এমন দিনে তারে বলা যায়/এমন ঘনঘোর বরিষায়—
হ্যাঁ ঠিক তাই! জমে আছে মনের কোণে ঘন প্রেম, যাকে বলতে না পেরে গুমোট ধরেছে, তবে কোনো উচ্চকিত ব্যবস্থা মোটেও জরুরি নয় এর জন্য। এই ভেজা ঋতু আপনাকে প্রশ্রয় দেবে অজস্র, এমন দিনে একটা রঙিন চিরকুট, রবিঠাকুরের কবিতা কিংবা গান, সঙ্গে মনের কথা— তবেই প্রেম নিজেও ভিজে যাবে।
সদ্য বিচ্ছেদ হয়েছে? মনে মনে প্রেম এসে টোকা মারছে দরজায়? অথচ কাউকে ভালো লাগা সত্ত্বেও এগোতে পারছেন না, মুখ ফুটে বলতে পারছেন না কিছু? ঝিরিঝিরি বৃষ্টির দিনে দেখা করুন একটি ছাতায় জোড়া হয়ে অর্ধেক ভিজে যান গল্পে— প্রেম এলো বলে, এমন দিনে সত্যি তাকে বলা যায়...
মাটিতে এক আনন্দযজ্ঞ শুরু হয়েছে, যেনো কনসার্ট, যেনো যুগল প্রেমের ধারা, যেনো কৃত্রিম সম্পদের ওপর প্রকৃতি এসে দাঁড়িয়েছে, গাছের পাতায় হীরের চমক, মাটিতে মুক্তারাজির হুল্লোড়ের হাসি। এভাবে সূর্য নাকি শ্রবণা নক্ষত্রে আসে আর শ্রাবণ এসে যায়। এভাবে জল নামে আকাশের শরীর থেকে মাটির শরীরে, আষাঢ়-শ্রাবণে তার অঝোর বর্ষণের হাসি। খনা তার বচনে কতোই না সুন্দর শস্যের সতর্কতা জানাতেন, “জ্যৈষ্ঠমাসে শুকো ও আষাঢ়ে ধারা/ শস্যের ভার না সহে ধরা”। আমের শরীর এই বৃষ্টির পরে রসালো ও সুমিষ্ট হয়ে ওঠে, ইলিশেরা মিলনকামী হয়ে ওঠে। দুপুরের মেঘ যখন হালকা কালো হয়ে এসে শহরের উপকণ্ঠ থেকে গর্জন করে আগমনী বার্তা দেয়, তারপর অনর্গল মাটির উঠোনে, গাছের পাতায়, গাড়ির ছাদে, বাড়ির ছাদে, রাস্তায়, গলিতে, নদীতে, সমুদ্রে সর্বত্র নিজেকে সমর্পণ করে দেয় তখন বোধহয় জলেরা সবাই মিলে বরষার শিল্প বানিয়ে ফেলে। কারখানার উদোম গায়ের ছেলেটি এই বৃষ্টির দিনে শ্রাবণের শেষ গানে নিজের সমস্ত ক্লান্তি ভুলে শালপাতায় খেয়ে নেয় দু’টো কচুরি, ডাল আর বৃষ্টির জল। এইদিন সে বুঝে যায় তার কালিমাখা শরীর, দারিদ্র্যের স্বীকৃতি আর যার কাছে থাক আর না থাক, প্রকৃতির কাছে আছে। স্কুলের বরষাতি পড়া মেয়েটা দু’পায়ে জল খেলতে খেলতে বাড়ি ফেরে, মনে মনে বলে, আজ যেনো আরও বৃষ্টি হয় কাল তবে ইশকুল ছুটি! অ, আ লিখতে পারা ছেলেটা এখনও স্কুলে যায়নি ভেবে হাপিত্যেশ করে; কিন্তু বৃষ্টি এলে সে কাগজ ভাঁজ করে নৌকা বানায়। যে ছেলেটা বহুদিন হলো পুরোনো প্রেমিকাকে ভুলে গেছে সেও আজ রেডিও চালিয়ে দু’পায়ের তিনকোণা ফাঁকে সিগারেটের ধুলো ওড়াবে। যে বাড়ির দিদিমা প্রতিটা দুপুর বাতের ব্যথায় কাতরায় সেও এই শ্রাবণের দিনে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে, পেয়ারা পাতা থেকে পড়ে যাওয়া জল হাত নিয়ে মনে মনে আওড়ে নিচ্ছে “গগনে গরজে মেঘ...”