ঢাকা, শনিবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

কসোভোর অন্ধ বাঁশিওয়ালা (পর্ব-১০)

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩০৯ ঘণ্টা, মার্চ ১৬, ২০১৭
কসোভোর অন্ধ বাঁশিওয়ালা (পর্ব-১০) কসোভোর অন্ধ বাঁশিওয়ালা

[পূর্বপ্রকাশের পর]
যাকগে, ইতিহাস থেকে বরং ফিরে আসি প্রিস্টিনার রাজপথে। ক্যাথেড্রাল সংলগ্ন রাজপথে এবার আমার পথে পড়ে এক খাবার হোটেল, চমকে উঠবার মতো নাম তার, বাইরের সাইনবোর্ডে পরিষ্কারভাবে লেখা 'নাজি হোটেল'। আমি নিশ্চিত, হোটেলের এ নামের সঙ্গে নিশ্চয়ই প্রকৃত নাজিতত্ত্বের কোনো সম্পর্ক নেই, কে জানে হয়তো আলবেনীয় ভাষায় নাজি শব্দের ভিন্ন কোনো মানে আছে!

আরেকটু নিশ্চিত হওয়ার জন্যেই ভাবলাম এ হোটেলেই দুপুরের খাবার সেরে নেওয়া যাক না, তাতে খিদেও মিটলো, আবার হোটেলের হালহকিকতও বোঝা গেলো। ভেতরে গিয়ে বুঝলাম এটি নিতান্তই এক সাদা-মাটা বঙ্গদেশের ভাতের হোটেল ধরনের আলবেনীয় হোটেল।

চিকেন শর্মা দিয়ে মধ্যাহ্নভোজন শেষ করবার পর একটু চায়ের তেষ্টা পেয়েছিলো, কিন্তু জানলাম চা পেতে হলে নাকি কোনো তুর্কি দোকান খুঁজে নিতে হবে। এ ধরনের আলবেনীয় খাবারের দোকানে চায়ের ব্যবস্থা নেই। আপাতত তাই সেই ইচ্ছেটি শিকেয় তুলে আমি দেশময়রে বুলেভার্ডের আরও উজানে হাঁটি।
প্রিস্টিনার সেই সবজি বাজারের একটি দৃশ্য
এ পথেই দেখা হলো এক গাতক দলের সঙ্গে। সারকিয়া, বল্কানীয় বাঁশি, চেলো, খোল আর গিটার নিয়ে যারা এক জমজমাট আসর জমিয়ে বসেছে। ওই যে সারকিয়া, সেটিকে বলা চলে বলকান অঞ্চলের গিটার, তিনটে তারে আক্সগুল চালিয়ে সুর তোলা হয় তাতে। প্রাথমিক সুরের ঝঙ্কার শেষ হলে দলনেত্রী মেয়েটি তার হাঁটু অবধি ঝোলানো কালো স্কার্ট আর অযতেœ বেঁধে রাখা সোনালি চুলের গোছা দুলিয়ে এক আলবেনীয় গান ধরে, এসব সুর আর গানের ছন্দের মাঝে তুর্কি প্রভাবটি বেশ স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়।

মুহূর্তেই একটি জটলামতো তৈরি হয় সেখানে, একটি পাঁচ কী ছ’বছরের মেয়ে সেই জটলা থেকে বেরিয়ে এসে গানের তালে নাচতে শুরু করে। আমিও তন্ময় হয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে দু’তিনটি গান শুনি, গাতকের দল কিছুটা ক্লান্ত হয়ে ক্ষান্ত দিলে সেখান থেকে হেঁটে চলে আসি জাশার পাশা মসজিদ প্রাঙ্গণে।
স্কপিয়ে শহরের প্রাণকেন্দ্রের একটি দৃশ্য
মসজিদটি সেই আঠারো শতকের মাঝামাঝিতে নির্মিত হলেও এর সংস্কার করা হয়েছে অতিসম্প্রতি। যার নামে এই মসজিদের নামকরণ, সেই জাশার পাশা ছিলেন সেকালের প্রিস্টিনাতে তুর্কি গভর্নর। মসজিদটি দীর্ঘকাল পরিত্যক্ত থাকার পর তুর্কি অর্থানুকূল্যে সংস্কার করা হয়। শুধু এ মসজিদটিই নয়, অদূরের সুলতান মেহমেদ মসজিদটিও সংস্কার করা হয়েছে তুর্কি অনুদানে। আমি জুতো খুলে পাথরের অনুচ্চ সিঁড়ির একপাশে রেখে পড়ন্তবেলায় এই মসজিদে প্রবেশ করি। মসজিদটির ভেতরের গম্বুজে সেঁটে থাকা বাহারি কাচের জানালার প্রতিসরিত অনুজ্জ্বল আলো ভেতরের পরিবেশটিকে করে তোলে পবিত্র প্রার্থনাময়।  

