এই দৃশ্য আমি যখন জানালা দিয়ে দেখি, অথবা হতে পারে আরও অনেকেই দেখে, তখন আমার জানালায় এক জোড়া চড়ুই পাখি দুর্বোধ্য ভাষায় ডাকাডাকি করতে থাকে। আমি বিরক্তি নিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ি।
যেহেতু বাসা থেকে বের হয়ে কয়েক পা এগোতেই রাস্তা, তাই গাড়ির জন্য রাস্তার পাশেই আমাকে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়। আর তখন দেখা যায়, রাস্তার ওপাশে গরগর আওয়াজ তুলে কাঠ চেরাইয়ের কলটা বড় বড় গাছের গুঁড়ি অথবা কেটে রাখা মোটা মোটা ডালগুলো বিরতিহীনভাবে চেরাই করে চলেছে। এবং কয়েকজন শ্রমিক চেরাই করা কাঠগুলো সুনিপুণভাবে সাজিয়ে রাখছে পাশে। আর মহিষের মতো মধ্য বয়স্ক সেই লোকটা রাস্তার পাশ থেকে ছড়িয়ে থাকা ভারি ভারি গাছের গুঁড়ি কাঁধে বহন করে করে সামর্থের পরিচয় দিচ্ছে। লোকটার দিকে, অকারণেই হয়তো, আমি আবার তাকাই এবং কয়েকবার তাকাই। সে পান চিবোতে থাকে এবং মাঝে মাঝে নিচু হয়ে জমাট রক্তের মতো লাল রঙের থু-থু ফেলে। তখন দেখা যায়, তার সামনে অথবা কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা কুকুরটা লেজ নাড়তে নাড়তে থু-থু'র দিকে তাকিয়ে থাকে। যেহেতু কুকুরের তেমন কোনো কাজ-কর্ম থাকে না, ফলে সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে থু-থু দেখে। কাজের ব্যাঘাত ঘটে বলেই লোকটা হয়তো কুকুরটাকে ধমক দিয়ে দূরে সরিয়ে দেয় কিংবা সে কিছুই বলে না, বরং কুকুরটা নিজেই সরে যায়। আর তখন রাস্তার বাম দিক থেকে আমার অফিসের গাড়ি চলে আসে।
সন্ধ্যার পরে, অফিস থেকে এসে, বিমলাকে বলি চা বানিয়ে দিতে। সে মগ ভরে চা এনে দেয়। আমি চা খেতে খেতে জানালা দিয়ে আবার তাকাই, রাস্তার ওপাশে। তখনও কাঠ চেরাই চলছে। সারি সারি লাশের মতো শুয়ে থাকা গাছের খণ্ডগুলো চিরে তক্তা বানানো হচ্ছে। এবং লোকটা তখন কিছুটা ক্লান্ত। যদিও আমার এমনটাই মনে হয় যে, ক্লান্তিটা সে ইচ্ছাকৃতই গায়ে জড়িয়ে নিয়েছে। রোড ল্যাম্পের হলুদ আলো তার শক্ত শরীরের উপর ঘামের সঙ্গে চিকচিক করে ফুটে উঠছে। আমি চা শেষ করে কাপটা নামিয়ে রাখি। বিমলা তখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অথবা বসে চুলে নারিকেল তেল মাখায়, নয়তো সে চুল আঁচড়ায়, নয়তো খোপা বাঁধে। আমি তাকে বলি— আচ্ছা, পৃথিবীকে চেরাইকলে কেটে গোল তরমুজের মতো দুই ভাগ করে ফেলতে পারলে কেমন হতো বলো তো!
আমার কথায় হয়তো বিমলা মজা পায়, ফলে সে হাসে। হয়তো সে সামান্য কৌতুকবোধ করে। বলে— আর যদি তার এক ভাগে তুমি থাকো আরেক ভাগে আমি, তাহলে কেমন হবে বলো তো!
