শরীরভর্তি কাঠগোলাপ গাছ বেড়ে উঠেছে। ফুল ফুটছে।
জয়া মাসি। যিনি নিজেই ছিলেন কদম। ইশকুলের জানলায় তাকে পাশে রেখে যিনি গান শোনাতেন। মেঘ গুড়গুড় করলে ফড়িংয়ের দল খুঁজতেন জয়া মাসি। কতো আর, বছর তিনেকের বড়। পড়তেন এক ক্লাস উপরে। দলবাঁধা ফড়িং হল্লা করে উড়ে বেড়ালে নাকি খুব বৃষ্টি হয়। ফড়িংয়েরা বৃষ্টি ভয় পায়। তাদের ডানা ভেঙে যায় বৃষ্টিছাটে, বৃষ্টিছাট ফড়িংয়ের কাছে যুদ্ধবিমান থেকে পড়া বোমা-বারুদ। শুধু কী ফড়িং? আরও কতো পতঙ্গের গায়ে বৃষ্টির ফোটাগুলোর মতো এসে বিঁধে, জীবন ছিনিয়ে নেয়। শ্রাবণে এতো বৃষ্টি হয়! শ্রাবণ ফড়িং এবং পতঙ্গের কাছে মহাযুদ্ধের মাস। যে যুদ্ধে তারা ঢাল-অস্ত্রহীন। বৃষ্টিই শুধু জিতে যায়। এসব কথা তাকে জয়া মাসিই বলেছিল। তারপরও তিনি দলবদ্ধ ফড়িংয়ের ভীত ওড়া দেখে আনন্দিত হতেন। তিনি পতঙ্গের জীবনের চেয়ে বৃষ্টি ভালবাসতেন, মেঘের ডাককে যিনি মনে করতেন প্রাণসখার ডাক।
জয়া মাসির কল্যাণেই তার গাছে ওঠা শেখা। ইশকুলের অদূরে একটা বড় পুকুর। এক সময় বড় গাঙ ছিলো। ওখান দিয়েই খুব জল বয়ে যেত, অনেক গ্রামের দিকে। শ্রাবণ এলে গাঙ হয়ে যেত মাঝারি নদী। স্রোত থাকতো বেশ, ঢেউ পাক দিয়ে দিয়ে নেচে উঠতো, গাঙের দুই ধার ঘেঁষে পাতা হতো জাল, মাছ ধরার হিড়িক পড়তো। ক্রমে নদী দখল হয়ে মরে গেছে, গাঙের কবরের ভিতর জন্মেছে পুকুর। পাড়ঘেঁষে সারি সারি কদম, হিজল, ছাইতান গাছ তখনও রয়ে গেছে। যখন সে গাছে চড়তে শেখে, যখন সে জানে মেয়েরা কদম-শ্রাবণ ভালবাসে। কদম পাড়তে শুরুতে জয়া মাসি নিজেই গাছে উঠতো। ধীরে ধীরে উঠে পড়তো সবচেয়ে উঁচু ডালটায়। আর বলতো, দেখছিস আমি আসমানে চলে আসছি! উঁচুতে গেলে নাকি আসমানের কাছে যাওয়া যায়। জয়া মাসি নিচে যখন কদম ফুল ফেলতো, সে মাটিতে পড়ার আগেই ধরে নিতো। আর ভাবতো, খোদার আরশ থেকে কেউ ফুল ফেলছে।
গাছে ওঠার সময় জয়া মাসিকে শুরুতে ধাক্কা দিতে হতো। ধাক্কা দেওয়ার জন্য ধরতে হতো দাবনায়। গাছ থেকে নামার সময় আবার ধরতে হতো। একবার তার হাত গিয়ে পড়লো জয়া মাসির বুকে; মনে হয়েছিল ওখানেই ফুটে আছে আসল কদম— নরমতম ফুল। সেদিনই তার মনের ভিতর কে যেনো কদম গাছ লাগিয়ে দিলো। সেই গাছে ফোটা কদম জয়া মাসি দেখলো না কখনো, স্কুল পেরোনোর আগেই সে চলে গেছে দূরঘরে, রেখে গেছে শ্রাবণঘন দিন— একলা কদমগাছ।
মনের ভেতর কদম নিয়েই সে শরীরে লাগালো কাঠগোলাপ। বড়বেলার ফুল। সারা বছর যে ফুল ফোটে। বরষায় এসে হয় অপরূপা, জলের স্পর্শে জেল্লা বেড়ে যায়। আদৃতাকে সে ভাবে জয়া মাসির বড়বেলা। যদিও আদৃতার চোখ দু’টো পদ্মপুকুরের মতো। পদ্মপুকুরও-তো শ্রাবণের জন্য অপেক্ষা করে। পুকুরের জলে বৃষ্টিফোঁটা পড়ে কেমন ব্যাঙের মতন লাফায়, পদ্মপাতায় লাফায়, লাফিয়ে লাফিয়ে পুকুরের নিজস্ব জল হয়ে যায়। আদৃতার চোখে যে পদ্মদল ফুটে আছে, তার উপরে সে ঝরে পড়তে চায়। সে যে শ্রাবণঘন মেঘ হয়ে আছে, আকাশহীন। তাহলে শরীরভর্তি কাঠগোলাপ আর মন ছাওয়া কদমের কী হবে?