। আজ মিনু মাসি তার নয় বছরের ছেলেটার তেলভাজা খাওয়া মেনে নেবে, আজ বৃষ্টির দিনে সে কাজেও যাবে না লোকের বাড়ির, ছেলেটা কুপি জ্বলা দোকানের থেকে জল পেরিয়ে নিয়ে আসবে মুড়ি আর তেলেভাজা। আজ হয়তো শ্রাবণের ঘন বরষায় কোনো জঙ্গি তার নতুন ফাঁদের পরিকল্পনা ফলপ্রসূ করবে না, আরও একদিন পৃথিবী শান্তিতে থাকবে। আজ হয়তো সেভেন স্টার হোটেলের কুক, প্রবাসী অতিথিদের ভাঁপা ইলিশ আর খিচুড়ি এনে পরিবেশন করবে। এভাবে এক একটা বরষার জন্ম হবে, আর বাড়ির হামাগুড়ি দেওয়া ছেলেটা দুধের জিভে একটুকরো মাছের ডিম পেয়ে স্বাদ জগতের রহস্য উদঘাটন করবে। বাড়ির বউ আজ জানলার ফাঁকে মুখ গলিয়ে মাটির সোঁদা গন্ধ শুকে আঁচল দিয়ে জলের ছাঁট থেকে নিজেকে আড়াল করবে আর গেয়ে উঠবে এক কলি গান, হয়তো পাশের বাড়ির মেয়েটা বলবে, বৌদি তুমি কী ভাল গাও তবে যে বড় গাও না! ভাগ্যিস আজ শ্রাবণের বৃষ্টিমাখা দিন তাই তোমার গান শুনতে পেলাম। এভাবে বরষা এলে গোটা পৃথিবী যেনো এক দীর্ঘ কবিতার লেপটে-লুপটে থাকা পঙক্তির মতো হয়ে যায়। মাছের বাজারের পাশেই কোনো এক বায়বীয় সীমানায় বরষার গন্ধ— কামিনী, জুঁই ভরপুর করে তোলে।
ছেলে-মেয়েরা বড় হতে থাকলে তাদের বড় বড় মনের ছোটো ছোটো কোণে অদৃশ্য অন্ধকার তৈরি হয়, বরষা সেই ঋতু যা ময়লা পরিষ্কার করে দিতে পারে। এই বৃষ্টি এক স্বপ্নের রাজ্য গড়ে দিতে পারে। হলিউডের ছবি ‘দ্য নোটবুক’র সেই নৌকার দৃশ্য মনে পড়ে, সেখানে বৃষ্টি বোধহয় সেই মাধ্যম যেখানে গল্পের নায়ক আর নায়িকার পুনর্মিলন হয় তার সৌজন্য।
এহেন বরষায় পৃথিবী নিজে যেনো খুব সরল ও নরম হয়ে ওঠে। মনে হয়, এক দুধসাদা আচ্ছাদনে সে নিজেকে সাজিয়ে নিচ্ছে পরতে পরতে। এই জলজ আদর আমাদের জলজ আবেগে ভরিয়ে রাখে... এই ঋতুতে আবিষ্ট মানুষের মুখ দেখে কখনও কী বোঝা যায় মানুষ পৃথিবীতে পাপ আনতে পেরেছে! বোঝা যায় না, আসলে এইখানে তো আমরা সত্যিকারের পুতুল। আর এই জগত আর তার প্রকৃতি আসলে আমাদের কোল, এদের প্রশ্রয় ছাড়া আমাদের আর কী-ই বা আশ্রয় আছে।
এই প্রসঙ্গে বিশিষ্ট চার্লস বুকোওস্কির একটি লেখা মনে পড়ে,
