্য খুব একটা লাভ হতো না কারণ, নন্দরামের অপরিপক্ক হাতে খুব জোরে দাঁড় টানা সম্ভব হতো না। কিশোর নন্দরামের এই খেয়া নৌকার জীবনে অবসর বলতে সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরে ছোটভাই-বোনের সঙ্গে কিছুক্ষণ খেলা তারপর খেয়ে-দেয়ে ঘুমিয়ে পড়া। শীতকালে বাবার সঙ্গে দু’পারের গৃহস্থদের বাড়ি থেকে সারা বছরের নৌকা পারাপারের অর্থ বাবদ ধান সংগ্রহ করতো। নন্দরামের বাবা বলতেন, এগুলো পারাপারের কড়ি। আমরা পাটনি। আমাদের কাছে পারের কড়ি দেবতার আশীর্বাদের সমান।

নদীর জোয়ার-ভাটায় বেড়ে ওঠা নন্দরাম বাপ দাদার পাটনি পেশার বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি। বছরে একবার থানায় গিয়ে সারাবছরের ঘাট ডাকার টাকা জমা দিয়ে আসতো। তারপর আবার নৌকায় যাত্রী পারাপার। প্রতিদিনের যাত্রীদের কাছ থেকে পাওয়া পারাপারের টাকা আর বছর শেষে গৃহস্থ যাত্রীদের কাছ থেকে সংগৃহীত ধানে নন্দরামের সংসার মোটামুটি চলে যেতো। আর্থিক সংকট থাকলেও অনেক মানুষের সঙ্গে প্রতিদিন দেখা হওয়া, নদীর দু’পারের মানুষের খবরাখবর পৌঁছিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে নন্দরাম সবার কাছে বেশ আস্থা অর্জন করেছিল। অবশ্য নিন্দুকেরা নন্দরামকে পিছনে নারদ বলেও ডাকতো। খেয়া ঘাটে রাতে যেসব ছোট পণ্যবাহী নৌযান নোঙর করে থাকতো তার নাবিকরা নন্দরামের খেয়া নৌকায় উঠে সুখহাটা বাজারে আসতো। খেয়া পারাপারের পেশায় আর্থিক স্বচ্ছলতা না থাকলেও সমাজের সব স্তরের মানুষের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ নন্দরামকে এই পেশা ছেড়ে যেতে দেয়নি। নন্দরামের অবশ্য এসব নিয়ে তেমন কিছু ভাবেও না। নন্দরামের সহজ উপলদ্ধি, দিন তো ভালোভাবে কাটতিছে। এর চেয়ে ভালো দরকার নেই।

নন্দরামের এই ভালো লাগার উপলদ্ধি থেকে এলাকার অন্য পেশার মানুষদের ভালোলাগার উপলদ্ধির তেমন পার্থক্য নেই। কিন্ত এই সহজ-সরল আটপৌরে জীবন যাপনের নন্দরামকে যে বাৎসরিক ঘাট ইজারা নিতে গিয়ে এমন একটা পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে তা তার ভাবনায় কখনই ছিলো না। এতোদিন পর্যন্ত অন্য কেউ ঘাট ডাকতে আসেনি। সে একাই ঘাট ডেকে এসেছে। কিন্ত আজ আরও তিনজন ঘাট ডাকতে এসেছে। সবাই তার পরিচিত- সমীর, ইউসুফ ও চন্দন। এলাকায় এরা তিনজন একসঙ্গেই চলাফেরা করে। চিংড়ি চাষিদের সাগরেদ হিসাবেই এলাকায় পরিচিত। আড়ালে আবডালে মানুষ অনেক বদনামও করে। এলাকার নানা ঝামেলায় এদের সম্পৃক্ততার কারণে মানুষ এদের এড়িয়ে চলে। নন্দরাম বুঝতে পারে না কী হতে যাচ্ছে। নিয়ম অনুযায়ী ঘাটের ডাক ওঠে। নন্দরামের ডাকের দ্বিগুণ দামে সমীর-ইউসুফ-চন্দনরা ঘাটের ডাক নিয়ে যায়। পৈতৃক সম্পত্তি হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার শোক নেমে আসে নন্দরামের পুরো অস্তিত্বে।