আদৃতাকে নিয়ে সে কার্জন হলে যেতে চায়। স্বপ্নে দেখেছে, নাজিরাবাজারে ভরপেট বিরিয়ানি খেয়ে কার্জন হলে গেছে। আকাশ ঢেকে গেছে আদৃতার চোখের মণিতে। মেঘের তেমনি রঙ। সে একবার আকাশে তাকায়, আরেকবার আদৃতার চোখে। এতোটা আকাশ কীভাবে মেয়েটার চোখের ভিতরে ঢুকে বসে আছে! এই বুঝি নামে ঝরঝর-আকাশ থেকে, আদৃতার চোখ তো পরিষ্কার, মেঘহীন। কার্জন হলের গেট বন্ধ। আদৃতাকে দাঁড়াতে বলে গেট টপকে ভিতরে গিয়ে সে উঠে পড়ে নিকটতম কাঠগোলাপ গাছটায়। তার শরীরভর্তি কাঠগোলাপ আদৃতা দেখেনি। বুঝতে পারেনি মন তার কদম-মন্দির। পৃথিবীর গাছ থেকে তবু সে কাঠগোলাপ পেড়ে দিতে চায়, কদম গাছে চড়ে সব থেকে উঁচু ডাল থেকে এনে দিতে চায় শ্রাবণের প্রথম কদম ফুল। কাঠগোলাপের ডাল এতো নরম, ভেঙে নিচে পড়ে সে। কট করে শব্দ হয়। হাতে তার গুচ্ছ কাঠগোলাপ। প্যান্টসমেত হাঁটু ছিঁড়ে গেছে। ছোপছোপ রক্ত।
গেটের বাইরে এসে সে দেখে আদৃতা নেই। নেই তো নেই-ই। অদূরে একটা বাইকের পেছনে তাকে দেখা যায়, উঠতি ব্যান্ডের ড্রামারের এই বাইক সে চেনে। ইউনিভার্সিটিতে বহুবার দেখেছে। তার বুকের ভিতর ড্রাম বাজতে থাকে। এমন বাজনা বাজানোর সাধ্য ওই ড্রামারের নেই। ওয়ারফেইজের টিপুও পারবে না। গাছ থেকে পড়ে যাওয়ার দৃশ্য কী আদৃতা দেখেছিল? গাছের একটা ডাল ভাঙলে কীইবা আসে যায়। তার বুকের হাড় যে মটমট করে ভেঙে যাচ্ছে, সে ছাড়া এই শ্রাবণে আর কেউ তা বুঝলো না।
কদমগুচ্ছ বুঝেছে? স্বপ্নের পর তো বাস্তব দুনিয়ার মুখোমুখি সে দাঁড়াবে— এখনও যে কদম গাছ অব্দি আদৃতাকে নিয়ে যাওয়া বাকী!
বাংলাদেশ সময়: ১১২২ ঘণ্টা, জুলাই ১৫, ২০১৭
এসএনএস