এদিকে আমার খেয়াল হয় যতটুকু পথ হেঁটে এসেছি, সেটুকুও তো আবার পেরিয়ে পৌঁছুতে হবে বাসস্ট্যান্ডে। সে হিসেবে এখনই হয়তো ফিরতি পথ ধরা উত্তম। ফেরার পথে আবারও আমাকে থমকে যেতে হলো পথের পাশের এক উদ্যান থেকে ভেসে আসা বাঁশির সুরে, আমি পথ ছেড়ে সেই উদ্যানে বাঁশিওয়ালাকে খুঁজে ফিরি। যাকে খুঁজে পাই তিনি এক দৃষ্টিশক্তিহীন পৌঢ়। মাথায় প্লিস টুপি পরে দুর্বল ফুসফুসের বায়ু হাতে থাকা একটি বলকানি বাঁশির কোটরে ঢুকিয়ে তিনি তৈরি করে চলেছেন সুরের ইন্দ্রজাল।  

এই যে প্লিস টুপি, এটি কিন্তু তুর্কি ধাঁচের টুপি নয়, বরং কিছুটা ভিন্ন ধরনের। সাদা ধবধবে এ টুপির নিম্নভাগ স্ফিত হলেও উপরের অংশটি কিছুটা সঙ্কুচিত, ঠিক যেন একটি ডিমের খোলসের মাঝ বরাবর স্ফিত অংশে দু’ভাগ করলে যে আকৃতি পায় তেমন। এ অঞ্চলের বুড়োদের অনেকেই সাধারণ কোট-প্যান্টের সঙ্গে এ টুপি পরেন। এটিকে মূলত বলা চলে আলবেনীয় ধাঁচের টুপি। আর ওদিকে মেয়েদের মধ্যে পোশাক নিয়ে তেমন একটা রক্ষণশীলতা চোখে পড়লো না, অল্পবয়সী মেয়েরা পড়ছে হাল মডেলের জিন্স আর টপস, আর বয়োবৃদ্ধরা প্রথাগত লম্বা স্কার্টের সঙ্গে মাথায় জড়িয়ে নিচ্ছেন স্কার্ফ।
স্কপিয়ে শহরের পুরোনো বাজার-২
এর চেয়ে বরং মেসিডোনিয়ার আলবেনীয় রমণীদের মাঝেই পোশাক-সংক্রান্ত রক্ষণশীলতা, যেটি হয়তো মধ্যপ্রাচ্যের ধর্মীয় রীতি দ্বারা প্রভাবিত, আমার বেশি চোখে পড়েছিল।

বাসস্ট্যান্ডে এসে জানতে পারি আমার বাসটি ছাড়বে আরও আধঘণ্টা পর। আমি অদূরে উড়তে থাকা একটি পতাকা দেখতে পাই, অবশ্যম্ভাবীভাবে এ পতাকাটিও আলবেনিয়ান। কসোভোতে যত পতাকা ওড়ে তার আশিভাগই আলবেনিয়ান পতাকা, কসোভোর নিজস্ব পতাকা নিয়ে এরা তেমন উচ্ছ্বসিত নয়।

সময় কাটাবার জন্যে আমি স্ট্যান্ডের পেছনের দিকে এক খালি জায়গায় এসে দাঁড়াই, এখানে কে যেন পরিত্যাক্ত এক ভাঙা দেয়ালের গায়ে লিখে রেখে গেছে, ‘আমার স্বপ্নগুলো হোক আমার মনের প্রতিফলন, কারও ফরমায়েশি স্বপ্ন দেখতে আমি ইচ্ছুক নই। ’ বাহ বেশ কথা তো, আমিও তেমনই ভাবি, কসোভোর মানুষেরা স্বপ্ন দেখুক, স্বপ্নের বাস্তবায়ন করুক, কিন্তু সেটি তাদের মতো করে হলেই ভালো হয়, বাইরের কোনো মোড়ল-মাতব্বরের কথায় যদি তাদের গতিপথ নির্ধারিত হয় তবে এই নবীন দেশটির মানুষদের হয়তো ভবিষ্যতে আরও অনেক হোঁচট খেতে হবে।

** কসোভোর অন্ধ বাঁশিওয়ালা (পর্ব-৯)
** কসোভোর অন্ধ বাঁশিওয়ালা (পর্ব-৭)
** কসোভোর অন্ধ বাঁশিওয়ালা (পর্ব-৬)
** কসোভোর অন্ধ বাঁশিওয়ালা (পর্ব-৫)
** কসোভোর অন্ধ বাঁশিওয়ালা (পর্ব-৪)
** কসোভোর অন্ধ বাঁশিওয়ালা (পর্ব-৩)

** কসোভোর অন্ধ বাঁশিওয়ালা (পর্ব-২)
** কসোভোর অন্ধ বাঁশিওয়ালা (পর্ব-১)

[সমাপ্ত]
বাংলাদেশ সময়: ০০০০ ঘণ্টা, মার্চ ১৭, ২০১৭
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।