হতবিহ্বল নন্দরাম যখন বাড়ি ফিরে আসে ততোক্ষণে এলাকায় খেয়াঘাট হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার কাহিনী রটে গিয়েছে। বাজারের চায়ের দোকানে মানুষের মুখে তখন অনেক জল্পনা-কল্পনা। চায়ের দোকান থেকে আলোচনার অংশ বিশেষ নন্দরামের কানে আসে, খুব বেড়ে গেছিল নন্দ, আমাদের পাত্তা দিতো না। এখন কেমন হলো, বোঝ। নন্দরামের বুঝতে দেরি হয় না, এটা সমীরের গলা। এতোদিনের পরিচিত বাজার হঠাৎ করে নন্দরামের কাছে অপরিচিত মনে হয়। বাজার থেকে আধঘণ্টার হাঁটাপথের দূরত্বে নন্দরামের বাড়ি। কিন্তু এ পথও যেনো আজ শেষ হয় না। পাশের বাড়ির যতীন সঙ্গে সঙ্গে আসতে জিজ্ঞাসা করলো, কাকা এরাম একটা ঘটনা যে ঘটবে তা আগে বুঝতে পারোনি? আমরা তো কিছু কিছু কানাঘুঁষা শুনতাম। নন্দরাম বুঝতে পারে না কী উত্তর দেবে, বলে, না, আগে তো তেমন কিছু বুঝতি পারিনি। তবে সমীর-ইউসুফরা মাঝে আমার কাছে খেয়া পারাপারের লাভ-লোকসান জিজ্ঞাস করতো। আমার কাছে দু’-একবার টাকা ধার চেয়েছে, কিন্ত আমি তো দেইনি। ওদেরকে টাকা দিলে তো পাওয়া যায় না। এর বাইরে তো এমন কিছু হয়নি যে আমার বাপ দাদার পেশা হারাতে হবে।

বাড়ির মানুষদেরও আজ যেনো নন্দরামের চিনতে কষ্ট হচ্ছে। স্ত্রী-সন্তানদের নানা প্রশ্ন আর ভবিষ্যতে কী হবে সেই চিন্তার কোনো উত্তর খুঁজে পায় না। অন্য কোনো কাজও তো শেখেনি যা দিয়ে সংসার চালানো যাবে। নন্দরাম ঠিক করে রাত পোহালে এলাকার গণ্যমান্য মানুষের কাছে গিয়ে এর একটা সমাধান চাইবে। জীবনে অনেক কষ্টের রাত পার করেছে কিন্তু আজকের রাত যেনো শেষ হয় না। রাতের এক একটি প্রহর যেনো জীবনের এক একটি অধ্যায়ের বর্ণনা করে, যে জীবন রাতের সুনসান নীরবতার মতো মোটামুটি নিরপদ্রব ছিলো।

সকালেই ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের বাড়িতে হাজির হয় নন্দরাম। সব শুনে চেয়ারম্যান বলে, দেখ নন্দরাম, সবতো বুঝলাম, তোমার দাবি অন্যায্য না। কিন্তু আমারও তেমন কিছু করার নেই। ওদের হাতে এখন অনেক টাকা। আইন, কানুন, শাসন সব ওরাই নিয়ন্ত্রণ করে। এই প্রথম নন্দরাম বুঝতে পারে, তার চারপাশে কতো বড় পরিবর্তন ভিতরে ভিতরে ঘটে গিয়েছে। অথচ সে এর কিছুই বুঝতে পারেনি। চেয়ারম্যানের বাড়ি থেকে বাজার আসতে আসতে নন্দরাম তার চিরপরিচিত এলাকাটা ভালো করে দেখার চেষ্টা করে কী কী পরিবর্তন তার অজান্তে ঘটে গিয়েছে। বাজারে এসে আগের দিন তাকে নিয়ে যে কৌতুহল মানুষের মধ্যে ছিলো, সেটাও তার চোখে পড়ে না। নন্দরামের নিজের কাছেই নিজেকে বোকা মনে হয়। এতোদিনের জীবিকার ঠিকানা খেয়াঘাটটাও ঠিকমতো চিনতে পারে না নন্দরাম। তার নৌকার চেয়েও বড় নৌকায় যাত্রী পারাপার হচ্ছে। তার কর্মচারীদের একজন, সুরেশ নৌকা চালাচ্ছে। নন্দরামকে দেখে সুরেশ বলে, কী করবো নন্দদা, আমার তো সংসার চালাতে হবে, তাই বলে কয়ে কাজটা টিকিয়ে রেখেছি। এতে অবশ্য নন্দরাম দোষের কিছু দেখে না। সুরেশের কাছে জানতে চায়, এতো কিছু যে হলো, তোরা কিছু টের পাসনি। আমাকে বলতে পারতি। সুরেশের উত্তর না শুনেই বাড়ির পথে পা চালায় নন্দ।

নন্দরাম এখন একা নয়। তার দলে যোগ হয়েছে নাপিত পাড়ার শ্যামল, জেলে পাড়ার রহমত, ঋষি পাড়ার অনন্ত। সুখহাটা বাজারের খেয়াঘাটেই তাদের দিনের বড় একটি অংশ কেটে যায়। সাপ্তাহিক হাটবার এবং অন্যান্য সময় দোকানিদের ইঞ্জিন নৌকার মালামাল তোলার কাজ করে।

বাংলাদেশ সময়: ১৯৩৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০১৭
এসএনএস
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।