আমি শিউরে উঠি, হয়তো অজান্তেই আমি ভাবতে থাকি— না না, বিমলা এতো দূরে থাকতেই পারে না। বিমলার স্পর্শ আর পরিচর্যা না পেলে, চেরাইকলের চারপাশে যেভাবে মৃত গাছগুলো খণ্ড খণ্ড হয়ে ছড়িয়ে থাকে, আমিও হয়তো জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে থাকব অমন। আর এটা তো সত্য, আমি বিচ্ছিন্নই ছিলাম। অগোছালো জীবনের চারপাশে হাজার খণ্ডে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিলাম। বিমলাই আমাকে খুটে খুটে গুছিয়ে এনেছে। এবং আমাকে সে নতুন করে গড়ে তুলেছে আবার।
আমার মাথার ভেতর তখন চেরাইকলটা গরগর করতে থাকে। যেনো মুহূর্তেই পৃথিবীটা দুই ভাগ হয়ে যাবে।
রাতের বেলা বিকট আওয়াজ তুলে রাস্তা দিয়ে গাড়ি যায়। কখনও কখনও ট্রাকের শব্দ এতো গম্ভীর হয় যে, আমার ঘুম ভেঙে যায়। তখন সামান্য চোখ মেলে অথবা চোখ না মেলেই বুঝতে পারি, বিমলা জেগে আছে। সে আমার পিঠে আলতো করে হাত রাখে। আমার আরাম হয়। আমি তার আরেকটা হাত জড়িয়ে নিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ি। সেদিন যদি অফিস না থাকে, তবে এই ঘুম দীর্ঘ হতে হতে সকাল দশটায় গিয়েও ঠেকে। আর সেইসব সকালগুলোতে চড়ুই দুটো খুবই বিরক্তিকর হয়ে ওঠে। তবু কিছুই বলি না ওদের। কেননা, ওরা বিমলার অতি প্রিয়। আমি অফিসে থাকলে ওরা বিমলার সঙ্গে রোজ গল্প করতে আসে।
এমনই এক ছুটির সকালে, বিমলাকে চিন্তিত এবং বিচলিত দেখতে পেলাম। কারণ, প্রতিদিনের সেই চড়ুই দুটো সেদিন আর জানালায় আসেনি। এবং প্রায় একই সঙ্গে দেখতে পেলাম, রাস্তার ওপাশে কাঠ চেরাইয়ের ঘরটাতে অনেক মানুষের ভিড়। সবার মধ্যেই যে এক ধরনের চাপা উৎকণ্ঠা, তা দূর থেকেও বুঝতে কষ্ট হলো না। ফলে সেদিন প্রথমবারের মতো রাতের পোশাক পরা অবস্থাতেই বাসা থেকে বেরিয়ে নেমে গেলাম নিচে। এবং রাস্তার পাশে দাঁড়াতেই যে পচা বিদঘুটে দুর্গন্ধ নাকে এসে আছড়ে পড়লো তার সঠিক উৎসমূল নির্ণয়ে খুব বেশি খোঁজাখুঁজির প্রয়োজন হলো না। কেননা, মৃত কুকুরটা রাস্তা থেকে সামান্য দূরেই ছিলো। আর তার ক্ষত-বিক্ষত শরীরের উপর নীল অথবা ধূসর রঙের মাছিরা ভনভন করে উড়ছিল। মৃত কুকুরটার দিকে কয়েকবার থু-থু ফেলে রাস্তা পার হয়ে ওপাশে চলে গেলাম। তারপর মানুষের ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে গিয়ে দেখতে পেলাম দৈত্যাকৃতির সেই লোকটাকে। শুয়ে আছে, অপারেশন থিয়েটারে রাখা লম্বা টেবিলের মত, চেরাইকলের উপর। তাকে ঘিরে থাকা মানুষেরা দেখছে, তার দেহটা দুই খণ্ড হয়ে চেরাইকলের দুইপাশে ছড়িয়ে আছে। তার কপাল-নাক-চিবুক-গলা এবং বুকের মাঝখান দিয়ে, চিকন হয়ে নেমে যাওয়া নাভি পর্যন্ত ঘন জংলি পশমের দাগ বরাবর, একটা নিষ্ঠুর সরল রেখা এঁকে দিয়ে চেরাইকলের ধারালো দাঁত তাকে সমান ভাবে দুইভাগ করে রেখেছে। একটু গলা বাড়ালেই দেখা যাচ্ছে, মাখনের মতো নরম মগজ, পানের দাগওয়ালা অর্ধের দাঁতের পাটি, ফুসফুস, পেটের মধ্যকার পেচানো নাড়িভুড়ি ইত্যাদি নির্লজ্জের মতো হা করে তাকিয়ে আছে। এমনকি মগজ এবং মাংসের ছিঁড়ে যাওয়া সুক্ষ্ণ কয়েকটা টুকরো ছিটকে ছড়িয়ে আছে চারপাশে। অথচ কোথাও এক ফোঁটা রক্তের চিহ্ন নেই!
বাসায় ফিরে বিমলাকে এ ব্যাপারে খোলসা করে কিছুই বললাম না। বরং আমার মনে হতে লাগলো, যেনো সত্যিই পৃথিবীর তলপেটে নিষ্ঠুর করাত চালিয়ে কেউ গোল তরমুজের মতো দুইভাগ করে কেটে ফেলছে, যার উভয় খণ্ডই জমাট রক্তে পরিপূর্ণ। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম, আরেক দল মানুষ ততক্ষণে মৃত কুকুরটার পাশে এসে ভিড় করেছে এবং কেউ কেউ উচ্চস্বরে দাবি করছে যে, কুকুরটা মূলত তাদেরই পোষ্য ছিলো।
বাংলাদেশ সময়: ১১৪৯ ঘণ্টা, আগস্ট ১৭, ২০১৭
এসএনএস
অমরাবতী | রাসেল রায়হান
হারুন | শাফিনূর শাফিন
ঘৃণার গল্প | মুহাম্মদ ফরিদ হাসান
লাইক শেয়ার কমেন্ট | মাহবুব ময়ূখ রিশাদ
সেকেন্ডহ্যান্ড | মাহমুদ নোমান
পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন | মাসউদ আহমাদ
গিলরয় | ফারাহ্ সাঈদ
ঘর | নুসরাত নীলা
প্রেম-অপ্রেমের কাব্য | নাহিদা নাহিদ
জীবনের ছুটি নেই । জব্বার আল নাঈম
বোবা সুখ | নাদিরা মুসতারী
খুচরো আলাপ | কিঙ্কর আহ্সান
যেভাবে এহসানের ট্রেন বিষয়ক গল্পে ঢুকে পড়ি | এনামুল রেজা
যেভাবে অনিকেতের মৃত্যু হয়েছিল | আবু উবায়দাহ তামিম
আদিম | আবদুল্লাহ আল ইমরান
টান । আকাশ মামুন
এই সময়ের এক কুড়ি গল্প পড়ুন বাংলানিউজে