“rain a symphony orchestra. /there is a thunderstorm, /they are playing a Wagner overture /and the people leave their seats/ under the trees/and run inside to the pavilion/ the/women giggling, the men /pretending calm, /wet cigarettes being thrown away, /Wagner plays on, and then they are/ all under the pavilion. /the birds even come in from the trees /and enter the pavilion and then it is the Hungarian/ Rhapsody #2 by Lizs, and it still rains, but look, /one man sits alone in the rain listening. /the audience notices him. They turn and look. /the orchestra goes about its business. /the man sits in the night in the rain, listening./There is something wrong with him, isn't there? /he came to hear the music. ”
…এই তো আমাদের উজ্জ্বল বিষাদমুধুর বৃষ্টি, এই আমাদের আষাঢ়-শ্রাবণ। দুই ঋতুই বহুমাত্রিক শিল্প, মনের স্বপ্ন সব কিছুর পাথেয়। আমাদের আশ্রয়ের আবেগ আমাদের জলজ সুখ, এভাবেই জানালার কাচে ভেসে ওঠে প্রাণের সুর— আজ শ্রাবণের আমন্ত্রণে ভিজি, কে জানে এই নশ্বর প্রাণ কতোদিন এই পার্থিব বরষার সঙ্গী হবে!
তানিয়া চক্রবর্তীর প্রথম লেখা প্রকাশিত হতে শুরু করে ২০০৭ সাল নাগাদ উনিশ-কুড়ি পত্রিকায়। ২০১১ সালে কবিসম্মেলন পত্রিকায় প্রথম কবিতা প্রকাশ। এরপর থেকে নিয়মিত দেশ, উনিশ-কুড়ি, কবিপত্র, কৃত্তিবাস, ভাষানগর, কবিতা পাক্ষিক, যুগান্তর, একদিন, ঐহিক, কবিসম্মেলন, বাংলানিউজ (বাংলাদেশ), বিডিনিউজ (বাংলাদেশ), আমাদের সময়(বাংলাদেশ), বৈখরী ভাষ্য, বৈশাখী (বাংলাদেশ), নান্দীমুখ, নন্দন, উত্তরবঙ্গ সংবাদ ইত্যাদি পত্র-পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়েছে।
কাব্যগ্রন্থ চারটি- কিছু একটার জন্য (পাঠক প্রকাশনী, ২০১৩ কলকাতা বইমেলা), পুরুষের বাড়ি মেসোপটেমিয়া (সৃষ্টিসুখ প্রকাশনী, ২০১৫ কলকাতা বইমেলা), রাহুকেন্দ্রিক ঋতুকাল (শুধু বিঘে দুই প্রকাশনী, ২০১৬) ও লম্পট (ছোট কবিতা প্রকাশনী, বাংলাদেশ একুশে বইমেলা ২০১৭)।
২০১৬ সালে কালিমাটি পত্রিকার “সমকামীতা-রূপান্তরকামীতা” ও ২০১৭ সালে “অতিপ্রাকৃত” শীর্ষক বিশেষ সংখ্যা সম্পাদনা।
কালকথা পত্রিকার সৌজন্য “কালকথা সম্মান ২০১৪” ও ইতিকথা পত্রিকার সৌজন্য “ইতিকথা যুব সম্মান ২০১৬”-তে ভূষিত হয়েছেন।
মেডিকেল প্রিয় বিষয় হলেও পরবর্তীতে তা ছেড়ে কবিতার সঙ্গে সহবাস করতে ইচ্ছুক।
বাংলাদেশ সময়: ১০৪৪ ঘণ্টা, জুলাই ১৫, ২০১৭
এসএনএস